মিসরের পিরামিড কেন তৈরি করা হয়েছিল?

মিসরের পিরামিড কেন তৈরি করা হয়েছিল?

মিসরের পিরামিড কেন তৈরি করা হয়েছিল?

পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের কথা ভাবলে প্রথমেই আসে মিসরের পিরামিডের নাম।প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে নির্মাণ করা এই বিস্ময়কর স্থাপনার কাঠামো এবং নির্মাণশৈলীর রহস্য নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই।

ভিনগ্রহ থেকে আসা কোনো এলিয়েন স্থাপনাগুলো বানিয়েছিল কিংবা শস্য সংরক্ষণের জন্য ফারাওরা এগুলো তৈরি করেছিল, এমন নানা ধারণা প্রচলিত আছে পিরামিডকে ঘিরে।আসলেই কেন তৈরি করা হয়েছিল পিরামিড- তা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা।আর তাতে সাহায্য করেছে সাহারার শুষ্ক জলবায়ুতে সুরক্ষিত প্রাচীনকালের মিসরীয়দের লেখা, নির্মাণের মতো নানা প্রমাণ।

পিরামিড কী?
পিরামিড মূলত সমাধিক্ষেত্র। প্রাচীন মিসরের শাসনকর্তা ফারাওদের মৃত্যুর পর তাদের সমাহিত করা হতো এই বিশাল সমাধিক্ষেত্রে।

প্রায় কয়েক দশক ধরে হাজার হাজার শ্রমিকদের দিয়ে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল।কিন্তু প্রশ্ন আসে ফারাওরা কেন এই স্থাপনা নির্মাণে এত সময় ও অর্থ ব্যয় করেছিল?মূলত প্রাচীন মিসরীয় সমাজে পরকালের ধারণা প্রচলিত ছিল। সেই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই এই বিরাট আকারের সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ করা হয়।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে প্রকাশিত এক প্রবন্ধের তথ্যমতে, মিসরীয়রা বিশ্বাস করতো যতদিন ফারাওদের দেহ রক্ষা করা যাবে ততদিন তারা স্বর্গে বাস করবে।তবে তার জন্য পৃথিবী থেকে পরকালের যাওয়ার সময় ‘আত্মা’র নির্বিঘ্ন যাত্রা নিশ্চিত করা জরুরি ছিল। এই আত্মাকে তারা ডাকতো ‘কা’ বলে।

এই ‘কা’ বেঁচে থাকার জন্য প্রসাদ আকারে খাবার, বিশ্রামের জন্য বিছানাসহ কিছু ব্যবস্থার দরকার ছিল বলে তারা মনে করতো। আর সে কারণেই প্রয়োজন পড়ে পিরামিডের।প্রাচীন মিসরীয়রা বিশ্বাস করতো, পিরামিডের ভেতরে ফারাওদের ‘কা’ বেঁচে থাকতো।আর তাই ফারাওদের শরীর মমীকরণ করা হতো। তারা এটাও বিশ্বাস করতো যে পরপারের যাত্রার জন্য জাগতিক সব ধরনের জিনিসই প্রয়োজন হবে ‘কা’র।তাই ফারাওদের লাশের সাথে প্রয়োজন মতো ধন-সম্পদ দিয়ে দেয়া হতো।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মিসরবিদ পিটার ডার ম্যানুয়েলিয়ান বলেন, ‘অনেকেই আধুনিক অর্থে জায়গাটিকে কেবল একটি সমাধিক্ষেত্র হিসেবে মনে করেন। কিন্তু এটি তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু।’‘এই সুসজ্জিত সমাধিগুলোতে প্রাচীন মিসরীয় জীবনের প্রতিটি দিকের বিস্ময়কর উপস্থাপন রয়েছে- তাই এটি কেবল মিসরীয়রা কিভাবে মারা গিয়েছিল তা-ই নয় বরং তারা কিভাবে বেঁচে ছিল সেটাও বলে।’

পিরামিড নির্মাণের শুরু
পিরামিড নির্মাণের আগে মিসরীয়দের কবর দেয়ার পদ্ধতি ভিন্ন ছিল। তখন সমাধি দেয়া হতো চারকোনা ছোট আকৃতির ঘরে, যার নাম ছিল ‘মাস্তাবা’।

জাদুঘর ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউশনের ওয়েবসাইটে প্রাচীন মিসর নিয়ে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে এর উল্লেখ রয়েছে।এতে বলা হয়েছে, খ্রিস্টপূর্ব ২৭৮০ অব্দের দিকে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া আকৃতির পিরামিড নির্মাণের জন্য একটির ওপর আরেকটি– এভাবে ছয়টি ধাপে প্রথম পিরামিড নির্মাণ করা হয়েছিল।

