৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে: আইসিএমএবি

৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে: আইসিএমএবি

৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে: আইসিএমএবি-

অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে এখন ধার করে হলেও যেখানে দেশীয় পণ্য এবং সেবা ব্যবহৃত হয় ওই সব খাতে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। মানুষের জীবন ও জীবিকাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলছেন ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) নেতারা। তারা বলেন, যতদিন কোভিড-১৯ মহামারী দেশে থাকবে, তত দিন উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ বাড়বে না। একই সাথে বাড়বে না কর্মসংস্থান। কাজেই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের পরিকল্পনা মাফিক ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে যেকোনো মূল্যে টিকার আওতায় আনতে হবে। এমএফএস সেবা ব্যবহারকারীদের মধ্যে নিম্নবিত্তের মানুষই বেশি। ফলে এই করভার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনে বাধা হয়ে যাবে। তাই এই খাতে করহার প্রত্যাহার করতে হবে।

প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রতিক্রিয়ায় আইসিএমএবি এই দাবি জানায়। রোববার রাতে রহুল কুদ্দুস অডিটোরিয়ামে আইসিএমএবির প্রেসিডেন্ট আবু বকর ছিদ্দিকের সভাপতিত্বে ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মো: মামুনুর রশিদের সঞ্চালনায় এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট (২য়) মো: মনিরুল ইসলাম, সচিব কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন এবং কোষাধ্যক্ষ এ কে এম কামরুজ্জামান সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। বাজেটের ওপর পেপার উপস্থাপন করেন ফেলো সদস্য মো: শফিকুল আলম।

প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আইসিএমএবির পর্যালোচনা হলো, ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ বিষয়কে প্রতিপাদ্য হিসেবে সামনে রেখে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার একটি সময়োপযোগী বাজেট সংসদে পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.২ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজেট ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে বাস্তবায়ন সক্ষমতা সাপেক্ষে ঘাটতি বাজেটকে আইসিএমএবি ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছে।

সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয় করোনাভাইরাস নির্মূল করাটাকে এক নম্বর চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীতে সাধারণ ছুটি, লকডাউন, উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক কার্যক্রম বিভিন্ন সময় বন্ধ থাকার কারণে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনাপূর্বক সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ অপ্রতুল হওয়ায় এ খাতে আরো বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। আইএমএবির মতে, দেশের বিদ্যমান ভ্যাট আইন এবং আয়কর আইনে এখনো সামান্য কিছুটা সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া অগ্রিম করের ক্ষেত্রেও কিছুটা যৌক্তিকীকরণের প্রয়োজন রয়েছে।

আইসিএমএবি বলছে, বর্তমানে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ওপর কর হার (এমএফএস) বৃদ্ধি করা হয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এমএফএস কোম্পানিগুলোর করহার ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত হলে ৪০ শতাংশ করপ্রস্তাব করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো এমএফএস প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়ায় সব এমএফএস প্রতিষ্ঠানকেই ৪০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। এমএফএস সেবা ব্যবহারকারীদের মধ্যে নি¤œবিত্তের মানুষই বেশি। ফলে এই করভার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনে বাধা হয়ে যাবে। যা সামগ্রিক ডিজিটালাইজেশনের জন্যই একটি নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। তাই চলমান কোভিডের সময়ে গ্রাহককে আরো বেশি এমএফএস সেবার প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে কর বৃদ্ধি এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। যাতে ক্যাশলেস সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়।

তাদের মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এক ব্যক্তি কোম্পানির করহার হ্রাস করে ২৫ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে, যা যৌক্তিক হয়েছে। আর বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ২৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির করহার সাড়ে ৩২ শতাংশ থেকে আড়াই শতাংশ হ্রাস করে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে; যা অভিনন্দনযোগ্য। তবে নতুন প্রস্তাবনায় সরবরাহ পর্যায়ে উৎস কর কর্তনের (যা ন্যূনতম কর হিসেবে বিবেচিত হয়) হার সর্বাধিক ৫ থেকে ৭ শতাংশে উন্নীত করার কারণে প্রকৃতকর আয়তন বৃদ্ধি তথা করহার বিগত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে। প্রকৃত ব্যবসাবান্ধব কর বাস্তবায়ন বিবেচনায় এর যৌক্তিকীকরণ খুব বেশি প্রয়োজন।

