ডাকসু নির্বাচন ২০২৫: “কালো যাদু” নাকি “রাজনীতির স্বরূপে প্রত্যাবর্তন”?
সংগৃহিত ছবি।
এক সময়ের রাজনীতির সূতিকাগার “ডাকসু” কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছিল। ২৪ এর ছাত্র-জনতা বিপ্লব পুনরায় জাতিকে প্রকৃত রাজনীতির মঞ্চে নিয়ে এসেছে। দীর্ঘ দিন যে রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ অনেকটা নিষ্প্রভ ছিল হঠাৎ করে যেন তাদের হৃদয়ে বহ্নি শিখা জ্বলে ওঠে। গত এক বছর আগে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ও তার জোট রাজনীতির মাঠ থেকে হারিয়ে গেলেও বছর না ঘুরতেই ক্রমে সুড়ঙ্গের ওপাশে মোমের আলোর মতো ইতিবাচক উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু দলের কাণ্ডারী থেকে শুরু করে মাঝি মাল্লারা যেভাবে রাজনীতিতে আগমনের বার্তা দিচ্ছে তাতে তৃণমূল সমর্থক বা কর্মীরা মোটেও আশ্বস্ত হতে পারছে না। মাঝে মাঝে শহর-নগরে চোরা গুপ্তা মিছিল হলেও স্থায়িত্ব একেবারে কম। তবে গত কয়েক মাস পূর্বেও কেউ কল্পনা করেনি পতিত সরকার এতো তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে।
কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম এতটাই কাঁচা যে জনগণ যে বিশ্বাস নিয়ে তাদেরকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিল তারা সে আশা পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে অন্তর্বতী সরকার যে রণ হুঙ্কার দিয়ে সংবিধান সংশোধন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সহ বিভিন্ন বিষয়ে পরিবর্তনের আশা নিয়ে মাঠে নেমেছিল সে ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলগুলোর মত বিরোধের কারণে মুখ থুবরে পড়েছে।
এদিকে কিছু রাজনৈতিক দলের দাবীর মুখে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচনের দিন ক্ষণ ঘোষণা করেছেন। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনও একটা নির্বাচনী রোড ম্যাপ ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল কিছু শর্ত পূরণ না হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না বলে হুমকি দিলেও বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী ইতিমধ্যে ৩০০ আসনেই তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করে নির্বাচনী প্রচারে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে বলে দৃশ্যমান। তবে হতাশার বিষয় হলো যারা দ্রুত নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপে রেখেছে সে সকল রাজনৈতিক দলগুলোর গতি প্রকৃতি এখনো ধোঁয়াশার মধ্যেই রয়েছে। রাজনৈতিক মত বিরোধ, দলীয় বিভেদ, চাঁদাবাজি, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগে ইতিমধ্যে ৪০০০ নেতা কর্মী বহিষ্কার করেও নীতি-নৈতিকতাহীন নেতা কর্মীদের কর্মকাণ্ড বন্ধ করা বিএনপির পক্ষে অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এদিকে ছাত্র রাজনীতিকে গতিশীল করতে ও রাজনৈতিক চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে ইতিমধ্যে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। গতকাল ৯ সেপ্টেম্বর রাজনীতির আতুরঘর বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে এতদিন অধিকাংশ সাধারন মানুষের যে সমীকরণ ছিল নির্বাচনের ফলাফল ঘোষনার পর ছাত্র রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক নজীর স্থাপিত হয়েছে। যেখানে বিএনপি'র ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নিরঙ্কুশ নিশ্চিত বিজয় প্রত্যাশা করেছিল তা ভুল প্রমান করে বিপুল ভোটে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের নিরঙ্কুশ বিজয় গাঁথা রাজনীতিবিদদের কপালে নতুন করে দুশ্চিন্তার ভাঁজ একে দিয়েছে।
তবে এটা ঠিক বিগত কয়েক দশক রাজনীতি তার নিজস্ব গতি পথ থেকে রাজনীতিবিদদের কারণে বিচ্যুত হয়েছিল বটে তবে ডাকসু নির্বাচন প্রমান করেছে রাজনীতি পুনরায় স্বরূপে আভির্ভূত হয়েছে। এটা প্রমাণিত সত্য যে, রাজনীতির মাঠে যারা নিয়ামক শক্তি তারা হলেন জনগণ বা ভোটার। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক নেতারা শুধুমাত্র দলের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল থেকে নিজের গ্রহনযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা, সাধারণ মানুষের হৃদয়ে তাদের অবস্থান তারা কখনো যাচাই করেন না। ফলে নির্বাচনের ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। ছাত্রদল মনে করেছিল ছাত্রলীগ যেহেতু নেই সেহেতু তারাই একমাত্র ছাত্র সংগঠন যে, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করছে। তবে দলীয় কর্মকাণ্ডে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত না করে শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে যে ইতিবাচক ফলাফল আশা করা যায় না অথবা রাজনীতিতে সব অনুমান যে সঠিক প্রমান করা দুরূহ বিষয় এটা ভাবার সময় এসেছে।
নির্বাচনের পর বিএনপি সিনিয়র নেতারা এখন কালো যাদুকে দোষারোপ করছেন। দলের সিনিয়র ও অভিজ্ঞ ছাত্রনেতা ড. আসাদুজ্জামান রিপন ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করে বলেছেন "আওয়ামী লীগ শিবিরের পক্ষ নিয়ে ডাকসু নির্বাচনে সহযোগিতা করেছে।" ভালো কথা আপনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি রাজনৈতিক দল হয়েও কেনো ভোটারদের আস্থাভাজন হতে পারেননি এ প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। এখন রাজনীতিতে কালো যাদুর প্রভাব না খুঁজে দলের ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করলেই প্রকৃত সমাধান সম্ভব। তবে সুশীল সমাজ মনে করেন, ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে “রাজনীতি স্বরূপে প্রত্যাবর্তন করেছে।” আগামীকাল ১১ সেপ্টেম্বর জাকসু নির্বাচন সুতরাং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করবো রাজনীতির কালো যাদু না খুঁজে ডাকসু'র ব্যর্থতা কাজে লাগান, হয়তোবা সফলতা পেলেও পেতে পারেন।
মীর্জা বাহাদুর
বিশিষ্ট কলামিস্ট ও
রাজনৈতিক বিশ্লেষক।