ইসলামে শিশু শিক্ষার গুরুত্ব

ইসলামে শিশু শিক্ষার গুরুত্ব

ছবিঃ সংগৃহীত।

‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’-প্রবাদটি কারো অজানা নয়। আর জানা থাকবেই না কেন? এটিই তো ধরার চিরাচরিত নিয়ম। কারণ নশ্বর এই পৃথিবীতে কেউ চিরস্থায়ী নয়। আসা-যাওয়ার ধারাবাহিকতা তো জারি আছে। আজ যারা বয়োজ্যেষ্ঠ আগামী দিনে তারা এই ধরা ত্যাগ করবে, আজ যারা শিশু-কিশোর তারা ওদের স্থলাভিষিক্ত হবে এটিই বাস্তবতা। অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আর অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো মানুষ যত যাই হোক না কেন শৈশবের একটি প্রভাব তার মধ্যে থাকেই। শৈশবে-কৈশোরে ভদ্র-সভ্য ছেলেটি যৌবনে বখে যায় না সাধারণত।

আবার সমাজের উচ্ছৃঙ্খলদের হিস্ট্রি খুঁজলে দেখা যায়, তারা শিশুকালে উপযুক্ত শিক্ষা পায়নি। তাদের শৈশব কেটেছে বিশৃঙ্খলার ভেতরে। এর প্রভাব পরবর্তী জীবনে পড়েছে। এ কারণেই ইসলাম শিশু-শিক্ষার উপর অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কারো শৈশব যেন অনুপযোগী পরিবেশে না কাটে তার ওপর বিশেষভাবে খেয়াল রাখার নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। পরিবার হলো সব শিশুর প্রথম বিদ্যালয়। এর প্রধান টিচার হলো তার মা। শিশুরা মায়ের কাছ থেকে জীবনের অনেক পাঠ গ্রহণ করে থাকে। তাই শিশুর উপযুক্ত মা নির্বাচনে বাবাদের প্রতি বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। যেগুলো পরিপূর্ণভাবে পালন করতে পারলে শিশুর শৈশবটা রঙিন হওয়া অনেক সহজ হয় এবং বাকি জীবন সুশৃঙ্খলভাবে কাটে।
যে ছেলেটি দ্বীনী পরিবেশে বড় হয়, যার শৈশব কাটে আমলি পরিবেশে সে অটোমেটিক্যালি অনেক আমল শিখে যায়। ছোটবেলায় যারা কিছু দ্বীনী শিক্ষা পায় বড় হয়ে তাদের মধ্যে সেটার আছর বাকি থাকে। আপনি হয়তো কখনো কোনো হাফেজে কুরআনের সুললিত কণ্ঠের তিলাওয়াত শুনে থাকবেন তার প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ আপনাকে বিমোহিত করবে। কিন্তু আপনি কি জানেন তার পক্ষে এই সুন্দর তিলাওয়াত করা কিভাবে সম্ভব হয়েছে? কারণ সে ছোটবেলায় কুরআন পড়েছে। আর ছোট অবস্থায় কুরআন পড়লে তার টোন-উচ্চারণ যত সুন্দর হয় বয়স বাড়ার পর পড়লে তা হয় না।
তা ছাড়া যারা ছোটবেলা থেকে দ্বীনী শিক্ষা পায় তারা সাধারণত পরবর্তী জীবনে অনৈতিক কর্মে জড়ায় না। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি, যেনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ-ইভটিজিং, সুদ-ঘুষ খাওয়া ইত্যাদি কার্যকলাপ তাদের থেকে প্রকাশ পায় না; বরং তারা সর্বদা এর বিপরীত অবস্থানে থাকে।
এ জন্য নবীজী সা: শিশু-শিক্ষার উপর খুব গুরুত্ব দিতেন। বদর যুদ্ধ বন্দীদের মধ্যে যারা মুক্তিপণ দিতে অক্ষম কিন্তু লিখতে জানত তাদের মুক্তিপণ নির্ধারিত হয় ১০ জন শিশুকে হাতের লেখা শেখাবে। তিনি নিজেও স্নেহের সাথে ছোটদেরকে আদব শিখাতেন। একবার নবীজীর খাবারের সাথী হয়েছিল ওমর বিন আবি সালামা রা:। ছোট্ট ওমর খাবারের প্লেটের দিকে বাম হাত বাড়ালে নবীজী সা: সংশোধন করে দিয়ে বলেন, ‘হে বৎস! ডান হাত দিয়ে তোমার সামনে থেকে খাও।’ (তিরমিজি শরিফ-১৮৫৭)
নবীজী সা:-এর কাছ থেকে এই আমল তার সাহাবিরা গ্রহণ করেন। তারা তাদের সন্তানদের আদব-কায়দা শেখানোর ব্যাপারে খুব যতœশীল ছিলেন। সালাফদের মধ্যে এই আমল পরিলক্ষিত হয়। নবীপৌত্র হজরত হাসান ইবনে আলী রা: থেকে বর্ণিত- তিনি স্বীয় সন্তান ও ভাজাদের একত্রিত করে বলতেন, ‘হে বৎসরা! আজ তোমরা ছোট কিন্তু অচিরেই তোমরা বড় হবে তাই ইলম শিক্ষা করো। আর যারা স্মরণ রাখতে পারে না তারা লিখে রাখো।’ (সুনানে দারেমি : ১/১০৯)
বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দল্লাহ ইবনে মুবারক রহিমাহুল্লাহ যখন ছোট কাউকে দেখতেন কলম-কালি হাতে হাদিস লিখতে এসেছে, তাকে কাছে ডেকে নিতেন এবং বলতেন, ‘এরা দ্বীনের চারাগাছ’।
এত ছিল তাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে ও শিশুদের দ্বীনী শিক্ষার উপর খুব গুরুত্ব আরোপ করা হতো। মুসলমানরা শিশুশিক্ষায় যতটা গুরুত্ব দিয়েছে অন্য কোনো ধর্মের লোকেরা ততটা গুরুত্ব দেয়নি। শিশুদের পড়ানোর জন্য মহল্লায় মহল্লায় চালু ছিল সাবাহি মক্তব। সেখানে তাদের দিনের জরুরি মাসলা-মাসায়েল শিক্ষা দেয়া হতো।

আবহমানকাল থেকে এটি ছিল মুসলিমদের ঐতিহ্য। প্রতিটি মুসলিম এলাকায় এর প্রচলন ছিল। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে মক্তবে যেত। বর্তমানে এমন দৃশ্য বিরল। কালের বিবর্তনে এটি আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে। বলা যায়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমাদের থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। এর বিপরীতে চালু করা হয়েছে কিন্ডার গার্টেন স্কুল। যে শিশুগুলো সকালে মক্তবে যাওয়ার কথা ঘুম থেকে উঠে কিন্ডার গার্টেনের পথ ধরে। যেখানে তাদের ধর্মের কোনো শিক্ষাই দেয়া হয় না। যদিও এর বিপরীতে বর্তমানে কিছু কিন্ডার গার্টেন মাদরাসা দেখা যাচ্ছে তবে অধিকাংশ শিশু দ্বীনী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তা ছাড়া আমাদের জাতীয় শিক্ষা সিলেবাসে ধর্মশিক্ষা উপেক্ষিত। আমরা যদি জাতির অগ্রগতি, উন্নতি, শৃঙ্খলা চাই অবশ্যই আমাদের শিশুদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট, গবেষক