৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আন্তর্জাতিক সম্পদ

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ আন্তর্জাতিক সম্পদ

ছবি: উইকপিডিয়া

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এখন আন্তর্জাতিক সম্পদ। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এই ভাষণকে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ঐ বছর ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বৈঠকে ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ওয়াল্ড ইন্টারন্যাশনাল’ রেজিস্ট্রারে তালিকা ভুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংস্থাটির ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজার কমিটি (আইওসি) ঐদিন প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে তৎকালীন মহাপচিালক ইরিনা বোকোভ এ সংক্রান্ত ঘোষণাটি দেন।

‘গণ সূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার অমর কবিতা শুনিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ এর ৭ মার্চের পড়ন্ত বিকালের অপ্রতিরোধ্য বজ্রকন্ঠ, দ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে। ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এবারে সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ঢাকার রেসকোর্স মাঠে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণের অনবদ্য চিত্র তুলে ধরেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি বিভাবে আমাদের হল কবিতায়। কবি লিখেছেন, ‘সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির অধীনে আন্তর্জাতিক তালিকায় মোট-৭৮টি দলিলকে মনোনয়ন দেয়। এ তালিকায় ৪৮ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটিকে স্থান দেওয়া হয়। বিশ্ব ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আন্তর্জাতিক তালিকাই মূলত মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের ঘটনার সংরক্ষণ ও সবার কাছে পৌঁছানোর  চেষ্টা করছে ইউনেস্কো। এই তালিকায় ঠাঁই পেতে হলে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক প্রভাব থাকতে হয়।

১৯৯২ সালে মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রাম চালু করে ইউনেস্কো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দলিলিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও ব্যবহারে সচেতনতার তাগিদে এটি চালু হয়। যুদ্ধ ও সামাজিক অস্থিরতা, সম্পদের অপ্রতুলতার কারনে দলিলিক ঐতিহ্য নিয়ে সমস্যা বেড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন সংগ্রহশালা বিনষ্ঠ হয়েছে। লুটপাঠ, অবৈধ বিক্রি, ধ্বংস, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও তহবিলের উদ্যোগে নষ্ট হয়েছে দলিল। অনেক দলিল নষ্টের ঝুঁকিতে।

এই স্বীকৃতি শুধু বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি নয়, সমগ্র দেশের জন্য বড় স্বীকৃতি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা সেদিন ছিল মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে  চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন। সবার হাতে ছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতকাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন দৃপ্তপায়ে উঠে আসেন রেসকোর্সের মঞ্চে।

ভাষণে তিনি বলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শক্রর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা কিছু আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।” উত্তাল জনসমুদ্রে যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উদগ্রীব, তখন বঙ্গবন্ধু  উচ্চারণ করেন তার চুড়ান্ত আদেশ, “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ। এবারে সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

একদিনের ঘোষণায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি। তিল তিল করে বঙ্গবন্ধু তার সারাটা জীবন দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন অত্যন্ত সতর্কতার সংগে ঐ ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অবিহিত করা না হয়, সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। তার ঐ সতর্ক কৌশলের কারনেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ঐ জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্তুতি নিলেও তা করতে পারেনি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে, ‘চতুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলো, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না। মাত্র ১৯ মিনিটের সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে তুলে দেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়। এতে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি।

রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের সব আয়োজন ছিল রেডিও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের। প্রচার শুরু হয়েছিল। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রচার বন্ধ করে দিলে বেতারের সব বাঙালি কর্মচারী বেতার ভবন ছেড়ে বেড়িয়ে আসেন, বন্ধ হয়ে যায় সব ধরণের সম্প্রচার কার্যক্রম। ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব। গভীর রাতে অবশ্য সামরিক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাষণ সম্প্রচারের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।।

অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ

উপাচার্য

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়