ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ফের শুরু হচ্ছে ‘উপাচার্য তাড়ানো’ আন্দোলন

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ফের শুরু হচ্ছে ‘উপাচার্য তাড়ানো’ আন্দোলন

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : ফের শুরু হচ্ছে ‘উপাচার্য তাড়ানো’ আন্দোলন

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) উপাচার্য অধ্যাপক শেখ আবদুস সালামের মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে। ফলে পরবর্তী উপাচার্য হতে ইতোমধ্যেই তদবিরদৌঁড় শুরু করেছেন পদপ্রত্যাশী শিক্ষকরা। একইসঙ্গে পূর্বের মতোই মেয়াদের অন্তে থাকা উপাচার্যকে তাড়ানো আন্দোলনের পট তৈরী হচ্ছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে উপাচার্য বিরোধী এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পদপ্রত্যাশী শিক্ষক নেতারা। শিক্ষকদের একটি পক্ষ দীর্ঘদিন থেকে পর্দার আড়ালে উপাচার্য বিরোধী কার্যক্রম চালালেও কিছুদিনের মধ্যেই তারা মাঠের কর্মসূচিতে যাবেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। তারা কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্র সংগঠনকেও নিজেদের দিকে আনার চেষ্টা করছেন। ফলে আগামীতে ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন মহলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

বিশ^বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপাচার্য তাড়ানো আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ে একরকম সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ইতোপূর্বে দায়িত্বপালন করা প্রায় সব উপাচার্যের বিরুদ্ধেই মেয়াদের শেষ দিকে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১২তম উপাচার্য হিসেবে সর্বশেষ দায়িত্বপালন করা অধ্যাপক হারুন-উর-রশীদ আসকারী ব্যাতিত পূর্বের কোন উপাচার্যই তাঁদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। তাদের অধিকাংশই পদ ছেড়েছেন দুর্নীতির অভিযোগে বিক্ষোভের মুখে। তবে পদ ছাড়ার পর উপাচার্যদের এসব অভিযোগ নিয়ে কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। মেয়াদপূর্ণকারী উপাচার্র্যের বিরুদ্ধেও শেষের দিকে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। তবে করোনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিক্ষোভ গতি পায়নি। পরবর্তীতে ক্যাম্পাস বন্ধ অবস্থাতেই তার মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ১৩তম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শেখ আবদুস সালাম। 

গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে উপাচার্যের নিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথোপকথনের অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার শুরু হয়। এ পর্যন্ত অন্তত ১৪টি অডিও সামাজিক মাধ্যয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব অডিওকে সামনে রেখে ফেব্রুয়ারিতেই উপাচার্য বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। শিক্ষক নেতাদের ইন্ধনে কর্মচারীরা প্রকাশ্যে উপাচার্য বিরোধী কর্মসূচি শুরু করেন। অন্যদিকে শিক্ষক সংগঠনেরর পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে উপাচার্যের দুর্নীতিসংক্রান্ত বিষয় উপস্থাপন করে তদন্তের অনুরোধ জানানো হয়। সেসমই উপাচার্য বিরোধী চূড়ান্ত বিক্ষোভ শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে উপাচার্যকে পদ থেকে সরানো হবে না- উপর মহল থেকে এমন বার্তা থাকায় সে আন্দোলনের হালে পানি পায়নি। উপাচার্য বিরোধীরা নির্বাচন পরবর্তীতে আন্দোলনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন ও মাঠ গোছাতে থাকেন। নির্বাচনের পর উপাচার্য ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে ইউজিসি ও দুদকের তদন্ত কার্যক্রমকে সামনে রেখে ফের আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে। বিশ^বিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদেরই একটি পক্ষ আন্দোলনের রূপরেখা নির্ধারণ করছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপাচার্য বিরোধী অবস্থানকে কেন্দ্র করে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে নতুন করে মেরুকরণ হয়েছে। পূর্বের গ্রুপ উপগ্রুপ ভেঙ্গে বর্তমানে নতুন গ্রুপ ও জোটের সৃষ্টি হয়েছে। একটি পক্ষ উপাচার্যের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলছেন। অন্যরা রয়েছেন উপাচার্য বিরোধী জোটে। শিক্ষকদের সঙ্গে সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্র নেতারও বিভক্ত হয়েছেন এ দুই শিবিরে। পূর্বে সাবেক উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যপন্থীদের দুইটি গ্রুপ সক্রিয় থাকলেও বর্তমানে উপাচার্য বিরোধী অবস্থানে সাবেক উপাচার্যপন্থীদের সঙ্গে সাবেক উপ-উপাচার্যপন্থীদের একটি অংশ এক হয়েছেন। 

