নবীজী (সঃ) এর জীবনী থেকে দেশপ্রেমের শিক্ষা
প্রতীকী ছবি।
যে ভূমিতে মানুষ জন্মগ্রহণ করে, যার দোলনায় দোল খেতে খেতে সেখানকার আলো, বাতাস, রোদ, বৃষ্টি ও ছায়ায় বেড়ে ওঠে, সেটা তার মাতৃভূমি। যে ভূমির ভালোবাসা মিশে যায় রক্তের কণিকায়, হূদয়ের গভীরে। মাতৃভূমির প্রতি এ দুর্নিবার আকর্ষণ, আবেগ ও ভালোবাসা ধর্মপ্রাণ মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তি। জীবনের প্রয়োজনে কখনও দূরে কোথাও গেলেও, মন পড়ে থাকে সেথায়।
মাটি ও মানুষের জন্য ভালোবাসা ও কল্যাণকামিতা মুসলমানের দ্বিন ও ঈমানের দাবি। ‘দ্বিন হলো কল্যাণকামিতা।’ হাদিসে বর্ণিত রাসুলের এই মূলনীতি অনুযায়ী দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসা এবং তাদের কল্যাণকামিতাও মোমিনের দ্বিন ও ঈমানেরই অংশ। তাই বহুল প্রচারিত আরবি প্রবাদে বলা হয়, ‘দেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ।’ ওই প্রবাদটি হাদিস না হলেও এর অর্থ সঠিক—যেমনটা বলেছেন ইমাম সাখাভি (রহ.)। (আল-মাকাসিদুল হাসানা, পৃষ্ঠা ২৯৭)।
রাসুল (সা.)-এর জীবনে আছে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার অনুপম দৃষ্টান্ত। হিজরতের রাত। মক্কা নগরী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। প্রাণের মাতৃভূমিকে ছেড়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছেন নবীজি (সা.)। সেদিন নবীজির মনে ভীষণ কষ্ট! বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন। স্মৃতির শহরটাকে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছেন। যে শহরে কেটেছে অসংখ্য নির্ঘুম রাত। কেটেছে জীবনের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকাল। প্রিয় শহর ছেড়ে যেতে হবে ভাবেননি কোনোদিন। মক্কার উপকণ্ঠে দাঁড়িয়ে প্রিয় শহরটাকে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছিলেন। মক্কার বাড়িঘর, পাহাড় ও স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোর দিকে তাকিয়ে রাসুলের চোখে পানি চলে আসে! বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছিল তাঁর। দুচোখ বেয়ে টপটপ ঝরছিল অশ্রু।
বিদায়ের সেই আবেগঘন মুহূর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.) সজল দৃষ্টিতে মাতৃভূমির দিকে তাকিয়ে বারবার বেদনায় বিদগ্ধ হয়েছেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত হূদয় নিয়ে কাতরকণ্ঠে মক্কাকে উদ্দেশ করে বলেছেন : ‘মক্কা, কতই না পবিত্র ও উত্তম শহর তুমি। কতই না প্রিয় তুমি আমার। বিশ্বাস করো, ওরা যদি আমাকে তোমার বুক থেকে বের করে না দিত তাহলে কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৯২৬)।
মাতৃভূমি ত্যাগের ‘যন্ত্রণা’ সহ্য করতে চায় না মন। তার বিরহবেদনার ক্ষত সারে না আমরণ! তাই তো আল্লাহ তায়ালা মাতৃভূমির বিচ্ছেদ ও প্রাণ হত্যার বিষয়দ্বয়কে একসঙ্গে উল্লেখ করে বলেন : ‘আমি যদি তাদের ওপর ফরজ করে দিতাম যে তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা করো অথবা নিজেদের নগরী থেকে বের হয়ে যাও, তাহলে তারা তা করত না—তাদের অল্পসংখ্যক লোক ছাড়া। তাদের যে বিষয়ে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, তারা যদি তা পালন করত, তবে তাদের পক্ষে তা বড়ই কল্যাণকর হতো এবং তা (তাদের অন্তরে) অবিচলতা সৃষ্টিতে অত্যন্ত সহায়ক হতো।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৬৬)।
মাতৃভূমির প্রতি রাসুল (সা.)-এর সীমাহীন ভালোবাসার ফলেই তা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছিল না। নবুয়ত লাভের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) সুদীর্ঘ ১৩ বছর স্বদেশ মক্কায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে শত নির্যাতিত ও কষ্ট সহ্য করেছেন। আশায় ছিলেন একদিন স্বজাতির বিবেক জাগ্রত হবে, তারা ঈমান আনবে। কিন্তু তারা রাসুলের দাওয়াত কবুল করল না; বরং মুসলমানদের ওপর মুশরিকদের অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। এভাবে নির্মম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অবশেষে দ্বিনকে টিকিয়ে রাখতে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। কেননা ধর্মের গুরুত্ব ও মর্যাদা মাতৃভূমি, পরিবার ও পরিজন থেকেও বেশি।
মহান আল্লাহ বলেন : ‘যদি তোমরা তাকে (রাসুলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো, আল্লাহ তার সাহায্য করেছিলেন, যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দুজনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি নিজ সঙ্গীকে বলেন, বিষণ্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৪০)
অন্য আয়াতে এসেছে : ‘নিজের ওপর জুলুমরত অবস্থায় ফেরেশতারা যাদের রুহ কব্জা করার জন্য আসে (তাদের লক্ষ্য করে) তারা বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, ভূখণ্ডে আমরা অসহায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলে, আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা দেশত্যাগ করে সেখানে চলে যেতে? অতএব, এদের বাসস্থান হলো জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত মন্দ পরিণতি।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ৯৭)
আমাদের উচিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া।