বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে উগান্ডায় বহুমুখী উদ্যোগ

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে উগান্ডায় বহুমুখী উদ্যোগ

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে উগান্ডায় বহুমুখী উদ্যোগ

গোটা বিশ্বে চোরাশিকার ও চোরাচালানের কারণে অনেক প্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে৷ উগান্ডায় সেই সমস্যার মোকাবিলা করতে কড়া আইন, বিশেষ আদালত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷১৯৮৩ সালে চোরাশিকারীরা উগান্ডায় উন্মুক্ত পরিবেশে বাস করা শেষ সাদার্ন হোয়াইট রাইনো প্রজাতির গণ্ডার মেরে ফেলে৷ বিশাল অথচ নিরীহ এই প্রাণীর আয়ু ৪৫ পর্যন্ত হতে পারে৷ কিন্তু বেআইনিভাবে সেই গণ্ডারের খড়গ বিক্রির লোভে প্রাণীটিকে বিলুপ্ত করে দেওয়া হলো৷

এমন অপরাধ সত্ত্বেও হত্যাকারীদের শাস্তি হয় না বললেই চলে৷ আফ্রিকার প্রথম বিশেষ ওয়াইল্ডলাইফ কোর্টের গ্ল্যাডিস কামাসানইয়ু সেই পরিস্থিতি বদলাতে চান৷ তিনি বলেন, ‘‘কোনো প্রাণীর চোরাশিকার হলে সেই প্রজাতি তাদের বিরুদ্ধে সেই অন্যায়ের ঘটনা রিপোর্ট করতে পারে না৷ এমনকি বেঁচে গেলেও কোনো প্রাণীর পক্ষে তা জানানো সম্ভব নয়৷ সেই কেসের ফলোআপও তারা করতে পারে না৷ আদলতে উপস্থিত হয়ে নিজেদের বক্তব্য পেশ করার সুযোগও তাদের থাকে না৷ অন্যায়ের শিকার হয়ে মানুষের মতো নিজেদের কষ্ট তুলে ধরতেও পারে না৷''

গ্ল্যাডিস এমন প্রাণীর জন্য সোচ্চার হয়ে সেগুলির শক্তিশালী সহযোগী হয়ে উঠছেন৷ চোরাশিকার সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা পেতে চিফ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তিনি নিজে প্রায়ই কাম্পালা শহরের বাইরে একটি অভয়ারণ্য পরিদর্শন করেন৷

আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের সঙ্গে প্রায়ই যোগসূত্র পাওয়া যায়৷ সম্প্রতি চোরাচালানকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করা টিয়াপাখির করুণ অবস্থা সম্পর্কে জানা গেল৷ চিড়িয়াখানার কর্মী ওনেসমাস মুতুউজা বলেন, ‘‘কয়েকটির উপরের পালক লোপ পেয়েছে, সেগুলি আর উড়তে পারে না৷ অনেক পাখির হাড়গোড় ভেঙে গেছে৷ অনেকের প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে৷ সত্যি কথা বলতে কি, আমার মতে এই সব প্রাণীর অবশ্যই ন্যায়বিচার পাওয়া উচিত৷’’

২০১৭ সালে কাম্পালায় উগান্ডার ওয়াইল্ডলাইফ কোর্ট চালু করা হয়৷ বিচারপতি হিসেবে কামাসানইয়ু এক হাজারেরও বেশি মামলায় রায় দিয়েছেন৷ বন্যপ্রাণী নিয়ে বেআইনি বাণিজ্য যত বেশিকাল চলবে, তিনি তার বিরুদ্ধে ততকাল লড়াই চালিয়ে যেতে চান৷ গ্ল্যাডিস বলেন, ‘‘কতটা অবক্ষয় চলছে, আমি তা উপলব্ধি করেছি৷ ক্ষতির মাত্রা বুঝতে পারছি৷ প্রকৃতির সুরক্ষার জন্য বিচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে আমার বিশাল ভূমিকা রয়েছে, সেটা বার বার টের পাচ্ছি৷ শুধু আজ আমার নিজের জন্য নয়, আমার পরে যারা আসবে, তাদের খাতিরে আমাকে সেটা করতে হবে৷’’

