স্বাধীনতার পরপরই যে দুর্ভিক্ষ বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশকে

স্বাধীনতার পরপরই যে দুর্ভিক্ষ বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশকে

স্বাধীনতার পরপরই যে দুর্ভিক্ষ বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশকে

বাংলাদেশের বিজয়ের কয়েক সপ্তাহ পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ ত্রাণকর্মী জুলিয়ান ফ্রান্সিস কিছু জরুরি ওষুধপত্র নিয়ে কলকাতা থেকে একটি ল্যান্ডরোভার গাড়িতে চড়ে রওনা দিয়েছেন ঢাকার পথে। তার সাথে ছিলেন এক বৃটিশ নার্স। গাড়িচালক এক বাংলাদেশি শরণার্থী, বাদল নন্দী।

ছাব্বিশ বছর বয়সী জুলিয়ান ফ্রান্সিস তখন কাজ করেন ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা অক্সফ্র্যামে।

‘বনগাঁ হয়ে যশোর সীমান্ত দিয়ে আমরা বাংলাদেশে ঢুকি। অনেক দীর্ঘ সময় লেগেছিল, কারণ তখন পুরো পথেই ছিল মানুষের ভিড়, হাজার হাজার মানুষ তখন ভারতের শরণার্থী শিবির হতে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছিল। আরেকটা সমস্যা ছিল, অনেক ব্রিজ এবং কালভার্ট ছিল ভাঙ্গা, যুদ্ধের সময় এগুলো বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল,’ বলছিলেন তিনি।

দীর্ঘ যাত্রাপথে জুলিয়ান ফ্রান্সিস যেসব ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছিলেন, সেগুলো তাকে বহু বছর তাড়া করেছে।

‘মাইলের পর মাইল দু'পাশে কেবল পুড়ে যাওয়া গ্রাম, জনবসতি। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে কয়েক সপ্তাহ আগে, কিন্তু তখনো অনেক জায়গায় পড়ে আছে লাশ। শকুন এসে খুবলে খাচ্ছে সেসব দেহ। যে শরণার্থীরা বাড়ি ফিরছে তাদের মনে শংকা, বাড়ি ফিরে তারা কী দেখবে।’

জুলিয়ান ফ্রান্সিস ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকায় পৌঁছানো প্রথম পশ্চিমা ত্রাণকর্মীদের একজন। এখন তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে ঢাকাতেই বসবাস করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন শুরু হয় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে, তখন থেকেই তিনি কলকাতার শরণার্থী শিবিরগুলোতে ত্রাণ কাজে জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধ শেষে তার ওপর দায়িত্ব পড়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে গিয়ে অবস্থা সরেজমিনে দেখা- সেখানে কী ধরনের জরুরি সাহায্য-সহযোগিতা দরকার, সেটা অক্সফ্যাম সদর দফতরে জানানো।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান তখন মাত্র পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় ফিরেছেন। সেই সময়ে একদিন তার সাথে দেখা করতে গেলেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস।

‘আমরা ভেবেছিলাম, তার সাথে হয়তো মাত্র দুই-তিন মিনিটের সময় পাবো। কারণ শত শত মানুষ দেখা করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল,’ তিনি বলেন।

‘আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য অক্সফ্যামের মতো একটি ক্ষুদ্র সংগঠন কী করতে পারে। তিনি তার মুখ থেকে পাইপটা নামিয়ে সেটি আমার দিকে তাক করে বললেন, তুমি কীভাবে এখানে এসেছো, ইয়াং ম্যান।’

‘আমি বললাম, আমরা কলকাতা থেকে সড়ক পথে এসেছি। তখন তিনি বললেন, তাহলে আমার চেয়ে তুমি ভালো জানো, কারণ তুমি আমার দেশের অবস্থা আমার চেয়ে বেশি দেখেছ। কারণ আমি তো গত ৯ মাস পাকিস্তানে বন্দী ছিলাম।’

এটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসার প্রায় ১০ দিন পরের ঘটনা। বাংলাদেশের নতুন প্রশাসন তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবস্থা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো রীতিমত আতংকিত, বাংলাদেশে তারা একটি আসন্ন দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে।

এর আগে ১৯৭১-এর ডিসেম্বরেই জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশে তাদের ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করলেও (ইউনাইটেড নেশন্স রিলিফ অপারেশন ইন ঢাকা) খাদ্য সরবরাহ নিয়ে জাহাজ পাঠানো যাচ্ছিল না। যুদ্ধের সময় পেতে রাখা মাইনের কারণে চট্টগ্রাম এবং চালনা বন্দর, দুটিই তখন বন্ধ। বন্দরের চ্যানেলে অনেক ডুবে যাওয়া জাহাজ। জরুরি খাদ্য সাহায্য পরিবহনের জন্য পাওয়া যাচ্ছে না কোনো জাহাজ, রাজি হচ্ছে না কোনো শিপিং লাইন্স।

তবে শেষ পর্যন্ত সাহায্য এসেছিল সারা পৃথিবী থেকে- আর্জেন্টিনা থেকে শুরু করে যুগোশ্লাভিয়া, নেপাল থেকে নরওয়ে, ব্রিটেন থেকে বুলগেরিয়া। খাদ্য সাহায্যের দিক থেকে অবশ্য সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ভারত। স্বাধীনতার পর হতে ১ জানুয়ারি, ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কেবল ভারতই দিয়েছিল প্রায় ১২ কোটি ডলারের সমপরিমাণ খাদ্য সাহায্য।

‘স্বাধীনতার পর প্রথম এক বছর, দেড় বছর, আমাদের তীব্র খাদ্য ঘাটতি ছিল। তখন কারা আমাদের খাইয়েছে? ভারত। অনেক মানুষ এটা জানে না, আবার অনেকে স্বীকারও করতে চায় না রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার কারণে,’ বলছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, যিনি এখন ওয়াশিংটন ডিসিতে অবসর জীবনযাপন করছেন।

ব্যাপক আন্তর্জাতিক সাহায্যের কারণে শেষ পর্যন্ত এই দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশ এড়াতে পেরেছিল। কিন্তু ঠেকানো যায়নি এর পরেরটি।

আকালের সন্ধানে
ময়মনসিংহ শহর থেকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ পেরিয়ে চর ঈশ্বরদিয়া গ্রাম। ১৯৭৪ সালের শরৎকালে দুর্ভিক্ষের সময় যেসব জেলায় সবচেয়ে বেশি লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছিল তার একটি।

চর ঈশ্বরদিয়ার জমিলা খাতুনকে এখনো তাড়া করে ফিরছে সেই দুর্ভিক্ষের স্মৃতি।

‘এমনও গেছে বাজান, ৮/১০ দিন ভাত না খাইয়া ছিলাম। লঙ্গরখানায় গিয়া লাইনে দাঁড়াইতাম, কোনো দিন রুটি পাইলে খাইতাম। কোনোদিন কচুপাতা সিদ্ধ কইরা খাইছি,’ বলছিলেন তিনি।

বেঁচে থাকার তাগিদে ক্ষেতে ধান কাটা থেকে শুরু করে পাটের জাগ দেয়া- এমন কোনো কাজ নেই তিনি করেননি। কিন্তু একদিন দুই বছর বয়সী অভুক্ত শিশুপুত্রের কান্নায় অতিষ্ঠ হয়ে জমিলা খাতুন এক ভয়ংকর কাজ করলেন। বাড়ির কাছের এক খাদের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তাকে।

‘ভাতের লাইগ্যা গো বাজান, ভাতের লাইগ্যা কাঁদতো। তারপর ঐ পাগাড়ে ফালাইয়া দিছি। পেটের জ্বালায় তারে ফালাইয়ে দিছি ঐখানে, পানির মধ্যে।’ কাঁদতে কাঁদতে জমিলা খাতুন আমাকে হাত তুলে দেখালেন সেই জায়গাটি, যেখানে তিনি ফেলে দিয়েছিলেন তার ছেলেকে।

