বাইপোলার ডিসঅর্ডার হলে বুঝবেন কিভাবে

বাইপোলার ডিসঅর্ডার হলে বুঝবেন কিভাবে

বাইপোলার ডিসঅর্ডার হলে বুঝবেন কিভাবে

এমন কিছু মানুষ আছেন যারা এক সময় মানসিকভাবে ভীষণ উৎফুল্ল থাকেন আবার কয়েকদিন পরেই হতাশায় ডুবে যান। দু'টি অনুভূতির তীব্রতাই অনেক বেশি থাকে।যারা এ ধরণের চরম মেজাজ পরিবর্তনে ভুগছেন তাদের জানা জরুরি এটি বাইপোলার ডিসঅর্ডারের প্রভাবে কি না।'বাইপোলার ডিসঅর্ডার' এমন এক ধরণের তীব্র মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি যা আপনার মুড বা মেজাজকে প্রভাবিত করে। এটি 'ম্যানিক ডিপ্রেশন' নামেও পরিচিত।

সাধারণত আপনি যদি হঠাৎ খুব আনন্দিত অনুভব করেন, অতিরিক্ত অ্যাকটিভ বা সক্রিয় হয়ে যান, মন অস্থির থাকে এবং তারপর হঠাৎ আপনার এনার্জি অনেক কমে যায়, প্রচণ্ড বিষণ্ণ বোধ করেন তাহলে আপনার বাইপোলার ডিসঅর্ডার থাকতে পারে।মেজাজের এই চরম উত্থান পতনের অনুভূতি কয়েক দিন এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই একেক ধরণের মেজাজের সময়কালকে 'মুড এপিসোড' বলা হয়।

মন চরম উৎফুল্ল বা অতিরিক্ত অ্যাকটিভ থাকার এপিসোডকে বলা হয় 'ম্যানিয়া' এবং বিষণ্ণ ও অলস থাকার এপিসোডকে বলে 'ডিপ্রেশন'।বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্তরা কিছু সময় স্বাভাবিকও থাকতে পারেন।আক্রান্তদের অনুভূতিগুলো এতো তীব্র থাকে যে এতে তার প্রতিদিনের রুটিন, সামাজিক যোগাযোগ, প্রিয়জনের সাথে সম্পর্ক, অফিস, পড়াশোনা বা যেকোনো কাজের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এতে আত্মহত্যার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।

বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণ
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলো নির্ভর করে আপনি কোন এপিসোডে আছেন তার ওপর।অনেকে প্রথম দিকে ডিপ্রেশন এপিসোডে থাকতে পারেন, তারপর আসতে পারে ম্যানিয়া এপিসোড। এই এপিসোডের পরিবর্তন যখন তখন হতে পারে। আবার অনেকের দু'টি এপিসোড একসাথে দেখা দিতে পারে।তবে আগেই জানিয়ে রাখি, এসব লক্ষণ থাকা মানেই যে আপনি বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগছেন সেটা বলা যাবে না। এটি শুধুমাত্র একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলতে পারবেন।

ডিপ্রেশন
ম্যানিয়া পর্বের আগে আপনার ক্লিনিকাল ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা এপিসোড দেখা দিতে পারে। এই এপিসোডে নিজেকে একদম মূল্যহীন মনে হতে পারে, যার প্রভাবে অনেকে আত্মহত্যার চিন্তাও করেন।

এই এপিসোডের সাধারণ লক্ষণগুলো হলো :

- চরম দুঃখবোধ, আশাহীনতা বা মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়

- এনার্জির অভাব

- মনোযোগ দিতে এবং মনে রাখতে সমস্যা

- প্রতিদিনের সাধারণ কাজকর্ম করতে ইচ্ছা করে না, যেমন- দাঁত ব্রাশ করা, চুল আঁচড়ানো, বিছানা ঠিক করা

- ভীষণ শূন্যতা বোধ হয়, নিজেকে মূল্যহীন লাগে, নিজের দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ জাগে

