জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্বের হাত বদল সেবার মান কতটা নিশ্চিত করবে

জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্বের হাত বদল সেবার মান কতটা নিশ্চিত করবে

জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্বের হাত বদল সেবার মান কতটা নিশ্চিত করবে

বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের একজন সদস্য জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রমের দায়িত্ব কমিশনের কাছে রাখার জন্য আবারও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এই দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়া না দেয়ার প্রশ্নে এখন সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের মধ্যে চিঠি চালাচালি চলছে।সরকার চাইছে দায়িত্ব বদল করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দিতে।কিন্তু নির্বাচন পর্যবেক্ষক বা বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেছেন, দায়িত্বের হাতবদল হলেই জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনে যথাযথ ব্যবস্থাপনা বা সেবার মান নিশ্চিত করা সম্ভব কিনা-এমন প্রশ্ন তাদের রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে পাসপোর্ট সেবা কার্যক্রম। এখন এই মন্ত্রণালয়কে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রমের দায়িত্বটিও সরকার দিতে চাইছে। এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিলেও নির্বাচন কমিশনের আপত্তির মুখে বিষয়টি নিয়ে এখন কথাবার্তা চলছে।যদিও পাসপোর্ট দেয়ার কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতে বিভিন্ন সময় কর্তৃপক্ষ নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলে থাকে, কিন্তু মানুষের ভোগান্তি বা হয়রানির নানা অভিযোগ থাকে।

উত্তরের একটি জেলা থেকে একজন যুবক জানিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যে কাজের জন্য যেতে পাসপোর্ট করতে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছে। দালাল তার কাছে প্রথমে আট হাজার টাকা নিয়েছিল। এরপর দালাল তার পাসপোর্ট তুলে নিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করেছিল।

ঐ যুবক বাধ্য হয়ে দরকষাকষি করে টাকার অংক কিছুটা কমিয়ে সেই টাকা দিয়ে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। তিনি তার নাম পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।ঢাকায় একজন শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করতে গিয়ে ভিন্ন ধরনের এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন।

"আমি যখন পাসপোর্টের জন্য অফিসে গেছি, সে সময় আমার বয়স আঠারোর কয়েকদিন বেশি হয়েছে। তখন তারা বলে যে, তোমার বয়স আঠারোর বেশি হওয়ায় পাসপোর্টের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে। তারপর একজন দালাল সেখানে এসে বললো যে, আপনি কি পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে চান? আমি তাকে এড়িয়ে গেলাম," বলেন মি: হাসান।

তিনি আরও বলেছেন, "পরে জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যাপারে খোঁজখবর করে দেখলাম যে এটা বিশাল একটা প্রক্রিয়া। মানে আমাকে এলাকায় গিয়ে একমাস ধরে সব কাগজপত্র যোগাড় করতে হলো। তারপর সেই কাগজপত্র জমা দিলাম।"অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় জাতীয় পরিচয়পত্রের কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময় মানুষের ভোগান্তির নানা অভিযোগ উঠেছে।নাম, পরিচয় এবং জন্ম তারিখে ভুলের অনেক অভিযোগ রয়েছে।

জীবিত মানুষকে মৃত বানিয়ে দেয়ার অভিযোগ নিয়েও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। এমনই একজন ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তিনি কাগজপত্র নিয়ে নিজেকে জীবিত প্রমাণের চেষ্টায় রয়েছেন।তিনি বলেন, "আমি ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে উনারা আমার জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে বললো যে, এটা আপনার নকল কার্ড।

