যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের নির্বাচনের 'সকল বিষয় পর্যবেক্ষণ করবে'

যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের নির্বাচনের 'সকল বিষয় পর্যবেক্ষণ করবে'

যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের নির্বাচনের 'সকল বিষয় পর্যবেক্ষণ করবে'

বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই লক্ষ্যে দেশটির দুটি নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থান করছে।নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন যে, অন্য পর্যবেক্ষকদের মতো শুধু কেন্দ্রে ভোট দেখেই দায় সারবে না যুক্তরাষ্ট্র। আগামী সাতই জানুয়ারির ভোটের আগে পরের সহিংসতা ও ত্রুটিগুলো মূল্যায়ন করতেই পাঠানো হয়েছে ছোট এই পর্যবেক্ষক দলকে।

তারা মনে করছেন, বাংলাদেশের অতীতের দুটি জাতীয় নির্বাচন দেশে বিদেশে নানা বিতর্ক তৈরি করেছে। এ কারণে আগামীতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতেই যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশকে এতোটা গুরুত্ব দিচ্ছে।নির্বাচন কমিশন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইন্সটিটিউট (এনডিআই) আগামী নির্বাচনের সব কিছুই পর্যবেক্ষণ করবে। এ জন্য তাদেরকে অ্যাক্রিডেশন দেয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "মোট ১২ জনের সব তথ্য ভেটিং করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদেরকে আমরা ভোট পর্যবেক্ষণের অনুমতি দিয়েছি"।এই দুটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের নির্বাচনের সকল বিষয় পর্যবেক্ষণ করবে। শুধু রাজনৈতিক সহিংসতা না, ভোটের আগে পরের সব পর্যবেক্ষণ তাদের রিপোর্টে থাকবে, জানান মি. দেবনাথ।

বিজ্ঞপ্তিতে আইআরআই যা বলছে

শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের আইআরআই তাদের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে জন্য আইআরআই ও এনডিআই'র পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে পৌঁছেছে।এই প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশে ছয় থেকে আট সপ্তাহ অবস্থান করবে। অবস্থানকালে নির্বাচন পূর্ববর্তী, নির্বাচনের সময় ও নির্বাচন পরবর্তী সহিংস পরিস্থিতির ওপর নজর রাখবে এবং সেগুলোর মূল্যায়ন করবে।

যেখানে আরও বলা হয়, এই পর্যবেক্ষক দল বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনী সহিংসতার বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ করবেন। এরমধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সহিংসতা, আন্ত-দলীয় সহিংসতা, নারী ও অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সহিংসতা, অনলাইনে হয়রানি ও হুমকি।এছাড়া ভবিষ্যৎ নির্বাচনে যাতে সহিংসতা কমানো হয়, সেটার গঠনমূলক সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন ওই কারিগরি দল দেবে বলেও জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।এর আগে গত আটই অক্টোবর থেকে চার দিন বাংলাদেশ সফর করেছিল এনডিআই ও আইআরইয়ের একটি প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশন।

নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যখন কোন বিদেশি পর্যবেক্ষক দল ভোট পর্যবেক্ষণে আসেন তখন তারা বড় কোন টিম পাঠান। তারা নির্বাচনের দিন সারাদেশের ভোটগ্রহণের সব চিত্র পর্যবেক্ষণ করেন"।কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই দল শুধু ভোটের দিনের ভোটের চিত্র দেখতে আসছে না বলেও মনে করেন মি. আলীম।

যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণ কী?

বাংলাদেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তবে এই দুটি নির্বাচন নানা প্রশ্নের জন্ম দিলেও ভোটের পর এ নিয়ে খুব একটা তৎপরতা দেখা যায়নি দেশটির।

তবে বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্ট হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। তখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশের র‍্যাব ও ছয়জন কর্মকর্তার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয় ওয়াশিংটন।যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপের পর বাংলাদেশে বিচারবহিবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা অনেকটাই কমে যায়।পরবর্তীতে নির্বাচনকে মাথায় রেখে চলতি বছরের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতির কথা জানায়।

যেখানে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।নির্বাচন বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “বাংলাদেশে নতুন করে একটা সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়ার একটা সুযোগ ছিলো। হয়তো সেটি নিশ্চিত হচ্ছে না। সে কারণে এটির ওপর যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে”।

ভোট দেখতে বিদেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে আর কারা আসছে?

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশ, সংস্থা ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে আবেদন করেছে। যার মধ্যে পর্যবেক্ষক হিসেবে আবেদন করেছে ১৫৬ জন।অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন চারটি সংস্থা ও ৩৪টি দেশের নির্বাচন কমিশনের ১১৪ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভোট পর্যবেক্ষণের।

এর আগে নির্বাচনের চার মাস আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠক করলেও তারা শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ না করার ঘোষণা দেয়।যুক্তরাষ্ট্রের মতো তারাও ভোট পর্যবেক্ষণে ছোট একটি টেকনিক্যাল টিম পাঠাবে।এর বাইরেও কয়েকটি দেশ থেকে ছোট ছোট টিম আসার কথা রয়েছে বাংলাদেশের এই ভোট পর্যবেক্ষণে।

নির্বাচন কমিশন জানাচ্ছে, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভারত, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, ডাচ, ইরাক, ফিলিস্তিন, জর্জিয়া, উগান্ডা, নরওয়ে, বুলগেরিয়া, কঙ্গো থেকে আগামী সাতই জানুয়ারির ভোট পর্যবেক্ষণের আবেদন করেছে।নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যাদেরকে ভেটিং করে দেয় তাদেরকে আমরা পর্যবেক্ষক হিসেবে অনুমতি দেই। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের যে গাইডলাইন আছে, সেই গাইডলাইন ফলো করেই তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারে’।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অন্য পর্যবেক্ষকদের পার্থক্য যেখানে

সাতই জানুয়ারির নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকে প্রতিনিধি দল আসলেও তারা শুধু নির্বাচনের দিন ভোটগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করবেন।তবে যুক্তরাষ্ট্রের এনডিআই ও আইআরআই প্রতিষ্ঠান দুটি বাংলাদেশে থাকবেন ছয় থেকে আট সপ্তাহ।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এনডিআই ও আইআরআই- নির্বাচন পূর্ব, ভোটের দিন ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ের বিষয়গুলো তারা পর্যবেক্ষণ করবে। তারা যদি শুধু নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আসতো তাহলে বিশাল টিম পাঠাতো”।মি. আলীম বলছেন, তারা ভোটের সার্বিক পরিবেশ দেখে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে একটি রিপোর্ট দিবে। তারা ভোট পর্যবেক্ষণ না, মূলত ভোটকে মূল্যায়ন করবে, যোগ করেন তিনি।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বিবিসিকে বলেন, “পর্যবেক্ষণ করে তারা একটা রিপোর্ট দেবে। এবং যাওয়ার আগে তারা হয়তো তা প্রকাশও করবে”। তাদের এই পর্যবেক্ষণকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে নির্বাচন কমিশন, জানান মি. দেবনাথ।নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, যখন কোন জায়গায় সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ থাকে না, অর্থাৎ সব দলের অংশগ্রহণ থাকে না, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যেসব ভোট নিয়ে প্রশ্ন থাকে; সেখানে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বদলে কারিগরি টিম পাঠায় যুক্তরাষ্ট্রের এই সংস্থা দুটি।

সূত্র : বিবিসি