জোসের নামের একজন ফারাওয়ের জন্য নির্মাণ করা এই পিরামিডের কোনাগুলো মসৃণ না হলেও এটাকেই প্রথম সত্যিকারের পিরামিড হিসেবে ধরা হয়।প্রচলিত আছে, এই সমাধির নকশাকারের নাম ছিল ইমহোতেপ। তাকেই পিরামিডের প্রথম নকশাকার হিসেবে ধরা হয়।প্রথম পিরামিড নির্মাণের পর পরবর্তী ফারাওরা আরো ভালো এবং বড় আকারের পিরামিড নির্মাণ শুরু করেন।

গিজার পিরামিড
পিরামিডের কথা বললে প্রথমেই যে ছবি ভেসে ওঠে তা হলো মিসরের গিজার গ্রেট পিরামিড।৪৫০ ফুট বা ১৩৯ মিটারের বেশি উচ্চতার এই পিরামিড ‘খুফুর পিরামিড’ নামেও পরিচিত।কায়রোর উপকণ্ঠ গিজায় অবস্থিত তিনটি পিরামিডের মধ্যে এটিই সবচেয়ে পুরাতন এবং বড়। তবে নির্মাণের সময় খুফুর পিরামিড আরো কিছুটা উঁচু ছিল বলে ধারণা করা হয়।

প্রায় ৬০ টন ওজনের ৩০ থেকে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের বিশাল আকৃতির ২০ লাখ পাথর খণ্ড দিয়ে নির্মিত এই পিরামিডটি তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে তৈরি করা হয়েছিল।দেশটিতে ১০০’র বেশি পিরামিড অক্ষত থাকলেও এ পিরামিডটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়।

বিশাল আকৃতির এই কাঠামোর মাত্র কয়েকটি কক্ষেই প্রবেশ করা যায়।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ৪৭ মিটার দীর্ঘ ও আট মিটার উঁচু গ্র্যান্ড গ্যালারি।ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ২৫০৯ থেকে ২৪৮৩ অব্দের মধ্যে ফারাও খুফুর শাসনামলে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। পরে খাফ্রে এবং মেনকাউরে এর পাশে আরো দু’টি পিরামিড নির্মাণ করেন।

গবেষণার জন্য প্রসিদ্ধ যুক্তরাজ্যের পেনসিলভানিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়বসাইটে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ক্লাসিকস অ্যান্ড এনশিয়েন্ট মিডেটারিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক ডোনাল্ড রেডফোর্ডের বরাত দিয়ে পিরামিড নির্মাণ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।সেখানে বলা হয়েছে, ২০ থেকে ৩০ হাজার কারিগর নিয়ে ২৩ বছরেরও কম সময়ে গিজার পিরামিড নির্মাণ করা হয়েছে।

অথচ প্যারিসের নটরডেম ক্যাথেড্রাল তৈরিতে সময় লেগেছিল দুই শ’ বছরেরও বেশি।অধ্যাপক রেডফোর্ডের মতে, পিরামিড নির্মাণকারীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন কৃষক।‘পিরামিডে কাজ করা কৃষকদের ট্যাক্স বিরতি দেয়া হতো এবং তাদের ‘শহরে’ নেয়ার পর আশ্রয়, খাদ্য এবং পোশাক দেয়া হতো’, বলেন তিনি।

পিরামিড কি দাসরা বানিয়েছিল?
‘পিরামিড কারা বানিয়েছিল’ এই প্রশ্নের দীর্ঘ সময় ধরে প্রচলিত উত্তর ছিল ‘দাস’।ধারণা করা হতো, বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষদের ধরে এনে ‘নির্দয়’ ফারাওরা দাস বানিয়ে তাদের দিয়ে পিরামিড নির্মাণ করাতো।আর এই ধারণার শুরু জুডিও-খ্রিস্টান ধারণা থেকে। পরে এটি জনপ্রিয়তা পায় সিসিল বি. ডি মিলের ‘দ্য টেন কমান্ডমেন্টস’র মতো হলিউড সিনেমার হাত ধরে। কিন্তু পিরামিডের দেয়ালে আঁকা ছবিগুলো থেকে ভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে।

এ নিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাধীনভাবে প্রকাশিত হার্ভার্ড ম্যাগাজিনে জনাথন শ’ প্রত্নতত্ত্ববিদ মার্ক লেহনারের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।‘পিরামিড দাসরা বানিয়েছিল’ প্রচলিত এই ভুল ধারণার বিপরীতে যুক্তি তুলে ধরেছেন তিনি।মার্ক লেহনারের পিরামিড নির্মাণকারীদের বসবাসের শহর খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে লেখাটিতে পিরামিডের কারিগরদের জীবনযাপনের বেশ কয়েকটি দিক তুলে ধরা হয়েছে।

