যে বাজারের বিক্রেতা সবাই নারী

যে বাজারের বিক্রেতা সবাই নারী

ছবি : সংগৃহীত

কৃষি প্রধান দেশ বাংলাদেশ। তবে একটা সময় সারা দেশে ধান চাষই ছিল প্রধান কৃষি। কিন্তু কালের বিবর্তনে ও সরকারের দেয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কারণে ধান, পাটের পাশাপাশি সব্জি চাষ করে লাভবান হচ্ছে দেশের কৃষক সমাজ। দেশের অন্য এলাকার তুলনায় পার্বত্য এলাকা ভিন্ন ধরনের। এক সময় যেখানে মুল ছিল জুম চাষ। এখন সেখানে অন্যান্য কৃষি পণ্যের পাশাপাশি সব্জি চাষ হচ্ছে অনেক বেশি। বিভিন্ন প্রকার সব্জি চাষের মূল কারিগর সেখানকার নারীরা।

বিভিন্ন সব্জি চাষ করে এখানে পরিবারের আর্থিক সমস্যা সমাধান করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা। সব্জি উৎপাদন থেকে বাজারে নিয়ে বিক্রি করা সবই করছেন নারীরা। সব্জি চাষে স্বাবলম্বী হওয়া পাহাড়ি নারীদের একজন মালতী চাকমা। ৪১ বছর বয়সী মালতী চাকমা তার নিজের জমিতে ফলানো সব্জি নিয়ে এসেছেন রাঙ্গামটি সদর উপজেলার কাঁচা বাজারে। আজ তিনি চার পদের সব্জি নিয়ে এসেছেন। এসব সব্জির মধ্যে আছে কাঁকরোল, করলা, কাঁচ কলা আর পাহাড়ী বেগুন।

শুধু মালতীই নন, আরো অনেক পাহাড়ী মহিলাই এই বাজারে এসেছেন যারা সব্জিসহ আরো নানা নিত্যপণ্য বিক্রী করছেন।

মালতী বলেন, ১০ বছর ধরে আমি বিভিন্ন বাজারে সব্জি বিক্রী করে আসছি। আমার স্বামী কৃষক। সে সারাদিন মাঠে থাকে। তিন ছেলে-মেয়ে আর শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী মিলে আমাদের সাতজনের পরিবার। আর তাই একজনের আয় দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। আমি আর শ্বাশুড়ী মিলে বাড়ি আঙ্গিনায় আর সামান্য জমিতে সারা বছর বিভিন্ন সব্জি চাষ করি। সেসব সব্জিই বাজারে নিয়ে আসি।

তিনি বলেন, এ কাজে আমার স্বামী মিল্টন চাকমাও আমাকে সহযোগীতা করে। কিন্তু বিক্রীর কাজটা আমিই করি।

মালতীর পাশেই আরো কয়েক রকমের স্বজি আর শুটকি মাছের পসরা সাজিয়ে বসেছেন জয়ন্তী মারমা। তার এসব সব্জির মধ্যে আছে থানকুনি পাতা, টক পাতা, কাঁকরোল, উস্তা, টমেটো আর ওল কচু। রয়েছে ছুড়ি শুটকী, ছোট চিংড়ি শুটকী আর সিঁদল।

জয়ন্তী বলেন, আমি শুধু এখানে নয় আরো দুটি গ্রাম্য বাজারে সব্জি বিক্রী করি। সেখানেও আরো অনেক নারী সব্জিসহ আরো নানা পদের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রী করেন।

মূলত পাহাড়ের গ্রাম্য বাজারগুলিতে পাহাড়ি নারীদের সবজি বিক্রেতার অবস্থান চোখে পড়ার মতো। দরিদ্র পরিবারের পাহাড়ি নারীরা পাহাড়ের দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন সবজি নিয়ে গ্রাম্য বাজারগুলোতে বিক্রী করে। এমনকি অনেক নারী আবার পথের পাশে বসেও তাদের সব্জি বিক্রী করেন। এদরও কেউ কেউ আবার স্থানীয় পাইকারী বাজার থেকে সব্জি কিনে গ্রাম্য বাজার বা রাস্তার পাশে বসে বিক্রী করেন। মূলত এসব পণ্য বিক্রীর অর্থ দিয়েই তাদের সংসার চলে। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন সবজি জাতীয় ফলমূল কিনে এনে বিক্রি করেন।

তেমনি একটি খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার সিঙ্গিনালা মহামুনি পাড়া গ্রামে বসে একটি ছোট্ট গ্রাম্য বাজার। এটি সিঙ্গিনালা বাজার নামেই সবার পরিচিত। এ বাজারে জুমে চাষ করা ফলমূল আর বন জঙ্গল থেকে আহরণ করে নিয়ে আসা টাটকা সবজি বিক্রি হয়। এ ছাড়া পাশে রয়েছে কাপ্তাই লেক। সেখান থেকে টাটকা ছোট বড় মাছ ধরে বিক্রি করে জেলেরা। তাই প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে সিঙ্গিনালা এসে ক্রেতারা ভীড় জমান।

এই বাজারে বিক্রেতাদের মধ্যে নারীরা সবচাইতে এগিয়ে। নারীরা কাঁচা তরকারী বিক্রি করেন। সারা বছরই এখানে পাওয়া যায় বন-জঙ্গল থেকে আহরিত নানান ফল আর শাক-সবজি। মূলত দরিদ্র নারীরা সংসারের টানাপড়েন কমাতে বুনো সবজি সংগ্রহ করে বাজারে নিয়ে আসেন বিক্রয়ের জন্য। আর এসব ভেজালমুক্ত সবজি কিনতে ক্রেতারাই প্রতিদিন সকাল-বিকাল এ বাজারে ভিড় জামান।
জুমে (পাহাড়ে সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করা জমি) উৎপাদিত ফলমূল এবং বন জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা অল্প অল্প করে হলেও নানান জাতের সবজি নিয়ে বিকেলে বিক্রি করতে চলে আসেন তারা। সব্জির মধ্যে বাঁশকুড়ল, তারাগাছ, কচুশাক, কচুলতি, কাঁচা-পাকা পেপে, থানকুনি পাতা থেকে শুরু করে কলার মোচাসহ রয়েছে বিভিন্ন টাটকা সব্জি।

চট্টগ্রাম শহর থেকে এই বাজারে সদাই করতে আসা ক্রেতা নাজমুল হাসান বলেন, আমি প্রায়ই সময় অফিসের কাজে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি আর বান্দরবানের বিভিন্ন অঞ্চলে যাই। আর ফেরার পথে এসব গ্রাম্য বাজার থেকে টাটকা সব্জি নিয়ে যাই। এসব সব্জির দাম কিন্তু একটু বেশি। তারপরও পাহাড়ী টাটকা সব্জি পাওয়া যায়। যার কারণে দাম সামান্য বেশি হলেও এসব সব্জিই নিয়ে যাই।

সিঙ্গিনালা বাজারের আরেক ক্রেতা মনমোহন মারমা বলেন, আমি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এখান থেকে বাজার করি। এখানে নারী বিক্রেতারা সবাই অনেক দূর-দূরান্ত থেকে সদাই নিয়ে আসেন। মূলত সবাই দরিদ্র্য পরিবারের। এই অর্থ দিয়েই তারা সংসার চালায়।

সূত্র : বাসস