নির্বাচনে জিততে তান্ত্রিকদের সাহায্য খুঁজেছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রার্থীরা

নির্বাচনে জিততে তান্ত্রিকদের সাহায্য খুঁজেছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রার্থীরা

নির্বাচনে জিততে তান্ত্রিকদের সাহায্য খুঁজেছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রার্থীরা

“আমি যাদের সাহায্য করবো, তারা অবশ্যই জিতবে”, জাকার্তার উপকণ্ঠে লাল রঙা একটি দ্বিতল ভবনে নিজ অফিসে ধূপের ধোঁয়ার মাঝে বসে এমনটাই বলছিলেন কি কুসুমো।তলোয়ার, মার্বেল মূর্তি আর কাঠের মুখোশ দিয়ে এই ঘরটি সাজানো হয়েছে।

চোখ বন্ধ ও দুই পা আড়াআড়ি করে বসে মি. কুসুমো তার হাত বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাড়াচ্ছিলেন। এসময় ফিসফিস করে পড়া তার মন্ত্রের প্রায় কিছুই শোনা যাচ্ছিল না।মি. কুসুমো একজন বিখ্যাত তান্ত্রিক, নিজেকে তিনি ‘লৌকিক পথ্য, আধ্যাত্মিক শক্তি এবং সম্মোহনে’ দক্ষ বলে দাবি করেন।

ব্যবসায়িক চুক্তির জন্য সবচেয়ে ভালো তারিখ কবে হবে এটি থেকে শুরু করে কোনো বিয়ে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদে গিয়ে ঠেকবে কি না- এমন নানা সমস্যার বিষয়ে সাহায্য চাইতে তার কাছে আসেন ক্লায়েন্ট বা অনুসারীরা।কিন্তু প্রতি পাঁচ বছর পর পর দেশটিতে সাধারণ নির্বাচনের সময় এলে রাজনীতিবিদরা আধ্যাত্মিক পরামর্শ এবং নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ জানতে তার দরজায় কড়া নাড়েন।

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০ কোটিরও বেশি ইন্দোনেশিয়ান ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক আইনপ্রণেতা নির্বাচিত করতে।মি. কুসুমো জানান, নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত দেশটির তান্ত্রিকদের ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটে।তবে ইন্দোনেশিয়ায় ‘ডুকুন’ নামে পরিচিত এই তান্ত্রিকদের ভূমিকা বেশ বিতর্কিত, তাদের নিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন মতও।

কিছু আদিবাসী এবং লৌকিক সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে তান্ত্রিকরা নিরাময়, সুরক্ষা এবং আধ্যাত্মিক জগতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।বিয়ে কিংবা লম্বক দ্বীপে খেলার মতো কোনো আয়োজনে প্রতিকূল আবহাওয়া এড়াতে ‘বৃষ্টি তান্ত্রিকদের’ ভাড়া করা সেখানে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা না।তবে অনেক ইন্দোনেশিয়ান এসকল বিষয়কে সন্দেহের চোখে দেখেন। বিশেষ করে তরুণরা।

তেমনই একজন জাকার্তায় মার্কেটিংয়ে কাজ করা ৩২ বছর বয়সী ঘিনাস্তি রামাধান্তি।তার কাছে তান্ত্রিকদের কাজ ‘স্ক্যাম’ বলে মনে হয়।“আমি কখনোই তান্ত্রিক বা আধ্যাত্মিক নেতাদের বিশ্বাস করিনি, কারণ অনেকেই বলেছেন যে সাহায্যের জন্য তাদের কাছে গিয়ে কোনো লাভ হয়নি। তাদের অনুসারীরা সত্যিই লাভবান হচ্ছে কিনা সেটার কোনো প্রমাণ নেই। এমনকি তারা যদি লাভবান হয়ও, এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই যে সেটা তান্ত্রিকদের কারণেই হয়েছে”, বলেন তিনি।

এক হাজারের কিছু বেশি ইন্দোনেশিয়ানকে নিয়ে ওয়েলকাম গ্লোবাল মনিটরের করা ২০২০ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশটির ১৩ শতাংশ মানুষের লৌকিক উপায়ে নিরাময়ে বিশ্বাসী। আর ৪৩ শতাংশ মানুষের এ বিষয়ে ‘কিছুটা’ আস্থা রাখেন। তবে জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি বলছে যে এদের ওপর তাদের আস্থা বা বিশ্বাস ‘খুব বেশি’ বা ‘একেবারেই’ নেই।এছাড়াও বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায় এবং সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে কট্টর ইসলামিক মতাদর্শ বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে।