জমিলা খাতুনের শিশুপুত্র ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। শিয়ালের মুখ থেকে তাকে তুলে নিয়ে আসে পাড়ার লোকজন। সেই শিশু লুকুমুদ্দিনের বয়স এখন ৪৯, রিকশাচালক। তবে তার গায়ে এখনো রয়ে গেছে শিয়ালের কামড়ের ক্ষতচিহ্ণ।

১৯৭৪ সালের এই দুর্ভিক্ষে কত মানুষ মারা যায়, কিংবা কেন এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়েছিল- তা নিয়ে আছে অনেক বিতর্ক। তবে নিঃসন্দেহে এটি ছিল বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুতর সংকটগুলোর একটি। এর রাজনৈতিক পরিণাম কী হবে, তার নানা অশনি সংকেত তখন দেখা যাচ্ছিল।

সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন
রাজনীতিতে তখন চরম অস্থিরতা, যুদ্ধ ফেরত তরুণদের একটি বড় অংশ সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে সমাজতন্ত্র কায়েমের স্বপ্ন দেখছে।

আয়েশা পারুল রাজনীতিতে জড়িয়ে গিয়েছিলেন মাত্র ১৫/১৬ বছর বয়সে। বড় বোন যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাড়ি ছেড়ে গেলেন, তারও ইচ্ছে হয়েছিল যুদ্ধে যাবেন, কিন্তু পরিবারের অনুমতি মেলেনি।

স্বাধীনতার পর তিনি জড়িয়ে পড়লেন জাসদের সবচেয়ে বিপ্লবী একটি গোষ্ঠীর সাথে।

‘তখন আমি লালমাটিয়া কলেজের হোস্টেলে থাকি। আমার কাজ গণবাহিনীর সাথে, বেশ গোপনীয়। শুরুর দিকে আমার সাথে আরো কয়েকটা মেয়ে কাজ করতো, লিনু, হাসি- এরা জাসদের শুরুর দিককার কর্মী। বাচ্চু, মাসুদ, হারুণ, বাহার- এরাও ছিল। বাচ্চু আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। আমার কাছে লিফলেট দিয়ে যেত, আরো বিভিন্ন সরঞ্জামাদি রেখে যেত। আমার কাছে রাখাটা ওরা নিরাপদ মনে করতো।’

স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম রাষ্ট্রীয় নীতি তখন সমাজতন্ত্র, কিন্তু আয়েশা পারুলের মতো তরুণ বিপ্লবীদের কোনো আস্থা নেই সরকারের ওপর।

‘সরকার মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও, আসলে তো সেরকম কিছু ঘটছিল না বলেই মনে হয়েছিল আমাদের। আমরা ভেবেছি, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই সমাজতন্ত্র আনতে হবে।’

শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনের বিরুদ্ধে তখন জাসদ এক প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের অনেক নেতা-কর্মী কারারুদ্ধ। দেশজুড়ে চলছে সর্বহারা পার্টির মতো আরো কিছু চরম বামপন্থী সশস্ত্র দলের তৎপরতা। বাকশালের নামে একদলীয় ব্যবস্থা কায়েম হওয়ার পর দেশে যখন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি, তখন সরকারের বিরুদ্ধে আঘাত হানার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন আয়েশা পারুল এবং তার দলের কর্মীরা।

গণভবনের খোলা দরোজা
পুরো দেশ যখন একের পর এক সংকটে খাবি খাচ্ছে, তখন কী ঘটছিল সরকারের ভেতরে?

