মন্দ মন্তব্য একটি মারাত্মক ভাইরাস

মন্দ মন্তব্য একটি মারাত্মক ভাইরাস

মন্দ মন্তব্য একটি মারাত্মক ভাইরাস

সাধারণত মানুষের জবানে যে কথাটা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় তা হলো ‘মিথ্যা’। এরপরই যার স্থান জবানে নিয়েছে তা হলো ‘মন্তব্য’। ‘মন্তব্য’ এমন একটা বিষয় যার মধ্যে আমরা প্রতিনিয়ত কমবেশি লিপ্ত থাকি, হোক ভালো কিংবা মন্দ। বর্তমান সময় এটা এমন এক মারাত্মক ভাইরাসে রূপ নিয়েছে যে ভাইরাসে সবাই কমবেশি আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। সাধারণ থেকে বিজ্ঞ, নিম্ন শ্রেণী থেকে উচ্চ শ্রেণী এবং এমনকি কিছু কিছু আলেম পর্যন্তও এই ভাইরাসে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। কৃষিক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, সংসদ ভবন ইত্যাদি সর্বপ্রকার স্তরে ভালো-মন্দ মন্তব্যের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত, মন্দই বেশি প্রচলিত।

পরস্পরের প্রতি প্রশংসা ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিকে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত পরস্পরের সুসম্পর্ক বজায় থাকে। যখনই সম্পর্কের মধ্যে বিঘ্ন ঘটে তখনই শুরু হয় মন্দ মন্তব্যের ইতিহাস। শুধু কী তাই? আমাদের কাছের মানুষগুলো যখন কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে শেয়ার করে তখনো আমরা সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই তার কথার সাথে সহমতসূচক মন্তব্য পেশ করি।
মিডিয়ার জগতে সবচেয়ে বেশি এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে প্রতিনিয়ত এর প্রবল ঝড় বয়ে চলছে।

বিশেষ করে ফেসবুকে এর মাত্রা প্রচণ্ড ভয়াবহ। কেউ যদি একটা তথ্য পাবলিশ করে আর আমরা তাতে লাইক, রিয়েক্ট, হ্যাঁ হ্যাঁ এবং কমেন্টের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ি। এমনকি বাজে ধরনের কথাবার্তার নোঙরা জলেও ডুবে থাকি।একজন মুসলিমের কাজ এমন হওয়া চাই যার আচরণে ইসলামের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। কিন্তু, আমরা কি তাতে সফল হতে পেরেছি? মোটেও না। যখন কেউ অন্যের ব্যাপারে মন্দ বলেন এবং অন্যের গিবত করেন তখন তার কথার ওপর খারাপ মন্তব্যের মাধ্যমে সহমত দেয়ার পেছনে কয়েকটা জিনিস নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষী করে রাখি।

অপকৃষ্ট মন্তব্য করার মুহূর্তে প্রথম অপরাধের সাক্ষী হয় জিহ্বা; কেননা, তা দিয়ে বলা হয়। দ্বিতীয় সাক্ষী কর্ণ; কেননা তা দিয়ে ওই মন্দ মন্তব্যের কথা কিংবা প্রথম ব্যক্তির গিবতের কথা শ্রবণ করা হয়। তৃতীয় সাক্ষী সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে হাত; কেননা তা দিয়ে অসার মন্তব্য লেখার কাজ করা হয়। শুধু কী তাই? এর পাশাপাশি পরোক্ষভাবে নিজেদের অন্তর, মন-মানসিকতা এবং চিন্তাধারাও অপরাধের সাথে শামিল হয়ে যায়; এগুলোর মাধ্যমেই সব ধরনের কাজ করার প্রয়াস পায়।এই জন্য আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না; কান, চোখ, হৃদয় এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৩৬)।

আসলে আমরা এই অপরাধের সাথে কিভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়ি? এর কারণ আমাদের কাছে যখন কোনো সংবাদ পৌঁছায় তখন আমরা তাতে সত্যতা যাচাই না করেই ওই সংবাদের ওপর অশ্লীল মন্তব্য করে বসি। পরিণাম জঘন্য অপরাধের শিকার। সংবাদটি হতে পারে কোনো ব্যক্তি ডেলিভারি করেছে কিংবা খবরের কাগজের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। অথবা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ইত্যাদি বিভিন্ন পদ্ধতিতে হতে পারে। চাই তা যেকোনো মাধ্যমে হোক না, সংবাদ পাওয়া মাত্রই তার সত্যতা যাচাই করা একজন মুমিনের অবশ্যই কর্তব্য। অন্যথায়, আমাদের মন্দ মন্তব্যের দরুন অপর ভাইয়ের ওপর জুলুম হয়ে পড়বে।

