করোনায় কর্মহীন মানুষের জন্য ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন, কারা পাবেন?

করোনায় কর্মহীন মানুষের জন্য ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন, কারা পাবেন?

করোনায় কর্মহীন মানুষের জন্য ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন, কারা পাবেন?

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি ৫০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে, যা মূলত মহামারির কারণে কর্মহীন হয়ে ঢাকাসহ বড় শহরগুলো থেকে গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষদের কর্মসংস্থানের জন্য ঋণ হিসেবে দেয়া হবে।

মহামারির মধ্যে চাকরি বা ব্যবসা হারিয়ে বেকার হয়ে পড়া এবং শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে স্থায়ী হওয়া ব্যক্তি এ ঋণ পাওয়ার জন্য যোগ্য হবেন।এটি হবে জামানত-বিহীন এবং একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন।ঋণের অর্থ ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে সুদের হার হবে ছয় শতাংশ।

কর্মহীন মানুষের হিসাব নেই

মহামারির প্রভাবে গত দেড় বছরে বাংলাদেশে বহু মানুষ বেকার হয়েছেন। কেউ পেশা পরিবর্তন করেছেন, আবার কেউ পুরনো কাজে ফেরত যেতে পারেননি।কিন্তু দেশে কতজন মানুষ এ সময়ে কর্মহীন বা বেকার হয়েছেন এ সময়ে সে সংক্রান্ত কোন সরকারি পরিসংখ্যান নেই।

বেসরকারি সংগঠন পিপিআরসি ও বিআইজিডি সাড়ে সাত হাজার মানুষের ওপর এক গবেষণা চালিয়ে বলেছিল, মহামারির প্রথম ছয়মাসে কেবল ঢাকা শহর ছেড়েছেন অন্তত ১৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ।এছাড়া অন্যান্য বড় শহরগুলো থেকেও অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন।এদের একজন জামালপুরের তানিয়া বেগম।গাজীপুরের এক গার্মেন্টস কারখানায় টানা ১১ বছর চাকরি করেছেন, কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে লকডাউনের মধ্যে তার কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

চাকরি হারানোর পরও ঢাকায় আড়াই মাস ছিলেন, কিন্তু বাড়িভাড়া, খাওয়ার খরচ এবং বাড়িতে টাকা পাঠানো---এসব নানামুখী ব্যয় মেটাতে না পেরে স্বামীর সাথে বাড়ি ফিরে যান।"এরপর থেকে বইসাই আছি। হেও (স্বামী) কিছু করতেছে না। একটা অটো কিনতে চাইছিলাম, কিন্তু ফেরত দিমু কি না ডরে কেউ ধারও দিতে রাজি হয় নাই। বাচ্চাকাচ্চা নিয়া খুবই বিপদে আছি আমরা," বলেন তানিয়া।টাঙ্গাইলের মধুপুরের মেয়ে ত্রিবেনী কাজ করতেন ঢাকার এক পার্লারে।

চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরেছেন ঠিকই, কিন্তু কোন কাজের ব্যবস্থা হয়নি এখনো তার।তিনি বলছেন, "১৩ বছর বয়সে ঢাকায় গেছি কাজ শিখতে, এখন পার্লারের কাজের বাইরে সামান্য ঘরের কাজ পারি। অন্য কোন কাজ তো জানি না, আর ব্যবসাও ঠিকমত বুঝি না।""আমার আয়েই চলত আমার মা-বাবা-ভাইয়ের খরচ, এখন আমার সাথে সাথে ওদের অবস্থাও খারাপ।"এমন আরো বহু মানুষ গ্রামে ফিরে গেছেন, কিন্তু তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়নি এখনো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম  বলছেন, মহামারির কারণে গত পৌনে দুই বছরে গ্রামে ফিরেছেন অনেক মানুষ কিন্তু কাজ নেই তাদের সেখানে।"এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব যাতে না পড়ে সেজন্য এই তহবিল গঠন করা হয়েছে।"