১৯৭৩ সালের শেষ ভাগে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে বদলি হয়ে আসলেন এক তরুণ আমলা এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন। প্রধানমন্ত্রীর দফতর তখনো পুরোনো গণভবনে।

‘সেখানে নিচে একটা বড় হলঘর ছিল। অভ্যাগতরা এলে সেখানে বসতো। আমরা বসতাম তার আশে-পাশের কামরায়। তখনো পর্যন্ত অবস্থা এমন, যে কেউ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ঢুকে পড়তে পারে, একদম অবারিত দ্বার’, বলছিলেন তিনি।

প্রথম দিনেই প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ডাক পড়লো ড. ফরাসউদ্দীনের।

‘তিনি আমাকে বললেন, দ্যাখ, বাংলাদেশ গরীব মানুষের দেশ, কিষাণ-কিষাণীদের দেশ। আমি তাদের প্রধানমন্ত্রী, তারা যখন আমার সাথে দেখা করতে আসবে, তাদের ঠেকাস না,’ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রথম কর্মদিবসের স্মৃতিচারণ করছিলেন তিনি।

কিন্তু ১৯৭৪ সাল নাগাদ পরিস্থিতি ক্রমশ সরকারের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছিল। দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ, অর্থনীতি তখন প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ার মতো অবস্থা। দরিদ্র মানুষ যখন চরম খাদ্য সংকটে, তখন এর ব্যাপকতা সম্পর্কে কতটা জানতো তৎকালীন সরকার?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিব হিসেবে সরকারী প্রশাসনের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে।

‘এটা যে বড় সমস্যা, জটিল সমস্যা, সেটা সরকার বুঝেছিল। কিন্তু এটা যে একটা সংকট, সেটা সরকার প্রধানকে বোঝানো হয়নি। নীতিনির্ধারকরা তখন বলেছেন, এটা সমাধানযোগ্য, আমরা সমাধান করতে পারবো। প্রধানমন্ত্রী এটা মোটামুটি বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে যে, এটা করার জন্য যে ধরনের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল, আপদকালীন যুদ্ধাবস্থার মতো যেরকম দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দরকার ছিল, সেরকম কিছু তাকে বোঝানো হয়নি।’

দুর্ভিক্ষ নিয়ে বিতর্ক
সংকট আরো ঘনীভূত হলো কিউবার কাছে বাংলাদেশের পাট বিক্রির সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্র সাথে সাথে বাংলাদেশে সাহায্য বন্ধ করে দিল। খাদ্য নিয়ে বাংলাদেশের পথে ছিল যে জাহাজ, তা ফিরিয়ে নেয়া হলো।

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীনের মতে, দুর্ভিক্ষ যে এরকম ব্যাপক রূপ নিল, তার প্রধান কারণ ছিল এটি।

তবে পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম টেলিফোনে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভিন্নমত পোষণ করেন।

‘এই দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে, কিন্তু সেই বিতর্ক হচ্ছে রাজনৈতিক বিতর্ক। আসলে তখন কিছু করার ছিল না। কারণ ১৯৭৩ সালে কয়েকবার বন্যা এবং খরা হয়েছে। তখন বিরাট শস্য ঘাটতি দেখা দেয়। এরপর যখন ১৯৭৪ সালের শরৎকাল আসলো, তখন আর দেশে কোনো খাদ্যের মওজুদ নেই। সরকারের হাতেও নেই। প্রাইভেট স্টকও নেই।’

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি, পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি- সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

‘এ দুর্ভিক্ষ এড়ানো যে প্রায় অসম্ভব ছিল, এটা এখন কেউ বুঝবে না।’

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক বিরোধিতা বাড়ছে, সরকারের জনপ্রিয়তা যে কমছে, তখন তার আঁচ কতটা পাচ্ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন দাবি করছেন, সরকারপ্রধানকে এ নিয়ে সঠিক ধারণা দেয়া হয়নি।

‘উনার কিন্তু সম্যক ধারণা ছিল না। দেশে একটা অসন্তোষ আছে, তার বিরুদ্ধে লোক দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু এটা যে এত শক্তিধর, এর পেছনের শক্তি যে এত শক্তি জোগাচ্ছে, এটা উনি বুঝতে পারেননি। কারণ মানুষকে বিশ্বাস করার একটা সাংঘাতিক প্রবণতা ছিল উনার।’

এই বিশ্বাসের মূল্য তাকে কীভাবে দিতে হয়েছিল, তার একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন ড. ফরাসউদ্দীন।