উগান্ডার ভূখণ্ডের প্রায় ১১ শতাংশ আইন করে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ প্রাকৃতিক সম্পদে হস্তক্ষেপ, কোনো প্রাণীর ক্ষতি বা হত্যার জন্য শাস্তির মাত্রা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আরো বাড়ানো হয়েছে৷

কিন্তু তা সবসময়ে যথেষ্ট হয় না৷ ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রায় ৩,০০০ কেস নথিভুক্ত করা হয়েছে৷ জুলিয়াস ওবওনা নামের এক ওয়ার্ডেন সেই অঞ্চলে চোরাশিকারের গভীর শিকড় সম্পর্কে জানালেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এমনকি হাতির দিকে লক্ষ্য করেও বর্শা ছোড়া হয়৷ মোষ, হিপোও রেহাই পায় না৷ যে সব মানুষ এমন বর্শা ব্যবহার করে, তাদের মধ্যে অনেকে ৩০ থেকে ৪০ মিটার দূর পর্যন্ত সেটি নিক্ষেপ করতে পারে৷ আপনি চেষ্টা করে পাঁচ মিটার দূরেও ছুড়তে পারবেন না৷ এই সব মানুষ শৈশব থেকেই চোরাশিকারের কাজে লিপ্ত রয়েছে৷’’

বর্শা ছুড়ে এক মোষ হত্যার দায়ে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে৷ প্রচলিত আইনি প্রণালীতে এমন কেসে অনেক বিলম্ব ঘটতো এবং তেমন কড়া শাস্তিও হতো না৷

কিন্তু কামাসানইয়ুর আদালতে বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অপরাধ বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে৷ ২০২২ সালের এক ‘ল্যান্ডমার্ক' মামলায় তিনি হাতির দাঁতের চোরাচালানকারী এক দাগী আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন৷ সংরক্ষণবাদীরা সেই রায়কে সার্বিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে৷ উগান্ডা বণ্যপ্রাণী কর্তৃপক্ষের চার্লস তুমওয়েসিগইয়ে বলেন, ‘‘এখন বিশেষ এই আদালতের কল্যাণে আমরা লক্ষ্য করছি, যে কিছু মামলাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে৷ আমরা গোটা দেশ থেকে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের নিয়ে আসি৷ আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির রায় দেখতে পাচ্ছি৷ যারা অপরাধ করতে চায়, তারা জানতে পারে যে অপরাধ করলে কাম্পালায় এই বিশেষ আদালত রয়েছে এবং সেখানে তারা কড়া শাস্তি পেতে পারে৷ তাই আমার মতে, সেটা খুব ভালো হচ্ছে৷’’

কামাসানইয়ু মনে করেন, আদালতে হাজির করা কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তি লুপ্তপ্রায় প্রজাতির সংরক্ষণ ও সুরক্ষার গুরুত্ব বুঝতেই পারে না৷ তাই বিচার বিভাগে তাঁর ভূমিকার পাশাপাশি তিনি ‘হেল্প আফ্রিকা অ্যানিমেলস' নামের এক অলাভজনক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে সমাজে শিক্ষার উদ্যোগ নিচ্ছেন৷ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করার উপর জোর দিচ্ছেন তিনি৷ গ্ল্যাডিস বলেন, ‘‘খুদেদের ভবিষ্যতের সংরক্ষণবাদী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব৷ তারাই পরিবেশ, প্রকৃতি সংরক্ষণ করবে, প্রাণীগুলির দেখাশোনা করবে৷ আজ আমাদের যা করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে৷ আমরা যদি তাদের প্রতি মনোযোগ না দেই, কম বয়সেই শিক্ষা না দেই, তারাও ভবিষ্যতে চোরাশিকারি হয়ে উঠতে পারে৷’’

সংরক্ষণের উদ্যোগের দৌলতে আজ উগান্ডায় ৩০টিরও বেশি সাদা গণ্ডার বেঁচে আছে৷ বিচারক হিসেবে কামাসানইয়ুর আশা, অন্য দেশগুলিও অদূর ভবিষ্যতে চোরাশিকার ও চোরাচালানের ক্ষেত্রে প্রাণী অধিকারকে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দেবে৷ সাদার্ন হোয়াইট রাইনোর মতো প্রাণী আবার মুক্ত পরিবেশে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে পারবে৷

সূত্র : ডয়চে ভেলে