বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হেনরি কিসিঞ্জারের কী ভূমিকা ছিল?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হেনরি কিসিঞ্জারের কী ভূমিকা ছিল?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হেনরি কিসিঞ্জারের কী ভূমিকা ছিল?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যে নামগুলো সবচেয়ে বেশি সমালোচনার সঙ্গে উচ্চারিত হয়, সেই তালিকায় সম্ভবত হেনরি আলফ্রেড কিসিঞ্জারের নামও আসবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করা এক মন্তব্যের সঙ্গে হেনরি কিসিঞ্জারের নাম জড়িয়ে রয়েছে।গত ৩০শে নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটে নিজ বাড়িতে ১০০ বছর বয়সে মারা গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকা কেমন ছিল? আর বাংলাদেশ নিয়ে তার অবস্থান আর মন্তব্যই বা কী ছিল?

মার্কিন রাজনীতিতে কিসিঞ্জারের উত্থান

১৯২৩ সালে জার্মানিতে জন্ম নেন হেনরি কিসিঞ্জার। ১৯৩৮ সালে বাবা-মায়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি। ১৯৪৩ সালে তিনি দেশটির নাগরিকত্ব লাভ করেন।হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি নেয়ার পর সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন মিস্টার কিসিঞ্জার।মার্কিন রাজনীতিতে তিনি প্রবেশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের হাত ধরে।

১৯৬৮ সালে রিচার্ড নিক্সন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবার পর মি. কিসিঞ্জারকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন।হোয়াইট হাউজেই বসার জন্য একটি কক্ষ দেয়া হয় তাকে।তারপর আর মিস্টার কিসিঞ্জারকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

তার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা আর প্রেসিডেন্টের কাছাকাছি থাকার সুবিধা নিয়ে কম সময়েই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেন তিনি।পরবর্তী সময়ে নিক্সন প্রশাসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনসহ দেশটির ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী কূটনীতিক হিসেবে নিজের জায়গা পোক্ত করে নেন।তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য নেয়া বিতর্কিত নীতি ও পদক্ষেপের জন্য তাকে ঘিরে আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই অনেক বেশি ছিল।

বিশেষ করে তার সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি, চিলির অগাস্টো পিনোশেসহ বিশ্বজুড়ে বহু কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক গোষ্ঠীকে সমর্থন, কম্বোডিয়ায় বোমা ফেলা- যাতে ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, এমনকি চিলিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত - এমন বহু ঘটনায় বারবার নাম জড়িয়েছে মি. কিসিঞ্জারের।আবার তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময়েই প্যারিসে ভিয়েত কংয়ের সাথে জটিল আলোচনার পর ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়- যে কারণে তিনি উত্তর ভিয়েতনামের লি ডাক থোর সাথে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।

১৯৭৩ সালে তার কূটনীতির কারণেই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে একটি অস্ত্রবিরতি হয়েছিল। চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ তৈরির পেছনে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল।স্বায়ু যুদ্ধের সময়কার 'রিয়াল পলিটিকে'র মূর্ত প্রতীক বলেও তাঁকে মনে করেন অনেকেই। রাজনীতিতে 'রিয়াল পলিটিক' বলতে বোঝানো হয় যে বা যারা নীতি-আর্দশের বদলে বরং নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পাকিস্তানের শরণাপন্ন

সত্তরের দশকে যখন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তুমুল স্নায়ু যুদ্ধ চলছে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নেকে ঠেকাতে ভিন্ন এক পথ ধরার পরিকল্পনা করে নিক্সন প্রশাসন।

বেশ কিছু ঘটনাপ্রবাহের ফলে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, সেটাকেই লুফে নিয়ে দুই কমিউনিস্ট দেশের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করে নিক্সন প্রশাসন। আর একাজে ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তানকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বেছে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।“আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে যে স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল সেখানে রাশিয়াকে আটকানো ছিল তাদের প্রধান কর্তব্য। তারা বন্ধুত্ব করেছে রাশিয়ার শত্রু চীনের সঙ্গে। এখানে দুইটা সমীকরণ হয়ে গেছে। একদিকে আমেরিকা, পাকিস্তান আর চায়না, আর অন্যদিকে রাশিয়া আর ভারত” বলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী।

পুরানো মিত্র চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ তৈরিতে পর্দার আড়াল থেকে কাজ করে পাকিস্তান। এর ফলাফলস্বরূপ ১৯৭১ সালে অতি গোপনীয়তার সাথে চীনে যান হেনরি কিসিঞ্জার।তবে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে একই সময়ে পাকিস্তানে চলমান সংকটে পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণাত্মক ভূমিকায় তাদের পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নেন এই কূটনীতিক।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কিসিঞ্জারের ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের ভূমিকা নিয়ে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে ২০১৩ সালে একটি প্রবন্ধ লেখেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক গ্যারি জে. বাস।সেখানে হোয়াইট হাউজ থেকে প্রকাশিত নথি ও টেপের বরাত দিয়ে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে চালানো পাকিস্তানি জান্তার চালানো গণহত্যা সম্পর্কে নিক্সন ও কিসিঞ্জার ওয়াকিবহাল ছিলেন।

কেবল তাই নয়, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে পাকিস্তানের সাহায্য পেতে সেনাবাহিনীর এসব কাজে সমর্থনও দিয়ে গেছেন তারা।এমনকি ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে চালানো ‘অপারেশন সার্চলাইট’ সম্পর্কে আগে থেকে জানলেও নীরব ভূমিকা পালন করেছেন।