প্রধানমন্ত্রীর দফতর তখন স্থানান্তরিত হয়েছে নতুন গণভবনে, সেখানে আগের মতো আর সবার প্রবেশাধিকার নেই।

‘মেজর শরিফুল হক ডালিম তখন সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হয়েছেন, তার ব্যাজ কেড়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তখনো তিনি ৩২ নম্বরে আসা-যাওয়া করেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ।’

‘একদিন তাকে গেটে আটকানো হয়েছে। আমি গণভবনের গেট থেকে ফোন পেলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি শরিফুল হক ডালিম? তিনি বললেন, জ্বী। আমি জানতে চাইলাম, আপনার সাথে কি বঙ্গবন্ধু দেখা করবেন? তিনি কিন্তু বেশ রূঢ়ভাবে বললেন, বলেই দেখুন না। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম। তখন তিনি বললেন, নিয়ে আয়। ও তো আমার ছেলে। আমি ডালিমকে নিয়ে আসলাম। তিনি অনেকক্ষণ কথা বললেন তার সাথে।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মেজর শরিফুল হক ডালিম এবং তার সহযোগীদের যে অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছিলেন, এটি ছিল তার মাত্র মাসখানেকের কিছু আগের ঘটনা, মনে করতে পারেন ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন।

১৫ আগস্টের ভোরবেলা মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীনের কাছে ভয়ংকর দুঃসংবাদটি আসলো একটি ফোন কলে।

‘আমাদের কনফিডেনশিয়াল সেকশন অফিসার মালেক ভূঁইয়া আমাকে ফোন দিলেন। বললেন, স্যার, ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেছে। তার কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমাকে উনি বললেন, স্যার রেডিও ধরেন। রেডিও অন করলাম। সেখানে ডালিমের কণ্ঠ শুনলাম।’

ভারতীয় হাইকমিশনে ব্যর্থ অভিযান
সাইক্লোন, যুদ্ধ, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক অস্থিরতার পর এবার বাংলাদেশে শুরু হলো একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থান। জাসদের বেশিরভাগ শীর্ষ নেতা তখন কারাবন্দী। তাদের মুক্ত করতে এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করে বসলো জাসদের গণবাহিনীর একটি গ্রুপ। ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বরের সেই অভিযানের প্রস্তুতির কিছু দায়িত্ব পড়েছিল আয়েশা পারুলের ওপর।

‘আমাকে ভারতীয় হাইকমিশন রেকি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, যাতে এই অভিযান সফল করা যায়। তখন ভারতীয় হাইকমিশন ধানমন্ডিতে। তবে শেষ পর্যন্ত আমাকে আর যেতে হয়নি। সেই কাজ আরেকজনকে করতে হয়েছিল।’

গণবাহিনীর এই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল, ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে অপহরণ করতে গিয়ে গুলিতে নিহত হয় তাদের চারজন সদস্য। এদের একজন ছিলেন বাচ্চু, যিনি নিয়মিত লালমাটিয়া কলেজ হোস্টেলে আসতেন আয়েশা পারুলের কাছে। ঘটনার খবর পাওয়ার সাথে সাথে আত্মগোপনে যেতে হয় আয়েশা পারুলকে। বহু বছর পালিয়ে বেড়াতে হয় তাকে।

আয়েশা পারুল এখন ঢাকায় অবসর জীবনযাপন করছেন, কিন্তু যে ধরনের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি, সেজন্য মোটেই অনুতপ্ত নন তিনি।

‘আমি তো অন্যায় করিনি কিছু। আমি যা করেছি ন্যায়ের জন্য করেছি। আমরা ভুল করেছি না সঠিক করেছি, সেটা তো সেই সময়ের কথা মাথায় রেখে বিবেচনা করতে হবে। কেউ যখন কোনো কাজ করে, ভুল ভেবে করে না, সঠিক ভেবেই করে। আমরাও তখন সঠিক ভেবেই করেছিলাম।’