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! যদি কোনো ফাসিক তোমাদের কাছে কোনো বার্তা নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখো, এ আশঙ্কায় যে, অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হবে’ (সূরা হুজরাত, আয়াত-৬)।

যখন আমাদের মুখের অহেতুক ও অবাঞ্ছিত আচরণের ফলে কোনো ব্যক্তির পারসোনালিটিতে আঘাত হানে এবং যে বিষয়গুলো নিয়ে খারাপ মন্তব্যের বন্যা বয়ে দেই, তা যদি সত্য সত্যই ওই ব্যক্তির আচরণের সাথে সামঞ্জস্য না থাকে; তা নিজেদের ওপরই পতিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনোরূপ অন্তরায় সৃষ্টি হবে না।তাই আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের কষ্ট দেয় যা তারা করেনি তার জন্য; নিশ্চয় তারা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করল’ (সূরা আহজাব, আয়াত-৫৮)।

হাদিসে এসেছে আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত রাসূল সা: বলেছেন, প্রকৃত মুসলিম সেই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে সব মুসলিম নিরাপদ থাকে। আর প্রকৃত মুহাজির সেই, যে আল্লাহ যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন, তা ত্যাগ করে’ (বুখারি-১০, ৬৪৮৪, মুসলিম-৪০, নাসায়ি-৪৯৯৬, আবু দাউদ-২৪৮১, আহমদ-৬৪৫১, ৬৪৭৮, ৬৭১৪, ৬৭৫৩, ৬৭৬৭, ৬৭৭৪, ৬৭৯৬, দারেমি-২৭১৬)। সাধারণত আমরা মন্তব্য করার পেছনে অনেক প্রকার ভুল কারণ নিহিত থাকে। যেমন অনুমাননির্ভর ও সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে কথা বলা।

এমনকি হিংসার বসে ও শত্রুতামূলক কথা বলাও এই অপরাধের সাথে জড়িত হওয়ার অন্যতম কারণ। যখন ওই কারণগুলোর ওপর ভিত্তি করে কথা বলি তখন কিন্তু আমাদের কাছে কোনো সঠিক তথ্য জানা থাকে না, যে বিষয়ের উপর কথা বলি সে সম্পর্কে। ফলে অজান্তে নিজেদের কথাগুলো প্রকাশ করাটা খারাপ মন্তব্যে পরিণত হয়ে যায়।

ওই অপরাধগুলো শুধু নিজেদের জন্য অমঙ্গল তা নয়; বরং যার বিরুদ্ধে বলে থাকি তার জীবনেও সমস্যার জন্ম নেয়। উদাহরণস্বরূপ তার অনেক বিশ্বস্ত মানুষ তাকে ভুল বুঝে থাকে, তার প্রতি খারাপ ধারণার জন্ম নেয় এবং অপবাদের ফলে সে নিজেও অশান্তি ও অস্বস্তি ভোগ করে থাকে।মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না’ (সূরা হুজরাত, আয়াত-১১)।‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে দূরে থাকো; কারণ কোনো কোনো অনুমান পাপ’ (সূরা হুজরাত, আয়াত-১২)।

মনে রাখবেন, একজন মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দিলে শুধু সেই অপরাধী হিসেবে গণ্য হয় না; বরং ওই তথ্যের ওপর যে ব্যক্তিই সহমত প্রকাশ করবে সেও সমান অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে। অতএব, আমাদের উচিত যথাসম্ভব নিজেদের জবানকে সংযত রাখা এবং অশালীন ও অহেতুক মন্তব্য করা থেকে নিজেদের বিরত রাখা। সদা সর্বদা সত্যের সাথে থেকে সত্য কথা বলার চেষ্টা করাই হলো আমাদের কর্তব্য।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো এবং সঠিক কথা বলো’ (সূরা আহজাব, আয়াত-৭০)। মহান আল্লাহ যেন আমাদের এই জঘন্য পাপ থেকে হিফাজত করেন, আমীন।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ কওমি তরুণ লেখক ফোরাম