- অপরাধবোধ ও হতাশা ভর করে

- আত্মহত্যার চিন্তা ঘুরপাক খায়

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্তদের আত্মহত্যার ঝুঁকি সাধারণ মানুষের তুলনায় ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি থাকে এবং এদের অর্ধেকের বেশি মানুষ অন্তত একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

ম্যানিয়া
ম্যানিয়া পর্যায়ে, আপনি খুব উচ্ছ্বসিত বা অনেক আনন্দে থাকেন, আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়, প্রচুর এনার্জি পান, বড় বড় পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এই ভালো বোধের তীব্রতা এতোই বেশি যে অনেক সময় ব্যক্তি তার সাধ্যের বাইরে কেনাকাটা করেন, প্রচুর খরচ করেন। যেটা হয়তো স্বাভাবিক সময়ে তিনি ভাবতেও পারেন না।

এ সময় তারা দ্রুত কথা বলেন, খেতে বা ঘুমাতে ভালো লাগে না, অল্পেই বিরক্ত হয়ে যান।অনেকের আবার সাইকোসিসের লক্ষণও দেখা দেয়। যেমন- আপনি এমন কিছু দেখতে বা শুনতে পান যা বাস্তবে নেই। ম্যানিয়ার লক্ষণগুলো হলো :

- খুব উচ্ছ্বসিত, আত্মবিশ্বাসী ও অস্থির

- এনার্জি বেড়ে যাওয়া, উচ্চাভিলাষী ও সৃজনশীল পরিকল্পনা

- অপ্রয়োজনে প্রচুর অর্থ ব্যয়

- খেতে বা ঘুমাতে ভালো লাগে না

- খুব দ্রুত কথা বলা

- সহজেই বিরক্ত ও উত্তেজিত হয়ে যাওয়া

- নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা

- সহজেই বিভ্রান্ত হওয়া

- হ্যালুসিনেশন, অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা করা

কারো মধ্যে যদি দু'টি এপিসোড একসাথে কাজ করে, তাহলে তারা একদিকে যেমন বিষণ্ণ থাকেন, অন্যদিকে কাজে ভীষণ অ্যাকটিভ থাকতে দেখা যায়।সাধারণত ম্যানিয়ার এপিসোডের চেয়ে বিষণ্ণতার এপিসোড বেশি সময় ধরে থাকে। যেমন- ম্যানিয়া যদি তিন থেকে ছয় মাস থাকে তাহলে বিষণ্ণতা থাকতে পারে ছয় থেকে ১২ মাস।

বাইপোলার ডিসঅর্ডার হওয়ার কারণ কী?
বাইপোলার ডিসঅর্ডার হওয়ার সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে, যেমন- কর্মক্ষেত্রে নানা চাপ, সম্পর্কে টানাপোড়েন বা ভাঙ্গন, সেইসাথে ব্যক্তি বা সামাজিক জীবনে অনেক সমস্যা যেমন- অভাব, শারীরিক, যৌন বা মানসিক নির্যাতন, সেইসাথে জীবনের মোড় ঘোরানো পরিবর্তন এলে যেমন- পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্য বা প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণে বাইপোলারে ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।এছাড়া জেনেটিক্সে অর্থাৎ পরিবারে কারো বাইপোলার ডিসঅর্ডার থাকলে সেটা পরবর্তী প্রজন্মে বর্তানোর আশঙ্কা বাড়ে।

অনিয়মিত জীবনযাপন যেমন- খাওয়া দাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ না থাকা, অপর্যাপ্ত ঘুম, মদ ও ধূমপানের অভ্যাস ইত্যাদি বাইপোলার ডিসঅর্ডার হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়।মস্তিষ্কের যে কেমিক্যাল বা রাসায়নিক মস্তিষ্কের কাজ নিয়ন্ত্রণের করে, সেগুলো হলো নরড্রেনালিন, সেরোটোনিন ও ডোপামিন-যাদের নিউরোট্রান্সমিটারও বলা হয়। যদি এক বা একাধিক কেমিক্যাল বা নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, তবে একজন ব্যক্তি বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত বলে ধরা যেতে পারে।

