বিবাদে মীমাংসাই উত্তম

বিবাদে মীমাংসাই উত্তম

ক্যালিগ্রাফি : আরিফুর রহমান

আশরাফুল মাখলুকাতখ্যাত মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ জীবনে ঝগড়া-বিবাদ, ফিতনা-ফ্যাসাদের কারণে সমাজে পরচর্চা, পরনিন্দা, কুৎসা রটনা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, হিংসা-বিদ্বেষ, অপবাদ, মিথ্যা দোষারোপ প্রভৃতি নানা ধরনের নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অপ্রত্যাশিত নানাবিধ কর্মকাণ্ডে আশরাফুল মাখলুকাতখ্যাত মানুষ তখন ‘আতরাফুল মাখলুকাত’ অর্থাৎ নিকৃষ্ট প্রাণীর মতো হয়ে যায়। বিবাদের কারণে মানুষের পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও ব্যক্তিগত সৎকর্ম নষ্ট হয়ে যায়। সাধারণত পারস্পরিক গালিগালাজ, দ্বন্দ্ব-কলহ, অশ্লীল ও অশালীন কথাবার্তার মাধ্যমে বিবাদ শুরু হয়।

বিবাদ মীমাংসা না হলে শেষ পর্যন্ত মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনে। ঝগড়া, মারামারি, প্রাণহানির মতো জঘন্য কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়ে সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। বিবাদ কেবল সামাজিক সমস্যা নয় বরং এটি পারিবারিক সমস্যাও বটে। যেকোনো ধরনের বিবাদই হোক না কেন, মীমাংসার মাধ্যমে সমাধান করা উত্তম পন্থা। যেকোনো সঙ্ঘাতের সূচনাতেই যদি সেটাকে শেষ করে দেয়া যায় তবে তাতে সবারই কল্যাণ। পরিবার ও সমাজে শান্তি বজায় রাখার জন্য যেকোনো ধরনের মীমাংসা করা সবারই কর্তব্য।

সংসারে বিবাদ মীমাংসা : পারিবারিক বিবাদ মীমাংসায় মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা উভয়ের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের আশঙ্কা করো, তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন, স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক নির্ধারণ করো। যদি তারা উভয়ে মীমাংসার ইচ্ছা করে তবে আল্লাহ তাদের উভয়ের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সব কিছু অবহিত’ (সূরা নিসা, আয়াত-৩৫)।

আল্লাহপাক আরো বলেন, ‘কোনো নারী যদি তার স্বামীর পক্ষ থেকে দুর্ব্যবহার বা উপেক্ষার আশঙ্কা করে, তবে তারা পরস্পর মীমাংসা করে নিলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। আর আপস-নিষ্পত্তিই উত্তম...’ (সূরা নিসা, আয়াত-১২৮)।
সামাজিক বিবাদ মীমাংসা : মহান আল্লাহ পাক বলেন, মুমিনদের দুটি দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও।

অতঃপর তাদের একটি দল যদি অন্য দলের উপর বাড়াবাড়ি করে, তবে যে দল বাড়াবাড়ি করছে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না সে আল্লাহর হুকুমের দিকে ফিরে আসে। সুতরাং যদি ফিরে আসে তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মীমাংসা করে দাও এবং ইনসাফ করো। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালোবাসেন। মুমিনরা পরস্পর ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত : ৯-১০)।

বিবাদ মীমাংসায় পবিত্র হাদিসের নির্দেশনা : যেসব কর্মকাণ্ডে বিবাদের সূচনা হয়, ওইসব কর্মকাণ্ডকে উপেক্ষা করে এসব থেকে দূরে থাকতে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমরা অন্যের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করবে না, গুপ্তচরবৃত্তি করবে না, পরস্পরের সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করবে না, পরস্পরের সাথে হিংসা-বিদ্বেষ করবে না, পরস্পরকে ঘৃণা করবে না এবং পরস্পরের ক্ষতি সাধন করার জন্য পেছনে লাগবে না। আর তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে যাবে’ (বুখারি ও মুসলিম)।

বিবাদ মীমাংসার ফজিলত বর্ণনায় রাসূল সা: বলেন, ‘সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করে না এমন সবাইকে মাফ করে দেয়া হয়। তবে ওই দুই ব্যক্তি ছাড়া যারা পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়, ‘পরস্পর মিলে যাওয়া পর্যন্ত এদের বিষয়টি মওকুফ রাখো (তিনবার), (মুসলিম, হাদিস-২৫৬৫)।
রাসূল সা: আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি ন্যায়ের ওপর থাকা সত্ত্বেও বিবাদ পরিহার করে, তার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি ঘর তৈরি করা হবে’ (তিরমিজি, হাদিস-১৯৯৩)।

বিবাদকারীদের বিবাদের কারণ উপলব্ধি ও উদঘাটন করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়া অনেক বড় ফজিলতের বিষয়। রাসূল সা: বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের রোজা, নামাজ ও সদকা থেকেও উত্তম বিষয় সম্পর্কে বলব না? সাহাবিরা বললেন, আল্লাহর রাসূল! অবশ্যই বলুন। তিনি বলেন, ‘বিবাদরতদের মধ্যে মীমাংসা করা। আর জেনে রেখো, পরস্পর বিবাদই মানুষের দ্বীন মুড়িয়ে দেয়’ (তিরমিজি, হাদিস-২৫০৯)।

হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘মানুষের প্রতিটি হাতের জোড়ার জন্য তার উপর সাদকাহ রয়েছে। সূর্য উঠে এমন প্রত্যেক দিন মানুষের মধ্যে সুবিচার করাও সাদকাহ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস-২৭০৭)।
বিবাদ মীমাংসাকারী ব্যক্তির মীমাংসা কৌশল প্রসঙ্গে হজরত উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি- ‘যে ব্যক্তি লোকদের মধ্যে সংশোধন করার চেষ্টা করে সে মিথ্যাবাদী নয়।

সে (যা বলেছে) ভালো বলেছে অথবা ভালো কাজের অগ্রগতি ঘটিয়েছে’ (জামে তিরমিজি, হাদিস-১৯৩৮)। বিবাদ মীমাংসার উপকারিতা : সমাজ ও পরিবারে বিদ্যমান বিবাদ মীমাংসার ফলে পরিবার ও সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা, সুখ-সমৃদ্ধি, ঐক্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের নিদর্শনস্বরূপ মানুষের পরস্পরের মধ্যে স্নেহ-মায়া-মমতা, শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি, ধৈর্য-সহনশীলতা, সততা, বিশ্বস্ততা, সংবেদনশীলতা প্রভৃতি মানবিক গুণাবলি গড়ে উঠে।

পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার ফলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও সহাবস্থানে মন থেকে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা ও হৃদয়হীনতার পাশবিক বৈশিষ্ট্য দূর হয়ে যায়। পারিবারিক জীবনে বিবাদ নিরসনের ফলে অনাবিল সুখ-শান্তি বিরাজ করে, পারিবারিক জীবন তখন স্বর্গীয় সুখের মতো মনে হয়।মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে বিবাদ মীমাংসার ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, নোয়াখালী