গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনে কী হবে?

গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনে কী হবে?

গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনে কী হবে?

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে পহেলা নভেম্বর থেকে যে জলবায়ু সম্মেলন শুরু হচ্ছে তার সাফল্যের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টা কতটা কাজ করবে।

সম্মেলনে কী হয় তার ওপর আগামী দিনগুলোতে আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাপনে বড় রকমের পরিবর্তন আসতে পারে।

কপ২৬ কী? কেন এই সম্মেলন?
দীর্ঘ দিন ধরে ফসিল ফুয়েল বা কয়লা বা তেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে যে পরিমাণ ক্ষতিকারক গ্যাস পরিবেশে ছড়িয়েছে তার প্রভাবে পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়েই চলেছে। আর এর পরিণতিতে আবহাওয়া দিনকে দিন চরম ভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। তাপমাত্রা বাড়ছে, জঙ্গলে আগুন ধরছে, বন্যা এবং সাইক্লোনের প্রকোপ বাড়ছে।

গত দশকে পৃথিবীতে যে তাপমাত্রা ছিল তার নজির লিখিত রেকর্ডে নেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব হচ্ছে কারণ বিশ্বের জলবায়ু বদলে যাচ্ছে এবং এই পরিবর্তনের গতি ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশ্বের ২০০টি দেশকে বলা হচ্ছে পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ কমাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত তাদের কর্ম-পরিকল্পনা কী, তা গ্লাসগোর সম্মেলনে জানাতে।

২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে এসব দেশ রাজি হয় যে শিল্প-বিপ্লব পূর্ববর্তী যে তাপমাত্রা পৃথিবীর ছিল তার চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি বা বড়জোর ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যাতে না বাড়তে পারে, তা নিশ্চিত করতে সবাই চেষ্টা করবে। সব দেশই মেনে নেয় যে এটা না করতে পারলে পৃথিবী এবং মানব সভ্যতা মহা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

এই বোঝাপড়া প্যারিস চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে অঙ্গীকার করা হয় ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হবে।

কপ২৬ এর কী সিদ্ধান্ত হবে?
গ্লাসগোতে সম্মেলন শুরুর আগেই অধিকাংশ দেশই কার্বন নিঃসরণ কমাতে তাদের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলবে। ফলে আমরা আগেভাগেই জানতে পারবো প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে আমরা আদৌ রয়েছি কিনা।

কিন্তু দু সপ্তাহ ধরে চলা সম্মেলনের সময় আমরা নতুন কিছু প্রতিশ্রুতি, অঙ্গীকারের ঘোষণাও শুনতে পাবো। তার অনেকগুলোই খুব টেকনিক্যাল যেমন, প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে আরো যেসব নীতি-কৌশল দরকার।

তবে কিছু ঘোষণা এমন হতে পারে :

ইলেকট্রিক কার বা ব্যাটারি চালিত গাড়ির ব্যবহার দ্রুত বাড়ানো।
কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ থেকে দ্রুত সরে আসা।-গাছ কাটার মাত্রা কমানো।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আরো মানুষকে রক্ষা করা এবং তার জন্য উপকূলীয় বাঁধ এবং অন্য প্রতিরক্ষা জোরালো করা।

প্রায় ২৫ হাজার মানুষ গ্লাসগোতে হাজির হতে পারে যাদের মধ্যে থাকবেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, মীমাংসাকারী এবং সাংবাদিক। হাজার হাজার অ্যাকটিভিস্ট এবং বহু ব্যবসায়ীও হাজির হবেন। রেবেলিয়ান এক্সটিংশনের মতো কট্টর পরিবেশবাদী গোষ্ঠী এখনই জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো বন্ধ করার দাবি করছে।

সম্মেলনের শেষে, একটি সর্বসম্মত ঘোষণা আসতে পারে বলে আশা করতে হচ্ছে যাতে সুনির্দিষ্ট সব অঙ্গীকার থাকবে। সব দেশকে সেই ঘোষণায় সই করতে হবে।

কলহের আশঙ্কা কতটা?
নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারেন যে টাকা-পয়সা এবং ন্যায়বিচার নিয়ে অনেক কথা হবে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ উন্নত দেশগুলোর চেয়ে কম। অতীতে যে মাত্রায় নিঃসরণ হয়েছে তার জন্য এসব দেশের দায় নিতান্তই কম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি তাদেরকেই বেশি পোহাতে হচ্ছে।

কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য তাদের টাকা-পয়সা দরকার। যেমন, কয়লার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সোলার বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে তাদের পুঁজি প্রয়োজন। আবহাওয়ার নেতিবাচক আচরণের সাথে খাপ খাওয়াতে তাদের টাকা পয়সা দরকার। উপকূলীয় বাঁধ শক্ত করতে বিনিয়োগ প্রয়োজন।

সেই সাথে, উন্নয়নশীল দেশের জন্য ক্ষতিপূরণ নিয়েও অনেক বাকযুদ্ধ, টানাপড়েন চলবে। ধনী দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা ২০২০ সালের মধ্যে দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেবে যাতে তাদের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা সহজ হয়। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ সম্প্রতি বলেছে এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি। ফলে, এই প্রতিশ্রুতির মাত্রা বাড়ানোর জন্য ধনী দেশগুলোর ওপর চাপ রয়েছে।

ধনী দেশগুলো তাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি রাখেনি
কপ২৬ সম্মেলনে চীন কী কী প্রতিশ্রুতি দেয় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণে এ মুহূর্তে চীনই এক নম্বর কার্বন নিঃসরণকারী দেশ। শুধু নিজের দেশেই নয় বিশ্বের বিভিন্ন জায়গাতেই তারা কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছে। তবে, সম্প্রতি চীনা প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন যে চীন আর দেশের বাইরে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাবে না।

তবে অন্য দেশগুলোও কয়লা বিদ্যুৎ নিয়ে কী বলে তার দিকে নজর থাকবে।

কপ২৬ আমাকে কীভাবে প্রভাবিত করবে?
গ্লাসগোতে দেয়া কিছু কিছু প্রতিশ্রুতি আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাপনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। যেমন:

আপনি আর কতদিন পেট্রল বা ডিজেল চালিত গাড়ি চালাতে পারবেন তা নির্ধারিত হতে পারে,
শীতে ঘর গরম করতে গ্যাস ব্যবহার করতে পারবেন কিনা তা ঠিক হয়ে যেতে পারে, এবং
ঘন ঘন বিমান ভ্রমণ কঠিন হয়ে যেতে পারে।

কপ২৬ : কনফারেন্স অব দি পার্টিজকে সংক্ষেপে কপ বলা হয়। জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে গঠিত কপের প্রথম সম্মেলন অর্থাৎ কপ১ হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। এবার হচ্ছে ২৬তম সম্মেলন।

প্যারিস চুক্তি : বিশ্বের তাপমাত্রা কমাতে উদ্যোগী হতে প্রথমবারের মতো সব দেশ একমত হয়ে প্যারিস চুক্তি করেছিল।

আইপিসিসি : আন্তঃদেশীয় এই বিশেষজ্ঞ প্যানেল জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সর্বশেষ সমস্ত গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে।

১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস : বিজ্ঞানীরা বলেন শিল্প-বিপ্লব পূর্ববর্তী বিশ্বের তাপমাত্রার তুলনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর প্রভাব থেকে বাঁচা যাবে।

কপ২৬ সফল হয়েছে তা বুঝবো কী করে?
আয়োজক দেশ হিসাবে ব্রিটেন চাইবে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমাতে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য নির্গমনের জন্য সমস্ত দেশ যেন নতুন করে অঙ্গীকার করে।

তাছাড়া, কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ, পেট্রল কার এবং পরিবেশ রক্ষায় দেশগুলোর কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার আশা করবে আয়োজক ব্রিটেন।

অন্যদিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলো আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ চাইবে।

এগুলোতে কোনো সুরাহা না হলে, কপ২৬-এর সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা নিশ্চিত করার জন্য হাতে খুব বেশি সময় নেই।

তবে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, বিশ্ব নেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্ব, ভয়াবহতা বুঝতে ইতোমধ্যেই অনেক দেরি করে ফেলেছেন।

ফলে, গ্লাসগোতে যে প্রতিশ্রুতিই দেয়া হোক না কেন, তাপামাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে।
সূত্র : বিবিসি