"তখন আমি এলাকার নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে গেলাম। উনারা বললো যে আমাকে মৃত দেখানো হয়েছে। তো আমি বললাম, আমিতো জীবিত, আমাকে কীভাবে মৃত দেখানো হলো। তখন আমি এটা সংশোধন করতে বললাম। তারা অনেক কাগজপত্র চাইলো। আমি তিন মাস ধরে ওদের পিছ পিছ ঘুরছি। আমার কাগজপত্র এখনও কমপ্লিট হয় নাই," বলেন ঐ ভুক্তভোগী ব্যক্তি।পাসপোর্ট এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের সেবা নিয়ে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি'র গবেষণা রয়েছে।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার পেছনে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতার অভাব অন্যতম কারণ। কিন্তু পাসপোর্ট সেবার ক্ষেত্রে দালালচক্র এবং দুর্নীতির বিষয় তারা গবেষণায় পেয়েছেন। তিনি এই পরিস্থিতিকে উভয় সংকট হিসাবে উল্লেখ করেন।"এই প্রশ্নটা উত্থাপিত হওয়া যৌক্তিক যে জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব বদল হলে মানুষের সেবার মানের ক্ষেত্রে এটা কতখানি যথার্থ হবে," বলেন ইফতেখারুজ্জামান।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন সংগঠনও বলছে, দায়িত্বে হাত বদল করলেই সমস্যাগুলোর সমাধান যে সম্ভব হবে, সে ব্যাপারে তাদের সন্দেহ রয়েছে।তবে সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্ব বদলের সিদ্ধাান্তের কারণ সম্পর্কে সেভাবে কিছু বলা হয়নি।অন্যান্য দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে এই দায়িত্ব থাকার বিষয়কে যুক্তি হিসাবে তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছেন কয়েকজন মন্ত্রী।

২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরির অংশ হিসাবে প্রথমে ভোটার পরিচয়পত্র তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল।সেই প্রক্রিয়াতেই ভোটার পরিচয়পত্রের বদলে জাতীয় পরিচয়পত্র করা হয়।

তখন সেনাবাহিনীর সহায়তায় নির্বাচন কমিশন ডাটাবেজ তৈরি করে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েছিল।আর সে সময় থেকেই কমিশন সারাদেশে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের দিয়ে এই কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।বর্তমানে ১১ কোটি ১৭ লাখের বেশি নাগরিক ভোটার তালিকাভুক্ত রয়েছে।২০১০ সালে আইন প্রণয়ন করে কমিশনকে আইনগতভাবেও এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে সেই দায়িত্ব দেয়ার আপত্তি জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

একজন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম তাদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি তুরে ধরে বলেছেন, "একই জনবল, একই যন্ত্রপাতি, একই ডাটাবেজ-সার্ভার দিয়ে ভোটার তালিকার সঙ্গেই জাতীয় পরিচয়পত্র করা হয়েছে।"

"আমাদেরতো জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য আলাদা জনবল বা অবকাঠামো নাই। আলাদা সার্ভারও নাই। সার্ভারে যে ডাটাবেজ, সেটা ভোটার তালিকার। আর সারাদেশে নির্বাচন কর্মকর্তারাই এই কাজ করছে। সেটাই আমরা বলতে চাইছি," বলেন কবিতা খানম।গত মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশন তাদের অবস্থান তুলে ধরে মন্ত্রী পরিষদ সচিবের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে।

এর আগে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ এই কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে।এক যুগের বেশি সময় ধরে জাতীয় পরিচয়পত্রের কার্যক্রম পরিচালনার বিষয় নির্বাচন কমিশন তাদের চিঠিতে তুলে ধরেছে।

চিঠিতে যুক্তি দিতে গিয়ে কমিশন বলেছে, বাংলাদেশের সংবিধানে অন্য কোন মন্ত্রণালয় বা সংস্থাকে এ ধরনের ক্ষমতা দেয়া হয়নি। ফলে আইনগত জটিলতা হতে পারে।

এছাড়া কমিশন বলেছে, জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব অন্য কোন মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হলে মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি সংগ্রহ করতে হবে। সেজন্য অনেক সময় এবং অর্থের প্রয়োজন হবে।এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, জনগণের ভোগান্তি কমাতে সরকার জাতীয় পরিচয়পত্রের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন তা বাস্তবায়ন করা হবে।

সূত্র : বিবিসি