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়
এভাবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সামরিক অভ্যুত্থানে শুরুর কয়েক বছর বারে বারে মুখ থুবড়ে পড়ছিল বাংলাদেশ। ১৯৭০-এর সাইক্লোন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী এসব ঘটনাপ্রবাহে তখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তীব্র সংশয় তৈরি হলো।

বাংলাদেশের শুরুর বছরগুলোর এই সংকট নিয়ে গবেষণা এবং লেখালেখি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নাওমি হোসেন।

‘১৯৭০-এর সাইক্লোনের সময় বাকি বিশ্বের মানুষ প্রথম দেখেছিল কী ভয়ংকর অবস্থায় বাস করছে এই ভূখণ্ডের মানুষ। সেটি ছিলে টেলিভিশন সাংবাদিকতার প্রথম যুগের ঘটনা,’ তিনি বলেন।

‘তারপর তো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। টেলিভিশনে বিশ্বের যেসব যুদ্ধের দৃশ্য প্রথম প্রচারিত হয়েছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল সেই যুদ্ধগুলোর একটি। তারপর ঘটলো দুর্ভিক্ষ, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করা হলো।

‘কাজেই ১৯৭৫ সাল নাগাদ বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের ব্যাপারে যা কিছু দেখেছে, তা ছিল কেবলই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানবিক বিপর্যয় এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ছবি,’ বলেন অধ্যাপক নাওমি হোসেন।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সম্পর্কে সিআইএ যে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিল, সেটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন নাওমি হোসেন। এটি লেখা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতাদেরকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করার জন্য।

‘ওই রিপোর্টের মূল সুরটা ছিল এরকম- এই দেশটা বাঁচবে কেমন করে? এদের কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, তাদের দেশটার আয়তন এত ছোট, আর এই ছোট জায়গায় ঠাসাঠাসি করে এত মানুষ থাকে! এর ওপর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রাজনৈতিক অস্থিরতা তো আছেই। কেমন করে এই দেশ টিকবে?’

নাওমি হোসেনের মতে, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ যে পথ পাড়ি দিয়েছে, সেটির গুরুত্ব বুঝতে হলে দেশটির শুরুর সেই কয়েকটি বছরের সংকটকালের দিকে ফিরে তাকানো খুবই জরুরি। কারণ ওই সংকটের মধ্যেই রচিত হচ্ছিল ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পথরেখা।

তার মতে, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে বাংলাদেশে এক ধরনের নীরবতা আছে, এটি নিয়ে কথা বলতে অনেকেই বেশ অস্বস্তি বোধ করেন। অথচ বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর ওপর, নীতিনির্ধারকদের ওপর এই দুর্ভিক্ষের মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত ছিল ব্যাপক।

২০০৮ ও ২০০৯ সালে বিশ্বে যে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল, সেটা নিয়ে এক ব্যাপক গবেষণায় আরো অনেকের সাথে যুক্ত ছিলেন নাওমি হোসেন। বিভিন্ন দেশ কীভাবে এই সংকটের মোকাবেলা করেছে, তারা সেটা জানার চেষ্টা করছিলেন। তারা দেখতে পেলেন, বাংলাদেশ এই সংকট বেশ ভালোভাবে মোকাবেলা করেছে।

‘আমরা তখন বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে জানতে চাই- কেন বাংলাদেশ এতটা সফলভাবে এর মোকাবেলা করতে পারলো? এরা সবাই এমনভাবে আমাদের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল, যেন আমরা গর্দভ। এরপর ওরা বলেছিল, এর কারণ সেই দুর্ভিক্ষ।’

নাওমি হোসেন বলেন, আজকের বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষদের সুরক্ষা এবং উন্নয়নের জন্য যেসব নীতি প্রণীত হয়েছে, তার মূলে আছে এই দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা।

‘বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা জানেন, মানুষ যখন ক্ষুধার্ত, তখন যদি ব্যবস্থা নেয়া না যায়, যদি খাদ্যের সংস্থান করা না যায়, সেটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।’

সূত্র : বিবিসি