অভিযোগ রয়েছে বর্তমান প্রশাসনকে চাপে ফেলতে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছয়টি ককটেল সদৃশ বস্তু পাওয়ার ঘটনাকে উপাচার্যবিরোধীদের চক্রান্ত বলে মনে করছেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যাক্তিসহ উপাচার্যপন্থী শিক্ষকরা। যদিও এ ঘটনাকে উপাচার্যের দুর্নীতি থেকে দৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা বলে দাবি উপাচার্যবিরোধীদের। 

প্রগতিশীল শিক্ষক সংগঠন শাপলা ফোরামের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, ‘কোন অবস্থাতেই কোন ধরণের দুর্নীতির প্রশ্রয় দেওয়া হবে না, এজন্য আমাদের জায়গা থেকে যা করণীয় সবটাই করা হবে। যতক্ষণ বিষয়টি পরিষ্কার হবে না, আমি ব্যাক্তিগত জায়গা থেকে একচুলও ছাড় দেব না। উনি যদি নির্দোষ হন তাহলে স্বাগত জানাবো। আর যদি দোষী হন তাহলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্ররণ করবে, এটিই চাওয়া। আমাদের এ অবস্থান দুর্নীতির বিরুদ্ধে। ভিসি বা অন্য কোন পদের বিরুদ্ধে না।’ 

শাপলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক রবিউল হোসেন বলেন, ‘সম্প্রতি মিটিং থেকে উপাচার্যের কাছে আমরা কিছু বিষয় জানতে চেয়ে তিন দিন সময় দিয়েছিলাম। সেটি পার হয়ে গেছে। উপাচার্য যদি সন্তোষজনক জবাব না দেন, তাহলে আমরা সাধারণ মিটিং করে সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে আন্দোলন মাঠ পর্যায়ে নেব।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক আব্দুল মুঈদ বলেন, ‘শিক্ষক হওয়ার চেয়ে প্রশাসক হওয়ার নেশা থেকেই এসব আন্দোলন হয়। যারা উপাচার্য হতে চান তারা এটির একটি সুযোগ নেয় যাতে দ্বিতীয় মেয়াদে আসতে না পারে। এটি আগেও হয়েছে এখনো হচ্ছে। এটি ভালো চর্চা না। আন্দোলনের সময় পদ পাওয়ার জন্যই বিভিন্ন কথা বলে। এজন্য চেয়ার ছেড়ে দিলে পরে অভিযোগ নিয়ে আর কিছু হয় না। এগুলো মূলত পদের জন্য আন্দোলন, দুর্নীতি শুধু একটি ইস্যু। এতে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার জন্য ক্ষতি হয়। তবে এখন এটি কঠিন। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হলে সেটি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মানবে না।’ 

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কেউ যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোন তৎপরতা চালায় তাহলে বিশ^বিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্টেকহোল্ডাররা সেটিকে ভালোভাবে নেবে না। ফলে সেটি নস্যাৎ হবে।’

এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক শেখ আবদুস সালাম বলেন, ‘মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে কিছু নোংরা মানুষ নোংরামি করছে। কেউ অভিযোগ করতেই পারে তবে এসব অভিযোগের কোটি ভাগের এক ভাগেরও সত্যতা নেই। আমি এসব নিয়ে শঙ্কিত নই, কাউকে পরোয়া করিনা। অভিযোগ ফেস করতে চাই, আমি চলে যাওয়ার মানুষ না।’