ইসলাম ধর্মে আল্লাহ ব্যতীত অন্য সত্ত্বার কাছ থেকে সুরক্ষা এবং সহায়তা চাওয়া সাধারণত হারাম বলে বিবেচিত।ইসলামিক বিষয়ে দেশটির আধা-সরকারি সংস্থা ইন্দোনেশিয়ান ওলামা কাউন্সিল (এমইউআই) প্রতিটি নির্বাচনেই রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের প্রার্থীদের সতর্ক করতে বলেন, যেন তারা তান্ত্রিকদের কাছ থেকে পরামর্শ না নেয়।

“এমইউআই ২০০৫ সালে তান্ত্রিকবিদ্যা হারাম বলে একটি ফতোয়া জারি করে। জিনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ভবিষ্যত জানা হারাম- যুক্তি দিয়ে এই ফতোয়া দেয়া হয়”, নির্বাচনি প্রচারণার শুরুতে সামাজিক মাধ্যম এক্সে (যা আগে টুইটার ছিল) এমনই একটি পোস্ট দেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান চোলিল নাফিস।মি. কুসুমোর দাবি, তার অনুসারীদের জেতানোর জন্য তিনি জিনদের ব্যবহার করেন।

তিনি তার অনুসারীদের তাবিজও দেন। এরমধ্যে বন্য শুয়োরের নাক থেকে সংগ্রহ করা জীবন্ত কীটও আছে। তার দাবি, এটি তার পকেটে রাখলে প্রার্থীর আকর্ষণ বাড়ে।জিনের মতোই এই ধরনের তাবিজও ইসলামে নিষিদ্ধ।মি. কুসুমো বলেন, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি কয়েক ডজন রাজনীতিবিদকে এবং ভোটের আগের দিন ‘ইন্দোনেশিয়াজুড়ে প্রার্থীদের’ পরামর্শ দিয়েছেন।তবে তান্ত্রিকদের কাছে যাওয়া প্রার্থীরা ভোটারদের প্রতিক্রিয়ার ভয় পান।

“বিশেষ করে লোকজন চেনে এমন পাবলিক ফিগার যারা আছেন এবং পুনরায় নির্বাচিত হতে চান, তারা রাত দুইটা-তিনটার দিকে আসেন। কারণ তারা চান না মানুষজন তাদের দেখুক। তারা মুখোশ পরাসহ বিভিন্ন ছদ্মবেশে আসে”, বলেন মি. কুসুমো।তবে বিবিসির কাছে তিনি তেমন কারও নাম প্রকাশ করেননি।এই সাক্ষাতের অনেকগুলোই যেহেতু গোপনীয় থাকে, তাই রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই প্রবণতা কতটা বিস্তৃত তা জানা কঠিন।মি. কুসুমো একজন অভিনেতাও। তিনি তার এই সার্ভিসের জন্য কত টাকা নেন বিবিসিকে তা না বললেও, তার বিশাল বাড়ি এবং বিলাসবহুল গাড়ির প্রতি আগ্রহের বিষয়ে আলাপ করেন।

ধর্ম ও দর্শনের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্যারামাডিনা সেন্টারের পরিচালক মুসলিম স্কলার বুধি মুনাওয়ার রাচমানের মতে, ইন্দোনেশিয়ায় স্থানীয় বিশ্বাস প্রায়শই ধর্মের সাথে মিশে যায়। যার ফলে জাদুবিদ্যার চর্চা আর ইসলামী বিশ্বাস সহাবস্থান করে।এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ‘কেজাওয়েন’, এটি এমন একটি বিস্তৃত ব্যবস্থা যেখানে জাভানিজ অ্যানিমিজম, হিন্দু-বৌদ্ধ বিশ্বতত্ত্ব, রহস্যবাদ এবং ইসলামের উপাদানগুলো একসাথে থাকে।

‘কেজাওয়েন’ শব্দটি নিজেই ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল দ্বীপ জাওয়া বা জাভা থেকে এসেছে। দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি এখানেই বাস করে।দেশটির প্রায় সব রাষ্ট্রপতিই জাভা থেকে এসেছেন এবং মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তারা কেজাওয়েনের কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করেছেন- এমন ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত।বলা হয়, নিজের আত্মা শুদ্ধ করতে দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ পবিত্র বলে গণ্য এক জঙ্গলে ধ্যান করেছিলেন এবং তার উত্তরাধিকারী সুহার্তো নিজ আত্মা শুদ্ধ করতে একটি নদীতে স্নান করেছিলেন।

নিজের জন্য শুভ মনে করায় বর্তমান রাষ্ট্রপতি জোকো উইডোডো তার গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সিদ্ধান্তগুলো জাভানিজ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ঘোষণা করেন।সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং একজন সম্মানিত ইসলামিক স্কলার আবদুর রহমান ওয়াহিদ, বিশ্বাস নিয়ে তার বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং গভীর রাতে মুসলিম সাধুদের সমাধি পরিদর্শনের জন্য পরিচিত ছিলেন।