বিশেষ করে তারা সেখানে যে ধরনের খাবার খেতেন তা থেকে বোঝা যায় দাস বা সাধারণ কর্মী না, তারা ছিলেন ‘দক্ষ কারিগর’।বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অ্যামেরিকান প্রত্নতত্ত্ববিদ জর্জ রিনজার পিরামিডের দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতি দেখতে পান, যেখানে পিরামিড নির্মাণকারীদের ‘খুফুর বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

লেহনারের ধারণা, মিসরীয় সমাজ কিছুটা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত হতো, যেখানে প্রায় প্রত্যেকেই শাসকের সেবা করতেন। মিসরীয়রা একে বলতো ‘বাক’।সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে তাদের উপরে থাকা লোকদেরকে কোনো না কোনোভাবে ‘বাক’ দিতে হতো। ‘কিন্তু এটা আসলে দাসত্ব হিসেবে বিবেচ্য হতো না’, বলেন লেহনার।“এমনকি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও ‘বাক’ দিতে হতো।”

পিরামিড বানানো বন্ধ করা হয়েছিল কেন?
পিরামিড নির্মাণের খরচ অনেক বেশি হয়ে যাওয়ায় ফারাওরা শেষ পর্যন্ত ওল্ড কিংডম বা প্রাচীন সাম্রাজ্যের শেষের দিকে পিরামিড নির্মাণ বন্ধ করে দেয়।এছাড়া বিরাট আকারের পিরামিডগুলোতে ধন-সম্পদ পাওয়া যাওয়ার কারণে মিসরীয়রা নিজেরাই সেগুলো লুট করে নিতো।পরে পিরামিড তৈরির বদলে ভ্যালি অব কিংসের গোপন সমাধিক্ষেত্রে ফারাওদের সমাহিত করা হতো।

পিরামিড কি শস্যের গুদাম ছিল?
পিরামিড নির্মাণের প্রচলিত ধারণার মধ্যে একটি ছিল শস্যের গুদাম হিসেবে এর ব্যবহার।ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী, জোসেফকে তার ভাইয়েরা দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয় এবং পরে ফারাওয়ের স্বপ্নের ব্যাখ্যার পর গুদামে খাদ্য সংরক্ষণ করে সাত বছরের দুর্ভিক্ষের হাত থেকে মিসরীয়দের বাঁচায়।বাইবেলে পিরামিডের কোনো উল্লেখ না থাকলেও মধ্যযুগের বিভিন্ন গল্পে এর উল্লেখ রয়েছে।

ষষ্ঠ শতাব্দীর ফ্রাঙ্কিশ বিশপ সেন্ট গ্রেগরি অফ ট্যুরসও এই ধারণা জনপ্রিয় করতে ভূমিকা রেখেছিলেন।জন ম্যান্ডেভিলের ১৪ শতকের জনপ্রিয় ভ্রমণ স্মৃতিকথায় ‘জোসেফের গুদাম ঘরের উল্লেখ করেন, যেখানে কঠিন সময়ের জন্য গম সংরক্ষণের’ বিষয়ে তিনি লিখে গেছেন।

কিন্তু রেনেসাঁর সময় থেকে যখন এ নিয়ে আরও ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়, তখনই এই ধারণা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।“এখন অবশ্যই আমরা জানি যে পিরামিডগুলো মূলত সমাধি কক্ষ ছিল- যদিও সেটা অনেকগুলো বিষয়ের একটি। পিরামিডের স্থাপত্যে এর আগের এবং পরের সময়ের কাঠামো, ভেতরের সুড়ঙ্গপথ এবং সেখানকার জায়গার কার্যকারিতা থেকে মিসরের পরবর্তী সময়কে বোঝা যেতে পারে,” বলেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিসরবিদ অধ্যাপক জন ডার্নেল।

পিরামিডের ভেতরের প্রধান উপাদান পাথর ও ইট উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই সেখানে শস্যের জন্য খুব বেশি জায়গা থাকবে না এবং একইসঙ্গে এটি শক্তি ও প্রকৌশলের বিশাল অপচয় হবে।’তাছাড়া প্রাচীন শস্যভাণ্ডারগুলো ছোট মৌচাক আকৃতির ছিল বলেও জানান তিনি।একইসাথে জোসেফের গল্পটি সম্ভবত মিসরের মধ্য সাম্রাজ্যের সময়ের, যা কি না গিজার পিরামিড তৈরির কয়েক শতাব্দী পরে বলেও উল্লেখ করেন অধ্যাপক ডার্নেল।

সূত্র : বিবিসি