ভারত সরে আসার পর যে প্রকল্পে পাকিস্তানের হাত ধরেছে ইরান

ভারত সরে আসার পর যে প্রকল্পে পাকিস্তানের হাত ধরেছে ইরান

ভারত সরে আসার পর যে প্রকল্পে পাকিস্তানের হাত ধরেছে ইরান

ইরান থেকে পাকিস্তানে গ্যাস সরবরাহ প্রকল্পের বিষয়ে সম্প্রতি একটা বড় অগ্রগতি হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে পাকিস্তান সরকারের জ্বালানি বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটি ইরানের সীমান্ত থেকে বেলুচিস্তানের উপকূলীয় শহর গোয়াদর পর্যন্ত পাইপলাইন বসানোর প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে।এই গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের বিষয়ে পাকিস্তানের অনুমোদন দুই দেশের সম্পর্কের নিরিখে খুব উল্লেখযোগ্য।

সম্প্রতি ইরান ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে পাকিস্তানে হামলা চালিয়েছিল। সেই আক্রমণকে ঘিরে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েনও চলতে থাকে।জবাবে পাকিস্তানও ইরানে পাল্টা আক্রমণ চালায়।পাকিস্তানের পাল্টা হামলার পর দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা হয়। এর পর অবশ্য দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন কিছুটা কমে।

ইরান-পাকিস্তান গ্যাস পাইপ লাইনের প্রকল্প কিন্তু পুরনো। পাকিস্তান পিপলস পার্টির সরকারের শেষের দিকে ২০১৩ সালে ইরান সফরে গিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারি এর উদ্বোধন করেছিলেন।তবে এরপর এই প্রকল্পে তেমন কোনও কাজ হয়নি।

পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) এবং পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের আমলে এই প্রকল্পে কোনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।পরে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এই প্রকল্পের জন্য ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন।এক বছরেরও বেশি সময় পর জ্বালানি বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটি এই গ্যাস প্রকল্পের একটা অংশের অনুমোদন দেয়।

এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে গ্যাস প্রকল্পটার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর কারণ হিসাবে জানানো হয়েছিল ইরানের উপরে থাকা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।যাই হোক, এখন পাকিস্তান পাইপলাইন স্থাপনের বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে, যাতে এই প্রকল্পে কাজ না করার জন্য ইরান আন্তর্জাতিক সংস্থা মারফত পাকিস্তানের উপর যে সম্ভাব্য জরিমানা বসাতে পারে সেটা এড়ানো যায়।

ইরান-পাকিস্তান গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প কী?

পাকিস্তানের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব জি এ সাবরি এই প্রকল্পে কাজ করেছেন।তিনি বিবিসিকে বলেন, ১৯৯০-এর দশকে বেনজির ভুট্টোর আমলে এই প্রকল্পের কথা ভাবা হয়েছিল। এর আগে প্রকল্পটি ছিল ইরান-পাকিস্তান-ভারত গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প।

পরে ভারত এই প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসে। এর কারণ নিরাপত্তা জনিত সমস্যা বলে জানা গিয়েছিল। তবে এটি আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় থাকায় বিষয়টা তেমন বড় ছিল না।আসলে ভারত চেয়েছিল পাকিস্তান প্রথমে ইরান থেকে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করুক এবং পরে তা নিয়ে কাজ করা হবে। যদিও সেটা কিন্তু হয়নি। এরপরই এই প্রকল্পে যোগ দিতে অস্বীকার করে ভারত।

ইসলামাবাদ-ভিত্তিক প্রবীণ সাংবাদিক খালিক কায়ানি দীর্ঘদিন ধরে এই প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেদন করছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে এই প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইরান সফরে যাওয়া প্রতিনিধি দলের অংশ ছিলেন তিনি।খালিক কায়ানি বিবিসিকে বলেন, এই প্রকল্প নিয়ে আলোচনা প্রথম শুরু হয় ১৯৯০-এর দশকে আর ২০০০ সালের পর প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০১৩ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জারদারি এবং ইরানের তখনকার রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ এটির উদ্বোধন করেছিলেন।