তারা বলছেন, বাজেটে ক্লাউড সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-বুক প্রকাশনা, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস এবং আইটি ফ্রিল্যান্সিং সরবরাহকারীদের ২০২৪ সাল পর্যন্ত কর ছাড়ের সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে ডিজিটাল রূপান্তর প্রক্রিয়ার গতি বাড়বে এবং ডিজিটাল সেবা সহজ ও কম খরচে সব শ্রেণীর নাগরিকদের কাছে পৌঁছবে; যা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আইসিএমএবি মনে করে। মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অটোমোবাইল-থ্রি হুইলার এবং ফোর হুইলার উৎপাদনকারী কোম্পানিকে শর্ত সাপেক্ষে ১০-২০ বছর মেয়াদে কর অব্যাহতি প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া কিছু হোম অ্যাপ্লায়েন্সেস ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্সেস পণ্য এবং হালকা প্রকৌশল শিল্প পণ্যের উৎপাদনকারী কোম্পানিকে শর্ত সাপেক্ষে ১০ বছর মেয়াদি কর অব্যাহতি প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে, দেশে শিল্পের বিকাশ এবং আমদানি বিকল্প শিল্পোৎপাদন ত্বরান্বিত হবে।

তারা বলছেন, শিল্পায়নের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে সংশ্লিষ্ট খাতে এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে ১০ বছর মেয়াদে কর অব্যাহতি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী থাকলেও শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ মানবসম্পদের অভাব রয়েছে। তাই এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলে। বৃহৎ শহরগুলোর বাইরে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার লক্ষ্যে শিশু ও নবজাতক, নারী ও মাতৃস্বাস্থ্য, আনকোলজি, ওয়েলবিং ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন ইউনিট থাকা সাপেক্ষে ন্যূনতম ২৫০ শয্যার সাধারণ হাসপাতাল ও ন্যূনতম ২০০ শয্যার বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপিত হলে শর্ত সাপেক্ষে ১০ বছরের জন্য কর অব্যাহতির প্রস্তাব সাধুবাদযোগ্য। তবে, ২০০-২৫০ শয্যা সংখ্যাটি যৌক্তিক পর্যায়ে হ্রাস করা প্রয়োজন।

তাদের বিশ্লেষণ, বাংলাদেশের বাইরে সেবা রফতানির ক্ষেত্রে মূসক শূন্যহার বিষয়টি স্পষ্টিকরণের লক্ষ্যে মূল্য সংযোজন কর আইনের অস্পষ্টতা দূর করা হয়েছে। পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে আমদানিকৃত উপকরণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আগাম কর ৪ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে হ্রাস করা হয়েছে। যার ফলে উৎপাদনকারী চলতি মূলধনের প্রয়োজনীয়তা সমহারে হ্রাস পাবে। ভ্যাট ফাঁকি, ব্যর্থতা বা অনিয়মের প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দ্বিগুণ জরিমানার পরিবর্তে সমপরিমাণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে; যা মূসক আইন ১৯৯১-এর সংশ্লিষ্ট বিধান পর্যালোচনা করলেও প্রস্তাবিত হারটি বেশি হয়। তাই ইহা আরো যৌক্তিক পর্যায়ে আনয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের জন্য বকেয়া বা অনাদায়ী মূসকের ওপর মাসিক জরিমানা ২ শতাংশের পরিবর্তে ১ শতাংশ করা হয়েছে, যা বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। প্রচ্ছন্ন রফতানি এবং পশ্চাদ সংযোগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানবিষয়ক নতুন বিধান সংযোজন একটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ।

এ ছাড়া কস্ট অব গুডস সোল্ড স্টেটমেন্ট যদি কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টদের মাধ্যমে অডিট করা যায় তবে কস্ট ইফিসিয়েন্সি বাড়বে, খরচ কমবে এতে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা যাবে বলে মনে করে আইসিএমএবি।