যেমন- নরড্রেনালিনের মাত্রা খুব বেশি হলে ম্যানিয়ার এপিসোড বাড়ে এবং এটির মাত্রা খুব কম হওয়ার ফলে বিষণ্ণতার এপিসোড দেখা দিতে পারে।এছাড়া অন্যান্য মানসিক রোগ থাকলে যেমন- মনোযোগে ঘাটতি, অতিরিক্ত উদ্বেগ, হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার বা এডিএইচডি থাকলেও তাদের বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি এক শ’ জনের মধ্যে একজন তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়েছেন।বাইপোলার ডিসঅর্ডার যেকোনো বয়সে হতে পারে, এর মধ্যে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে দেখা দেয়ার আশঙ্কা বেশি। তবে ৪০ এর পরে এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলক কম।পুরুষ ও নারীদের বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও সমান।

সেরে উঠবেন কিভাবে?
আপনার বাইপোলার ডিসঅর্ডার আছে কি না তা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ভালো বলতে পারবেন। এজন্য তারা আপনাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করবেন, যেমন: আপনার মানসিক এপিসোডগুলো কতোটা তীব্র হয়, আত্মহত্যার চিন্তা আসে কি না, পরিবারে কারো এমন সমস্যা আছে কি না। এরপর বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষাও দিতে পারেন। আপনার সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেই তারা সিদ্ধান্ত নেবে আপনার চিকিৎসা প্রয়োজন কি না।তবে চিকিৎসক যদি জানান আপনার বাইপোলার ডিসঅর্ডার আছে, তাহলে আপনার উচিত হবে তার পরামর্শ মতো নিয়মিত চিকিৎসা নেয়া। এতে একজন ব্যক্তি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।

চিকিৎসকরা ম্যানিয়া ও ডিপ্রেশন এপিসোডগুলো প্রতিরোধ করতে মেজাজ শিথিল করা ওষুধ দিয়ে থাকেন যা দীর্ঘমেয়াদে প্রতিদিন খেতে হয়।সেইসাথে কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপি ও পারিবারিক সম্পর্ক ভালো করার থেরাপির মাধ্যমে বিষণ্ণতা মোকাবেলা করতে বলা হয়।

এসব থেরাপি ছয় মাস থেকে ১২ মাস ধরে নিতে হতে পারে।এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম করা, নিজের পছন্দের কাজ করা, সুষম খাবার খাওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণ ও পর্যাপ্ত ঘুম বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলো কমাতে সাহায্য করতে পারে। এজন্য চিকিৎসকরা একটি রুটিন দিয়ে থাকেন।

সেইসাথে কাজের অতিরিক্ত চাপ কমানোও জরুরি।আবার অনেকে এসব এপিসোডের কষ্ট কমানোর জন্য মদ, ধূমপান ও মাদক নিয়ে থাকেন। এতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়।এক কথায়, ওষুধ, থেরাপি ও জীবন যাত্রায় পরিবর্তন আনার মাধ্যমে এর চিকিৎসা চলে।সাধারণত লক্ষণ গুরুতর না হলে, অর্থাৎ নিজের বা অন্যের ক্ষতি করার আশঙ্কা না থাকলে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন হয় না।

বাইপোলার ডিসঅর্ডার, গর্ভাবস্থায় আরো খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। আবার গর্ভাবস্থায় ও দুধ খাওয়ানো মায়েদের বাইপোলার ওষুধ গ্রহণের ঝুঁকিও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।চিকিৎসকের সাথে আলোচনা না করে ওষুধ বন্ধ বা ওষুধ চালিয়ে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেবেন না।আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, আপনি যদি বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হন, তাহলে বিষয়টি চেপে না রেখে পরিবার ও বন্ধুদের সাথে কথা বলুন, তাদের সাহায্য নিন। কারণ আপনার তাদের যত্নেরও প্রয়োজন আছে।

সূত্র : বিবিসি