কিভাবে দেয়া হবে এই ঋণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি বিভাগ থেকে এ তহবিল পরিচালনা করা হবে।গ্রাম ভিত্তিক বিভিন্ন ক্ষুদ্র উদ্যোগের জন্য এ ঋণ প্রদান করা হবে।ঋণের ১০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে।

এটি একটি রিফাইন্যান্সিং মানে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল। এর মানে হচ্ছে দেশের সবগুলো তফসিলি ব্যাংক এ ঋণ নিজেরা বিতরণ করবে, এরপর সম-পরিমাণ অর্থ তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে পাবে।বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে এ অর্থ সরবরাহ করা হবে।

যেসব ব্যাংক এ ঋণ দিতে আগ্রহী তাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে, এরপর ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করতে পারবে।এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের এ তহবিল থেকে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ হার সুদে অর্থ নেবে।কিন্তু ঋণ দেয়ার সময় একজন গ্রাহক সেটি নেবেন ছয় শতাংশ হারে।আর ঋণ গ্রহণের জন্য প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী গ্রহীতার যে জামানত প্রয়োজন হয়, তা এক্ষেত্রে লাগবে না।

দুই লাখ টাকা পর্যন্ত যারা ঋণ নেবেন, কিস্তি পরিশোধের জন্য তারা তিন মাস গ্রেস পিরিয়ডসহ দুই বছর সময় পাবেন।আর পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত যারা ঋণ নেবেন তাদের ক্ষেত্রে ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ডসহ পরিশোধের জন্য তিন বছর সময় পাবেন ঋণ গ্রহীতা।এ তহবিলের অন্তত ১০ শতাংশ ঋণ বা বিনিয়োগ নারীদের দেওয়ার জন্যও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কোন কোন খাতের জন্য দেয়া হবে

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, যেকোন ছোট উদ্যোগ শুরু করার জন্য নূন্যতম একটি বিনিয়োগের যাতে ব্যবস্থা হয়, সেজন্য কিছু খাত নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে

* স্বল্প পুঁজির স্থানীয় ব্যবসা

* পরিবহন খাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি যানবাহন কেনা

* ক্ষুদ্র প্রকৌশল শিল্প

* মৎস্য চাষ, গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন

* তথ্যপ্রযুক্তি সেবা কেন্দ্র ও অন্যান্য সেবা প্রদানকারী কর্মকাণ্ড

* বসতঘর নির্মাণ বা সংস্কার

* সবজি ও ফলের বাগান

* কৃষি যন্ত্রপাতি কেনা ও ফসল বিপণন

* ছোট ছোট ব্যবসা, বিশেষ করে ধান ভাঙ্গানো, চিড়া বা মুড়ি তৈরি,

* নৌকা কেনা,

* মৌমাছি পালন,

* সেলাই মেশিন কেনা

* কৃত্রিম গহনা ও মোমবাতি তৈরি

কিভাবে নির্বাচিত হবেন ঋণ গ্রহীতা

শহর এলাকা থেকে গ্রামে মানুষের সঠিক পরিচয় চিহ্নিত করার জন্য একজন ব্যক্তিকে তার সর্বশেষ কর্মস্থলের নিয়োগপত্র বা পরিচয়পত্র প্রমাণ হিসেবে দেখাতে হবে।ঋণের অর্থ কোন ধরনের উদ্যোগে ব্যবহার করা হবে, সে কাজের পরিকল্পনা ও প্রমাণ দিতে হবে সাথে।

কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কাজ করতেন না যেমন দিনমজুর, বাসাবাড়ির কাজের লোক, যাদের সাধারণত পরিচয়পত্র থাকে না--এমন বহু মানুষ চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফেরত গেছেন, তাদের ক্ষেত্রে কী করা হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মি. ইসলাম বলেছেন, তাদের পরিচয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে স্থানীয় চেয়ারম্যান প্রত্যয়নপত্র দেবেন।ঋণ প্রদান ও আদায়ে স্বচ্ছতা রাখার কাজটি ব্যাংকগুলো নিজ দায়িত্বে করবে বলে জানান মি. ইসলাম।স্কিমের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ আদায় কার্যক্রম এই সময়ের পরও অব্যাহত থাকবে।

সূত্র : বিবিসি