খালিক কায়ানি বলেন, "ভারত বুঝতে পেরেছিল যে গ্যাস সরবরাহ পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে হবে, যা তারা (পাকিস্তান) যে কোনও সময় বন্ধ করতে পারে। তাই এই প্রকল্প থেকে ভারত বেরিয়ে আসে। পরে এই প্রকল্প ইরান-পাকিস্তান গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প হিসাবে থেকে যায়।"মি কায়ানি জানিয়েছেন, যে সময় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তারা ততদিনে ইরান এই পাইপলাইনের বেশির ভাগ অংশ তৈরি করে ফেলেছিল। বাকি ছিল পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ৭০-৮০ কিলোমিটার এলাকায় কাজটুকু।

কেন এই পরিকল্পনা থেমে যায়?

সে সময়, অর্থাৎ ২০১৩ সালের মার্চ মাসে দুই দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির তরফে এই প্রকল্পের উদ্বোধনের পর কাজ সেভাবে এগোয়নি।জিএ সাবরি বলেন, "এই প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল ইরানের ওপর আরোপ করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। তবে একথাও ঠিক যে অন্য কয়েকটা দেশ চায়নি যে এই কাজটা হোক।"

সেই সমস্ত দেশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে গ্যাস ও তেল প্রকল্পে বাধা সৃষ্টি করে এসেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।খালিক কায়ানি জানিয়েছেন, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের আমলে এই প্রকল্পে কোনও অগ্রগতি হয়নি।

এর কারণ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য ওই দুই সরকারের নীতি। যুক্তরাষ্ট্র এই গ্যাস লাইন প্রকল্প নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল।মি কায়ানি বলেন, ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে সে দেশের তেল এবং গ্যাস রফতানির উপরেও বাধা রয়েছে। এই প্রকল্পে যে সংস্থা কাজ করে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব তাদের উপরেও পড়তে পারে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পাকিস্তান সরকারের একটি ক্যাবিনেট কমিটিও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থা ‘উইলকি ফর অ্যান্ড গ্যালাহারের’ কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছিল।ইরানের সঙ্গে এই প্রকল্পে কাজ করা কোম্পানি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে সে কথা জানিয়েছিল ওই সংস্থা।

পাকিস্তান-ইরানের উত্তেজনার পরও কীভাবে শুরু হল কাজ?

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন দেখা দেয়। ইরান ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় পাকিস্তানে। ইরানের অবশ্য দাবি ছিল,এস হামলার নিশানা ছিল সন্ত্রাসবাদীরা।ইরানের হামলার জবাবে পাকিস্তানও ইরানে পাল্টা আক্রমণ চালায়।

উভয় পক্ষের হামলার পর কূটনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান হলেও এই টানাপোড়েনের এক মাস পর দুই দেশের মধ্যে গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে পাকিস্তানের অনুমোদন কিন্তু বেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।খালিক কায়ানি বলছেন, এই অনুমোদন হঠাৎ করে দেওয়া হয়নি। বেশ কিছু সময় ধরে এ নিয়ে কাজ চলছিল।

যেহেতু ইরানের উপরে থাকা নিষেধাজ্ঞার কারণে যে সংস্থা এই প্রকল্পে কাজ করবে তাদের নিষিদ্ধ করা হতে পারে, তাই এখন এই কাজ করবে ‘ইন্টার স্টেট গ্যাস সিস্টেম প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি’। এই সংস্থা পাকিস্তানের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

