খেলাপি ঋণের চাপে সংকটে ১০ ব্যাংক

খেলাপি ঋণের চাপে সংকটে ১০ ব্যাংক

ছবি: সংগৃহীত

অর্থনীতির ভাষায়, ‘ব্যাংক পরের ধনে পোদ্দারি করে’ অর্থাৎ ব্যাংক ব্যবসা করে আমানতকারীদের জমানো অর্থ দিয়ে। ব্যাংক ঋণ বিতরণ করে, ওই ঋণের গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ব্যাংকের ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে (খেলাপি) পরিণত হলে পরবর্তী সময়ে যেন আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, এজন্যই প্রভিশন (ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি) রাখার বিধান রয়েছে। আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাংকগুলো তার মুনাফা কিংবা শেয়ারহোল্ডারদের মূলধন থেকে চাহিদামতো সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়।

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, সরকারি-বেসরকারি ১০ ব্যাংক প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)। বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৩১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণসংক্রান্ত ২০২৪ সালের জুন প্রান্তিকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

এ বিষয় জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী মন্দ ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়। তাই যখন খেলাপি ঋণ বাড়ে তখন বেশি নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হবে; আর রাখতে না পারলে ঘাটতি বাড়তে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করেছে এখন যদি বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হিসাব করে তাহলে খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক আরো অনেক বেড়ে যাবে। তখন ঘাটতি আরও বাড়বে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে না পারলে ঘাটতি কমবে না। আর খেলাপি কমাতে হলে সবার আগে ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। পর্ষদ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না তাদের বিষয় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অনিয়মকারী ও এ খাতের রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

নীতি অনুযায়ী, বর্তমানে অশ্রেণিকৃত ঋণের ধরন অনুযায়ী দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো তাদের নিয়মিত বা অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফার ০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত, ‘সাব স্ট্যান্ডার্ড’ বা নিম্নমানের শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং ‘ডাউটফুল’ সন্দেহজনক শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ  আর ‘মন্দ’ মানে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয় শতভাগ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সব চেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ১৪ হাজার ৭০৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিকের ঘাটতি ৫ হাজার ২৪১ কোটি টাকা, অগ্রণীর ৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ৪০১ কোটি টাকা ও বিডিবিএল এর ঘাটতি ২৪ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৪৪৩ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংকের ৩২৭ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৫০৬ কোটি টাকা,  সাউথইস্ট ব্যাংকের ১৯৮ কোটি টাকা ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাড়িয়েছে ৩৯১ কোটি টাকা।  

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৩০টি ব্যাংক কোনোমতে এ অর্থ রাখতে পেরেছে। অর্থাৎ এসব ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে কোনো ঘাটতিও নেই, উদ্বৃত্তও নেই। সরকারি-বেসরকারি ১০ ব্যাংক নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলোয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি উদ্বৃত্ত রয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তিন মাস আগে মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট বিতরণ করা ঋণের ১১.১১ শতাংশ। সেই হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা।

২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, তখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই খেলাপি ঋণ এখন দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের ১৬ বছরের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৯১০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে এক লাখ ১৪ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার কথা ছিল। কিন্তু সংরক্ষণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। এর মানে প্রয়োজনের তুলনায় ২৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা সামগ্রিক ঘাটতি হয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেওয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম হয়েছে।