“হোয়াইট হাউজের টেপগুলোতে নিক্সনের অভ্যাসগত অশ্লীলতার বাইরেও তাদের মানসিক ক্ষোভ ধরা পড়েছে। ওভাল অফিসে বসে নিক্সন কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন ভারতীয়দের “ব্যাপক দুর্ভিক্ষ” হওয়া দরকার। এসময় কিসিঞ্জার “মরতে থাকা বাঙ্গালীদের” জন্য “দরদ দেখানো” লোকদের প্রতি কটাক্ষ করেন”, লিখেছেন অধ্যাপক বাস।সেসময় চালানো পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাকাণ্ড নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত কনস্যুল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করেন।

এছাড়াও ভারতে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ও নিউ ইয়র্কের সাবেক রিপবালিকান সিনেটর কেনেথ বি কেটিং ওভাল অফিসে ব্যক্তিগতভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের লক্ষ্য করে চালানো গণহত্যার কথা বলেন।তবে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের কেউই তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ করেননি।

বরং মিস্টার ব্লাডকে পদচ্যুত করা হয়।গবেষক আফসান চৌধুরীর মতে, ১৯৭১ সালে হোয়াইট হাউজ আর স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভূমিকা ছিল অনেকটাই ভিন্ন।একদিকে স্টেট ডিপার্টমেন্ট চলমান গণহত্যার বিপক্ষে অবস্থান নিলেও পাকিস্তানের সামরিক জান্তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল হোয়াইট হাউজ তথা প্রেসিডেট রিচার্ড নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জারের।

কী বলেছিলেন কিসিঞ্জার?

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান তার কলাম ‘রক্তস্নান চেয়েছিলেন কিসিঞ্জার?’-এ ১৯৭১ সালের ৬ই মার্চ সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের সভার প্রকাশিত মার্কিন নথির উল্লেখ করেন।

এতে তৎকালীন রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ইউ অ্যালেক্সিস জনসন এবং হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যকার আলাপের উল্লেখ করেন তিনি।‘পাকিস্তান শক্তি প্রয়োগ করলে আমাদের তা নিরুৎসাহিত করা উচিত হবে বলে মনে করি’- জনসনের এই কথার উত্তরে কিসিঞ্জার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিরোধিতা করে বলেন, ‘‘কেন? আমাকে শয়তানের পক্ষে ওকালতি করতে দাও। আমাদের কেন কোনো কিছু বলতেই হবে?’’’

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের চালানো গণহত্যাকেও প্রচ্ছন্ন সমর্থন করেছেন বলে মন্তব্য করেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।“আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রে গণহত্যার সংজ্ঞা অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধে সহায়তা ও ইন্ধন দেয়া সমানভাবে শাস্তিযোগ্য। আর তার ভূমিকা হচ্ছে (বাংলাদেশের) গণহত্যার বর্বরতার সঙ্গে জড়িত থাকা” বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আশফাক হোসেনের মতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকা নিন্দনীয় বললে কম হবে।“পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যে গণহত্যা করে, তাতে পেছনে যিনি শক্তি জুগিয়েছেন, রসদ জুগিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন, এমনকি পরিকল্পনা করেছিলেন তার মধ্যে হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকা সামনে থাকবে” বলেন তিনি।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত কনস্যুল জেনারেল আর্চার কে ব্লাডের লেখা বই ‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অফ বাংলাদেশ’র বরাত দিয়ে অধ্যাপক হোসেন বলেন ডিসেম্বরে হওয়া এক বৈঠকে কিসিঞ্জার জিজ্ঞেস করেন, what our bastards sending from Dhaka?এ বক্তব্য থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত কনস্যুল জেনারেলের প্রতি তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে বলেই মন্তব্য করেন তিনি।

কিসিঞ্জার কি বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ বলেছিলেন?

যে দুইটি কারণে হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশে পরিচিত, তার একটি হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের প্রতি তার সমর্থন এবং দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করা।

তবে গবেষক ও ইতিহাসবিদরা বলছেন এই মন্তব্য কিসিঞ্জারের ছিল না।যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অফ দ্য হিস্টোরিয়ানে প্রকাশিত নথিতে ১৯৭১ সালের ছয় ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে এক মিটিংয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল আর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে চলমান আলোচনায় জনসন নামের একজন কূটনীতিক এই মন্তব্য করেন।

"Mr. Johnson: They'll be an international basket case.

Dr. Kissinger: But not necessarily our basket case"

মিস্টার জনসন: তারা হবে আন্তর্জাতিক এক ঝুড়িডক্টর কিসিঞ্জার: তবে জরুরী না যে সেই ঝুড়ি আমাদের হবে।তবে Basket case-এর বাংলা অনুবাদে তলাবিহীন ঝুঁড়ি শব্দদ্বয় ব্যাপক প্রচলিত হলেও, এর অর্থে যুদ্ধ পরবর্তী দুর্ভিক্ষ-আক্রান্ত দেশকে বুঝিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন ইতিহাসবিদ আশফাক হোসেইন।

হেনরি কিসিঞ্জারের শততম জন্মদিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রগতিশীল পাক্ষিক পত্রিকা দ্য নেশন একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করে।সেখানের ছবিতে দেখা যায় হাসিমুখে একটি কেকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার কিসিঞ্জার। আর সেই কেকের গাঁ থেকে রক্ত ঝরে পড়েছে।কেকের গায়ে লেখা দেশগুলোর মধ্যে ছিল বাংলাদেশের নামও।মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচিন্স ২০০১ সালে তাঁর দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ে একাত্তরের গণহত্যার জন্য কিসিঞ্জারের বিচার দাবি করেন।

সূত্র : বিবিসি