সাংবাদিক খালিক কায়ানি জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক স্তরের কাজের কোনও অভিজ্ঞতা নেই ‘ইন্টার স্টেট গ্যাস সিস্টেম প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি'র। বাইরে থেকে কোনও পণ্যের অর্ডার ওই সংস্থা দিচ্ছে না।এখনও হাতেনাতে কোনও কাজ শুরু হয়নি। হয়তো এই কাজে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।গ্যাস পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য ধার্য ৫০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে কাজ শুরু হবে।মি কায়ানি জানিয়েছেন, ইরান সীমান্ত থেকে গোয়াদর পর্যন্ত যে গ্যাস পাইপলাইন বসানো হবে তাতে আনুমানিক ব্যয় হবে ১৫ কোটি ৮০ লক্ষ ডলার অর্থাৎ ৪ হাজার ৪০০ কোটি পাকিস্তানি রুপি।

তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, পাকিস্তান এই প্রকল্পে কাজ না করলে ইরান আন্তর্জাতিক সালিশি কাউন্সিলে যেতে পারত, যার ফলে পাকিস্তানের জরিমানাও হতে পারত।বিলম্বের কারণে ইরান এখনও ওই কাউন্সিলের দ্বারস্থ না হলেও যে কোনও সময়ে তারা ওই পদক্ষেপ নিতে পারে বলে জানিয়েছেন মি কায়ানি। এই জটিলতা এড়াতেই পাকিস্তান পাইপলাইন বসানোর অনুমোদন দিয়েছে।

কতটা সস্তা হবে গ্যাস?

আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় পাকিস্তানকে গ্যাস সরবারহের প্রশ্নে জিএ সাবরি বলেন, এই প্রকল্প নিয়ে যখন প্রাথমিক কাজ করা হয়, তখন প্রতিদিন একশো কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবারহের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ভারত এই প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসার পর ওই পরিমাণ কমে যায়।

মি কায়ানি বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় পাকিস্তানে ৭৫০ এমএমসিএফডি (মিলিয়ন স্ট্যান্ডার্ড কিউবিক ফুট পার ডে) গ্যাস পাওয়া যাবে।তিনি বলছিলেন, ইরান থেকে গোয়াদারে যে গ্যাস পৌঁছবে তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত।কারণ গোয়াদারে গার্হস্থ্য ও শিল্প গ্যাসের প্রয়োজনীয়তা ১০০ এমএমএফডি অতিক্রম করতে পারে না।

তাই উদ্বৃত্ত গ্যাস দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হবে। গোয়াদর থেকে গ্যাস দক্ষিণ-উত্তর পাইপলাইনে নিয়ে আসা হবে। রাশিয়ার সহায়তায় ওই পাইপলাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। সেই কাজের গতিও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।মি সাবরি বলেন, সরবরাহ করা গ্যাস গ্রাহকদের জন্য আমদানি করা এলএনজির চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ সস্তা হলে তবেই তা স্থানীয় মানুষদের জন্য আর্থিক ভাবে লাভজনক হবে।

তিনি জানিয়েছেন, প্রকল্পের আওতায় সরবরাহ করা এই গ্যাস স্থানীয় ভাবে উত্তোলন করা গ্যাসের চেয়ে ব্যয়বহুল হবে। কারণ স্থানীয় গ্যস উত্তোলন করা হয় পুরনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে, যাতে তুলনায় খরচ কম।মি কায়ানি বলেন, প্রকল্পের আওতায় সরবরাহ করা গ্যাসের দর আন্তর্জাতিক স্তরে ব্রেন্ট অয়েলের (অপরিশোধিত ব্রেন্ট তেল) দামের সাথে যুক্ত।

তবে এটি বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজির চেয়ে সস্তা হলেও দেশে উৎপাদিত স্থানীয় গ্যাসের চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল হবে।তিনি বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এই গ্যাসের দাম নিয়ে নতুন ভাবে আলোচনা করা হবে।এ বিষয়ে কাজ করা ইন্টার স্টেট গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বিবিসির লিখিত প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য সময় চায়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে প্রকল্পের বিষয়ে কোনও তথ্য দেওয়ার একটি 'আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া' রয়েছে।

সূত্র : বিবিসি