নির্বাচনের আগে অর্থনীতিতে সংকট কেন?

নির্বাচনের আগে অর্থনীতিতে সংকট কেন?

নির্বাচনের আগে অর্থনীতিতে সংকট কেন?

বাংলাদেশে প্রতি পাঁচবছর পরপর নির্বাচনের আগে অর্থনীতিতে নানা সংকট দেখা দেয়। ডলার পাচার থেকে শুরু করে হরতাল-অবরোধ কিংবা আন্দোলন কর্মসূচির কারণে ব্যবসায়িক ক্ষতি এবং বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া এর অন্যতম। এছাড়া অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ -এমন কিছু সিদ্ধান্তও আটকে থাকে নির্বাচন শেষ হবার অপেক্ষায়।কিন্তু এবারকার পরিস্থিতি কেমন?আর অস্থির রাজনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেই বা কী প্রভাব ফেলছে?

ব্যবসার পরিস্থিতি কেমন?

বিদেশ থেকে কৃষিপণ্য আমদানি করেন শংকর ঘোষ। চাল, ডালসহ বিভিন্ন রকম মসলা আইটেম আছে তার আমদানি তালিকায়। কিন্তু এলসি সংকটে চাহিদামতো আমদানি করতে পারছেন না তিনি।নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি আরো খারাপ দেখছেন।মি. ঘোষ বলছিলেন, “একটা সময় ব্যাংক আমাদের কাছে এলসি খোলার জন্য বসে থাকতো, এখন আমরা সারাক্ষণ ব্যাংকের পেছনে ঘুরেও এলসি পাচ্ছি না। আমার দরকার একলাখ ডলার। পাচ্ছি বিশ হাজার কিংবা পঁচিশ হাজার ডলার।''

''এছাড়া বিদেশে যে সাপ্লায়ার আছে তাকেও অনেক সময় ব্যাংক যথাসময়ে পেমেন্ট দিতে পারছে না। এজন্য বিদেশি সাপ্লাইয়াররাও অনাগ্রহ প্রকাশ করছে পণ্য পাঠাতে।”প্রায় ২৫ বছর ধরে আমদানি ব্যবসায় নিয়োজিত মি. ঘোষ জানাচ্ছেন, নির্বাচনী বছরে প্রায় সময়ই রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির থাকায় তার ব্যবসাও খারাপ যায়।

তিনি বলেন, যখনি রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, হরতাল-অবরোধ হয়, তখনি তাদের সমস্যায় পড়েন।“আমদানি করে যাদের কাছে মাল পাঠাবো, দেখা যায় তাদের দিতে পারি না। কারণ, পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙ্গে যায়। মানে ওভারঅল দেশের কোন একটা সমস্যা হলে সেটা সবার উপরে গিয়েই পড়ে।”

মি. ঘোষ যখন তার আমদানি ব্যবসার এমন চিত্র তুলে ধরছেন তখন সুখবর নেই রপ্তানিতেও। বিশেষত: রপ্তানির মূল খাত তৈরি পোশাকেও।চলতি অর্থবছরের প্রথম কয়েকমাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি আশাব্যঞ্জক না হলেও সেটা ইতিবাচক ধারায় ছিলো। কিন্তু নির্বাচনের আগে অক্টোবর এবং নভেম্বরে রপ্তানি গত অর্থবছরের একইসময়ের তুলনায় না বেড়ে উল্টো কমেছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো হিসাব দিচ্ছে, অক্টোবরে তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। আর নভেম্বরে সেটা কমেছে প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ।রপ্তানির এমন অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি পোশাক মালিকদের নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রম অধিকার, জিএসপি কিংবা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নানা আশংকা। যার মূল কারণ আবার লুকিয়ে আছে দেশের রাজনীতিতে।

নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লা অ্যাপারেলস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলছেন, নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।“শুধু ইলেকশন না, তার সঙ্গে রাজনীতিকে ঘিরেও আমরা বিদেশিদের একটা চাপ খেয়াল করছি। সেটা আসলে আমাদের কিছুটা ভাবাচ্ছে। কারণ এই চাপগুলো আসলে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত।

টটতারা যদি কোনরকমের কোন ব্যবস্থা নিয়েই নেয়, তাহলে কিন্তু আমাদের সেক্টর টেকানো যাবে না। কারণ ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে আমরা এমনিতেই একটা টালমাটাল পরিস্থিতিতে আছি।” বলছিলেন মি. এহসান।তিনি বলেন, নির্বাচনের বছরে তৈরি পোশাক খাত নানারকম চ্যালেঞ্জে পড়ে যায়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বাড়ে, কোন সমস্যা হলে তড়িৎ সমাধান পাওয়া যায় না।

“এটা আমরা আগেও ফেস করেছি যে ইলেকশন আসলে কিছুদিন মনে হয় আমরা যেন এতিম অবস্থায় থাকি। এই সময়গুলোতে আমাদের কাজ-কর্মে একটু গতি কমে যায়। রাস্তায় অস্থিতিশীলতা থাকলে বিদেশি ক্রেতারা তখন কয়েকমাসের জন্য দেশে আসতে চায় না।”

বাংলাদেশে নির্বাচন এলে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার চিত্র বেশ পুরনো। গেলো দুই দশকের পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায় ২০০৬ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের সময় এ অবস্থা দেখা গেছে। সেসময় আওয়ামী লীগের হরতালের মতো একের পর এক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে, ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা।পরবর্তীকালে বিশেষত ২০১৪ এবং এবারের নির্বাচনের আগে বিএনপি’র আন্দোলনেও সাপ্লাই-চেইন ব্যহত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। যার প্রভাব পড়ছে প্রায় সব খাতে, পাইকারি এবং খুচরা বাজারেও।