সুতরাং কিছু রাজনীতিবিদ “ইসলামিক উপায়ে তান্ত্রিক কাজ চালানো গুরুদের কাছে যাবেন”, বলেন মি. রাচমান।পূর্ব জাভার বানিউওয়াঙ্গি শহরে স্থানীয় নির্বাচনে প্রচারণা চালানোর সময় একজন ইসলামিক গুরুর পরামর্শ নেয়ার কথা স্বীকার করেন পার্টাই কেবাংকিতান বাংসা (পিকেবি) নামের একটি মধ্যপন্থী ইসলামী দলের সদস্য আহমদ রিফাই।তার গুরু তাকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে প্রার্থনার বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছিলেন।বিব্রত হাসি দিয়ে মি. রিফাই বলেন, “আমি কুরআন পড়তে আলাস পুরওতে গিয়েছিলাম”।

কিছু স্থানীয় বাসিন্দা আলাস পুরও নামের পবিত্র জঙ্গলে আত্মা থাকে বলে মনে করেন। আত্মায় বিশ্বাসীরা জঙ্গলটির লুকানো গুহায় ধ্যান করতে আসে। বলা হয়, সুকর্ণও সেখানেই গিয়েছিলেন।“আমি বিশ্বাস করি এই মহাবিশ্বে কেবল মানুষই বসবাস করে না”, বলেন তিনি।

“আমি আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টির সাহায্য চাই, সেটা দৃশ্যমান হোক কিংবা না হোক”।তিনি অবশ্য নির্বাচনে আধ্যাত্মিক ও কৌশলগত হাতিয়ারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছেন।পেশায় একজন আইনজীবী মি. রিফাই বলেন, তিনি কয়েক মাস ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং, সামাজিক মাধ্যমে মিমস এবং নির্বাচনি জেলা ও ভোটারদের ম্যাপিংয়ের মতো বিষয়গুলো নিয়ে অনলাইন কোর্স করতে সময় ও অর্থ ব্যয় করেছেন।

ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সুহার্তোর একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসানের এক বছর পর ১৯৯৯ সালে ইন্দোনেশিয়ায় প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।গণতন্ত্র আরও পোক্ত হওয়ায় প্রার্থীরা ভোটারদের সম্পৃক্ত করতে ব্যক্তিত্ব জাহিরের বিষয়টি মূল্যায়ন করছে।কিন্তু “আমরা লৌকিক থেকে সম্পূর্ণরূপে আধুনিক হয়ে যাইনি - আমরা এখনও দুইয়ের মিশ্রণ”, বলেন মি. রাচমান।কিছু রাজনীতিবিদ বিশ্বাস করেন “রাজনৈতিক পরামর্শদাতাদের মতো কেবল কার্যকরী ও হিসেব কষাই সন্তুষ্ট না”, বলেন তিনি।

“তারা এমন কিছু চায় যেটা আরও নিশ্চিত”।আর তার মতে প্যারানরমালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের ফলে “তীব্রভাবে চাওয়া কিছু প্রত্যাশা পূরণ” হয়ে যেতে পারে- এতে করে প্রার্থী যদি সফল হয়, তারা আধ্যাত্মিক জগতকে সেই কৃতিত্ব দেয়।বানিউওয়াঙ্গির নুসানতারা তান্ত্রিক অ্যাসোসিয়েশনের আরেক তান্ত্রিক আবদুল ফাতাহ স্বীকার করেছেন যে আচার-অনুষ্ঠান সত্ত্বেও তার অনেক রাজনীতিবিদ অনুসারী নির্বাচনে সাফল্য পাননি।

“কিন্তু আমি মনে করি রাজনীতিবিদরা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের পথ দেখাতে এবং শক্তি দেওয়ার জন্য এখনও আধ্যাত্মিক গুরুর প্রয়োজন হয়,” বলেন তিনি।মি. রিফাইও বলেন, প্রতিযোগিতামূলক স্থানীয় নির্বাচনের মধ্যে মনের প্রশান্তি বজায় রাখার জন্যই কেবল তিনি তার আধ্যাত্মিক গুরুর দিকে ঝুঁকেছেন।হারতে প্রস্তুত কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি উত্তর দেন: “অবশ্যই। একজন সত্যিকারের যোদ্ধা হিসেবে, আমাদের জয় এবং হারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আপনি যদি তেমন না হন, তবে রাজনীতির জগতে আসার ঝক্কি নিতে যাবেন না”।

সূত্র : বিবিসি