পিরিয়ডের সময় তীব্র যন্ত্রণা লাঘবে করণীয়

পিরিয়ডের সময় তীব্র যন্ত্রণা লাঘবে করণীয়

মেহেরুন নেসা

মেয়েদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগতে হয় যা তাদের জীবনযাপনের মানকে অনেক ব্যাহত করে। তেমনই একটি সমস্যার নাম হলো ডিসমেনোরিয়া। মাসিকের সময় প্রায় সকল মহিলাদেরই কম বেশি এই সমস্যাটিতে ভুগতে হয়।

মাসিকের সময় তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা তৈরি হয়, যা কোমর, রান ও পা পর্যন্ত ছড়াতে পারে। একে বলা হয় ডিসমেনোরিয়া। এই ধরনের ব্যথা সাধারণত মৃদু থেকে তীব্র পর্যন্ত হতে পারে এবং মাসিক শুরু হওয়ার ১ দিন আগে থেকে বা মাসিক শুরু হওয়ার দিন থেকে শুরু হয় এবং ১২-৭২ ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সাধারণত মেয়েদের জীবনক্রমের ১ম মাসিক শুরু হওয়ার ৬-২৪ সপ্তাহ পর থেকে প্রতি মাসিকের সময় এই ধরনের কষ্ট তৈরি হয় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে অর্থাৎ ৩০ বছর বয়সের পর থেকে তা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে স্কুল-কলেজে যাওয়া মেয়েদের এবং কর্মমুখী নারীদের প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি একটি বড় কারণ হলো- ডিসমেনোরিয়া।

ডিসমেনোরিয়া ২ ধরনের। যথা- প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি ডিসমেনোরিয়া। সেকেন্ডারির ক্ষেত্রে সাধারণত প্রচন্ড পেট ব্যথার সাথে প্রজনন তন্ত্রের কোনো রোগ, ইনফেকশন বা জীবাণু থাকে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রাইমারির ক্ষেত্রে পেট ব্যথা, কোমর ব্যথা, বমি বমি ভাব, মাথা ঘুরানো, মন খারাপ হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, অবসাদ্গ্রস্থ ইত্যাদি উপসর্গের পাশাপাশি ডায়রিয়া পর্যন্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নন স্টেরয়েড (NSAIDs), ব্যথার ঔষধ, পিল, ইত্যাদির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি এসব ঔষধ সেবনের ফলে অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে প্রাইমারি ডিসমেনোরিয়ার কষ্টগুলো অনেকাংশে স্থায়ীভাবে কমানো সম্ভব।

ডিসমেনোরিয়ার কারণঃ
মাসিকের সময় প্রোস্টাগ্লেন্ডিন নামক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের অতিরিক্ত নিঃসরণের ফলে জরায়ুর সংকোচন বৃদ্ধি পায়। এর ফলে জরায়ুর আশেপাশের রক্তনালীগুলোতে চাপ পড়ে এবং জরায়ুর মাংসপেশিতে অক্সিজেন প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। ফলে তৈরি হয় প্রচণ্ড পেটব্যথা।

বাসায় করণীয়ঃ

  • প্রয়োজনে পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। প্রতিদিন ৬-৮ গ্লাস পানি পান করতে হবে। মাসিকের সময় অবশ্যই শরীর যাতে পানিশূন্য না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের শরবত, ফলের রস, আদা-লেবু-পুদিনা পাতাযুক্ত চা পান করতে হবে।
  • মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকতে হবে।
  • পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে।
  • অতিরিক্ত চিনি-লবণযুক্ত খাবার, ক্যাফেইন, অ্যালকোহল, টোবাকো ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
  • দৈনিক কমপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে। 
  • প্রতিদিন সরাসরি রোদের আলোর সংস্পর্শে ১৫-২০ মিনিট থাকার অভ্যাস করতে হবে। গবেষণা বলছে, যারা প্রতিদিন রোদের আলোর সংস্পর্শে আসে তাদের প্রোস্টাগ্লেন্ডিন নিঃসরণ কম হয়। যার ফলে মাসিকের সময় কষ্ট অনেক কম হয়। যদি রোদের আলোর সংস্পর্শে যাওয়া সম্ভব না হয়, তবে অবশ্যই ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
  • মাসিকের সময় তলপেটে হিটিং প্যাড বা গরম পানির বোতল দিয়ে সেঁক নিলে বা কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করলে ব্যথা থেকে অনেক আরাম পাওয়া যায়। 
  • ম্যাসাজঃ মাসিকের সময় নাভির চারপাশে পেটে ৫মিনিট মৃদু ম্যাসাজ করলে খুবই আরাম পাওয়া যায়। ম্যাসাজের ফলে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। এতে ব্যথা অনেকাংশে কমে যায়। প্রয়োজনে ম্যাসাজ তেল দিয়ে ম্যাসাজ করতে পারেন। কিছু আকুপ্রেসার কৌশলের মাধ্যমে ভালো ফল পাওয়া যায়। 
  • ব্যয়ামঃ গবেষণা বলছে যেসব নারীরা বিভিন্ন ধরনের ব্যয়াম (ফ্রি হ্যাণ্ড এক্সারসাইজ, অ্যারোবিক ব্যয়াম, স্ট্রেচিং) করে, খেলাধুলার সাথে জড়িত (খেলোয়াড়) তাদের মধ্যে ডিসমেনোরিয়ার উপসর্গগুলো অনেক কম দেখা যায়। প্রতিদিন ব্যয়ামের ফলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, অক্সিজেনের প্রবাহ বাড়ে, জয়েন্ট ফ্লেক্সিবল হয়, মাংসপেশিগুলো স্ট্রেচিং হয় এবং এণ্ডোরফিন নামক এক ধরনের হরমন নিঃসৃত হয় যা ব্যথা নাশকের মতো কাজ করে।


