পশ্চিমবঙ্গে প্রবল হচ্ছে ‘হিন্দির আগ্রাসন’ বিরোধী প্রচারণা

পশ্চিমবঙ্গে প্রবল হচ্ছে ‘হিন্দির আগ্রাসন’ বিরোধী প্রচারণা

ছবি সংগৃহিত।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে হিন্দি ভাষার তথাকথিত আগ্রাসন রোধ করে সব জায়গায় বাংলা ব্যবহারের একটি আন্দোলন ক্রমশই দানা বাঁধছে এবং রাজ্যে 'জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে' প্রতিবাদও হচ্ছে।

আর এই আন্দোলনটি এমন সময় জোরদার হয়েছে যখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দল বিজেপি'র সভাপতি অমিত শাহ দেশের প্রধান ভাষা হিসাবে হিন্দিকে তুলে ধরার কথা বলেছেন। দক্ষিণ ভারতের প্রায় সবকটি রাজ্যেই হিন্দির বিরুদ্ধে প্রবল জনমত রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। ওইসব রাজ্যে খুব কম মানুষই হিন্দি বোঝেন, কিংবা বুঝলেও অনেকটা আদর্শগতভাবেই হিন্দি বলেন না।

তাই তামিলনাডু, কেরালা বা কর্ণাটকের মতো রাজ্যগুলো থেকে যে হিন্দিকে প্রধান ভারতীয় ভাষা হিসাবে তুলে ধরার প্রচেষ্টার বিরোধিতা হবে, তা হয়তো স্বাভাবিক। তবে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব থাকলেও পশ্চিমবঙ্গবাসীকে হিন্দি নিয়ে প্রতিবাদে সরব হতে খুব একটা দেখা যায়নি। বরং অনেক সময়েই দুই বাঙালিকে নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলতে শোনাও যায়।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখন অনেকেই মনে করছেন হিন্দি ভাষার আগ্রাসন হচ্ছে এবং এর একটি রাজনৈতিক দিকও রয়েছে - ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলার পক্ষে ক্যাম্পেইন চলছে, আর প্রতিবাদ হচ্ছে রাস্তার বিক্ষোভ-জমায়েতে। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের সামনে কয়েকদিন আগে এরকমই একটা জমায়েত হয়েছিল ভাষা-সংস্কৃতি কর্মীদের, যেখানে জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া হয়েছে। ওই জমায়েতের মূল সংগঠক অধ্যাপক ইমানুল হক দীর্ঘদিন ধরেই মাতৃভাষা নিয়ে আর বাংলার সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য অ্যাক্টিভিজম চালাচ্ছেন।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, "আমরা যদিও দীর্ঘদিন ধরেই মাতৃভাষা নিয়ে আন্দোলন করছি, কিন্তু এখন অনেকেই আমাদের মাতৃভাষার ওপরে কোনও রকম আঘাত এলেই যে সরব হচ্ছেন, তার একটা কারণ নিঃসন্দেহে আছে"। "দেশের অর্থনীতির যা অবস্থা, সেইরকম সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে মানুষ একটা কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। সেই আবেগটাই প্রকাশিত হচ্ছে ইদানীং"।

ফ্যাশন ডিজাইনার তন্বী দাস বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে সামাজিক মাধ্যম আর রাস্তায় নেমে মুখর হওয়া - দুটোই করেন। তিনি বলেন, "নিজের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে সচেতনতা আগেও ছিল। কিন্তু মানুষকে আগে এতটা মুখর হতে দেখেননি হয়ত এই কারণে যে এই প্রথম কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার কথা খুব জোরালোভাবে বলছে।"

"আমরা যে একটা জাতি, সেই জাত্যাভিমানের জায়গা থেকেই প্রতিবাদ এখন বেশী দেখা যাচ্ছে," মন্তব্য তন্বী দাসের। এই বাঙালি জাত্যাভিমানের আবেগেই 'বাংলা পক্ষ' নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে, যারা নিয়মিত 'হিন্দি আগ্রাসনের' বিরুদ্ধে সরব। ফেসবুককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সংগঠনটি অবশ্য শুধুই সামাজিক মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তারা পথেও নামে।

সংগঠনটির প্রধান, অধ্যাপক গর্গ চ্যাটার্জীর কথায়, "পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু সাম্রাজ্যবাদ প্রথমেই আগুনে বাঙালিদের ঝলসে দিয়েছিল, তাই সঙ্গে সঙ্গেই সেখানকার বাঙালি লাফিয়ে উঠেছিল।" "কিন্তু এখানে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ আমাদের ফুটন্ত জলে সেদ্ধ করেছে ধীরে ধীরে, যাতে একটা সময়ে আমরা স্থবির, বলহীন হয়ে পড়ি।"

তিনি আরও বলেন, "কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা টের পেয়েছে যে জনসংখ্যার বিন্যাসে বদল ঘটিয়ে পুঁজি, বাজার, চাকরী আর জমি - এগুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে বহিরাগতদের দ্বারা, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে বাঙালিদের। এই অবস্থাটা আটকাতেই আমাদের লড়াই।" আরেকজন অ্যাক্টিভিস্ট শাশ্বতী নাথের কথায়, "যে ষড়যন্ত্র চলছে বাঙালিদের বিরুদ্ধে - কখনও সেটা আসামে এনআরসি-র মাধ্যমে, কখনও হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে, তখন যদি বাঙালিরা নিজেদের জাতিগত পরিচয়, ভাষাগত পরিচয়কে হাতিয়ার করে রুখে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে বাঙালিদের জন্য কঠিন সময় আসছে।"

তবে অধ্যাপক হকের সতর্কবার্তা, "নিজেদের মাতৃভাষা নিয়ে গর্বিত হয়ে প্রতিবাদে সামিল হওয়ার অর্থ কিন্তু এটা নয় যে অন্যের মাতৃভাষাকে অসম্মান করব।" বিশ্লেষক আর অ্যাক্টিভিস্টরা মনে করছেন সারা দেশের ওপরে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার পিছনে একটা নির্দিষ্ট রাজনীতি রয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর ভাবাদর্শ - যেখানে হিন্দি, হিন্দু ধর্ম আর হিন্দুরাষ্ট্র - এই তিনটি বিষয়কেই সমার্থক করে তুলে ধরার চেষ্টা হয়।

অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার বলছিলেন, "আমি কোনও একটা পদে আছি বলেই আমার দল যে ভাবাদর্শে বিশ্বাস করে, সেই অনুযায়ী কিছু বলে দিলাম, তা তো হয় না! গণতন্ত্র তাহলে কোথায় গেল?" "ওই ভাষাটিই যদি মূল ভাষা করার পরিকল্পনা হয়, তাহলে ভাষাবিদ, নাগরিক সমাজ - সকলের সঙ্গে কথা বলা হোক। সবাই যদি মনে করে সেটিকেই মূল ভারতীয় ভাষা করা হবে, তাহলে মেনে নিতেই হবে।"

হিন্দিকে দেশের মূল ভাষা হিসাবে তুলে ধরার যে পরিকল্পনার কথা বিজেপি সভাপতি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে দক্ষিণ আর পশ্চিম ভারতেও। দক্ষিণ ভারতে তার দলের নেতা-মন্ত্রীরাও বিজেপি সভাপতির এই বক্তব্যের ফলে অস্বস্তিতে পড়েছেন। তাদেরও বলতে হচ্ছে যে হিন্দি নয় - ওইসব রাজ্যগুলির নিজস্ব ভাষাই মূল ভাষা থাকবে, যেমনটা এখন আছে। বিবিসি