যেমন, ইসলামপুরের বস্ত্র ব্যবসায়ী গোলাম কিবরিয়া জানালেন ঢাকার বাইরের ক্রেতার অভাবে তার ব্যবসা মৃতপ্রায়। গেলো বুধবার দুপুরে তিনি বলছিলেন,“অন্যদিন দুপুরের মধ্যে লাখ খানেক টাকার মাল বিক্রি হয়ে যায়, কিন্তু আজকে অবস্থা খারাপ। শুধু বিসমিল্লাহ করলাম মাত্র তিন হাজার টাকা। এই অবস্থা চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। মফস্বলের কাস্টমার হরতাল-অবরোধের কারণে আসছে না। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের যে অবস্থা, মানুষের মধ্যে কাপড় কেনার আগ্রহও কম।”

সরকার কী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে?

এতো গেলো ব্যবসার পরিস্থিতি। এর বাইরে সামগ্রিক অর্থনীতিতেও নির্বাচন এবং রাজনীতির প্রভাব আছে। অনেকক্ষেত্রে অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নির্বাচন শেষ হবার অপেক্ষায় আটকে থাকে। যেটা নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে অর্থনীতিতে।পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, এবারও ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি, সুদের হার এবং সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো সামলাতে যেসব বড় পদক্ষেপ দরকার, নির্বাচনের আগে সেটা দেখা যাচ্ছে না।

তিনি বলছেন, “সংস্কার করাটা রাজনৈতিক কারণেই খুব একটা আকর্ষণীয় নয়। কারণ এটা অনেকসময় পেইনফুল হয়। কিছু সুবিধাভোগী শ্রেণি আছে, তারা সবসময়ই সুবিধা হারাবে এটা ভেবে নীতি সংস্কারে বাধা দেয়। আবার নীতি সংস্কারের কারণে সাধারণ মানুষেরও সাময়িক কষ্ট বৃদ্ধি পেতে পারে। এসব ভেবেই সরকারগুলো নির্বাচনের বছরে বড় কোন সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। ফলে অর্থনীতির সংকটটা আরো দীর্ঘায়িত হয়।”তার মতে, এবারও কিছু কাজ অর্থনীতিতে জরুরি। কিন্তু সরকার সেটা করছে না।“ব্যাংকে সুদের হার বাড়াতে হবে। এটা কোন না কোন সময় বাড়াতে হবেই। কিন্তু এখন বাড়াবো নাকি ইলেকশনের পরে বাড়াবো? সরকার হয়তো চিন্ত করছে তাহলে ইলেকশনের পরেই করি। এখন কেন ঝামেলা নিতে যাবো?”

“ডলারের বিনিময় মূল্য বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। সেটা কি এখন দিবো নাকি পরে দিবো? এখন ছেড়ে দিলে যদি ডলারের রেট একশত পঞ্চাশ টাকায় উঠে যায়, তখন কি করবো? তারচেয়ে ইলেকশন চলে যাক। তখন একশত পঞ্চাশ টাকায় উঠলেও তখন সেটা দেখা যাবে। আমি (সরকার) তো টিকে যাচ্ছি। মূলত: এমনসব চিন্তার কারণেই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তগুলো স্থগিত হতে থাকে।” বলছেন আহসান এইচ মনসুর।

সরকার কী বলছে?

কিন্তু সরকার কি আসলেই নির্বাচনী বছরে অর্থনীতি সংস্কারের বদলে নির্বাচনী রাজনীতিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে? জানতে যোগাযোগ করা হলে সরকারের বাণিজ্য কিংবা অর্থমন্ত্রণালয় কারো পক্ষ থেকেই কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

যদিও নির্বাচনী পরিস্থিতির কারণে সরকারের অনেক সিদ্ধান্তই যে ঝুলে আছে, সেটা বোঝা যায় সম্প্রতি সরকার এবং প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নানা বক্তব্যে।গত অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন, আর্থিক খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার নতুন সরকার করবে।তিনি বলেন, “সরকার, ব্যবসায়ী ও জনগণ সবার মনোযোগ এখন নির্বাচনের দিকেই। তাই সরকারের মূল লক্ষ্যও এখন নির্বাচন।”

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন নির্বাচনের পর ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি।সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, “প্রতিবার ইলেকশনের এরকম হয়। আমরা দেখি একটা অনিশ্চয়তা থাকে। ইলেকশনের পরে যখন নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে আপনারা দেখবেন যে খুব দ্রুত অর্তনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। আমাদের ধারণা আগামী জুনের মধ্যে অর্থনীতি পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াবে ইনশাআল্লাহ।”

সেসময় রিজার্ভ প্রসঙ্গে গভর্নর আরো বলেন, ''নির্বাচনের পরে বিদেশি ঋণ এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে থাকবে, ট্রেড ক্রেডিটও বাংলাদেশ পেতে থাকবে। ফলে যেটা হবে, আবার এটা (রিজার্ভ) পজিটিভ হবে। জুনের মধ্যে রিজার্ভ আবার বিল্ডআপ হতে শুরু করে করবে।''কিন্তু নির্বাচনের পরে যে পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে এমনটা সবসময় নাও হতে পারে। বিশেষত বাংলাদেশের রাজনীতি যে নির্বাচনের পরে শান্ত হয়ে যাবে তেমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং উল্টোটাই আশংকা করছেন অনেকে।ফলে অর্থনীতিতে সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার শংকাও থেকে যাচ্ছে।

সূত্র : বিবিসি