কিছু স্ট্রেচিং ব্যয়াম

      বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেচিং ও শক্তিশালীকরণ ব্যায়ামের মাধ্যমে মাসিকের কষ্ট অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
      সপ্তাহে ১ঘন্টা করে টানা ৬সপ্তাহ স্ট্রেচিং ও শক্তিশালীকরণ ব্যয়াম অনুশীলনের মাধ্যমে মাসিকের
      কষ্টের স্থায়ী সমাধান অনেকাংশে সম্ভব।

  • প্রথমে মেঝেতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কোমর থেকে শরীরের উপরের অংশ এমনভাবে ভাজ করুন যাতে হাতসহ শরীরের উপরের অংশ মেঝের সমান্তরালে থাকে।হাঁটু যাতে ভাজ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। এ অবস্থায় ৫ সেকেন্ড থাকুন। এটি ১০ বার করতে পারেন। 
  • পায়ের আংগুলের উপর ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়ান।এবার হাত দুটো সামনে টান টান করে প্রসারিত করুন।এ অবস্থায় ৫ সেকেন্ড থাকুন। এটিও ১০বার করতে পারেন।
  • হাফ স্কোয়াটিং পজিশনে বসে হাত দুটো সামনে টান টান করে প্রসারিত করুন।এ অবস্থায় ৫ সেকেন্ড থাকুন। এটিও ১০বার করতে পারেন।
  • মেঝেতে দুই পা ফাঁক করে দাঁড়ান। এবার ডান হাত দিয়ে বাম পায়ের গোড়ালি ধরার চেষ্টা করুন। এই সময় বাম হাত উঁচু করে বাম দিকে তাকানোর চেষ্টা করুন। এ অবস্থায় ৫ সেকেন্ড থাকুন।একইভাবে অপর পাশ করুন। এটিও ১০বার করতে পারেন।

 

কোর শক্তিশালীকরণ ব্যয়ামঃ 

  • পেলভিক ব্রিজিংঃ ম্যাটের উপর দুই পা ভাজ করে চিত হয়ে শুয়ে পড়ুন। হাত দুটো শরীরের সমান্তরালে রাখুন। এবার পায়ের উপর ভর করে কোমড় উপরে উপরে উঠান। এ অবস্থায় ৫ সেকেন্ড থাকুন। এটিও ১০বার করতে পারেন।
  • প্লাঙ্কঃ ম্যাটের উপর উপুর হয়ে শুয়ে কনুই ও পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর করে পুরো শরীর মেঝের সমান্তরালে উপরে উঠান। এ অবস্থায় ৫ সেকেন্ড থাকুন। এটিও ১০বার করতে পারেন।
  • কার্ল আপঃ ম্যাটের উপর দুই পা ভাজ করে চিত হয়ে শুয়ে পড়ুন। এবার দুই হাত মাথার পিছনে রেখে ঘাড়সহ মাথা সামনে প্রসারিত করুন। এ অবস্থায় ৫ সেকেন্ড থাকুন। এটিও ১০বার করতে পারে
  • ক্যাট এন ক্যামেলঃ ম্যাটের উপরে উপুর হয়ে হাটূ ও হাতের উপর ভর করে বেড়াল যেভাবে দাড়ায়, ওই পজিশনে থাকুন। এবার পেটের মাংসপেশিকে সংকোচিত করুন, ৫ সেকেন্ড থাকুন এবং ছাড়ুন। এটিও ১০বার করতে পারেন।


মেহেরুন নেসা
ফিজিওথেরাপি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