ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থামাতে চীন কি করতে পারে?

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থামাতে চীন কি করতে পারে?

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থামাতে চীন কি করতে পারে?

মাসখানেক আগে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষণা দিয়েছিলেন যে রাশিয়ার সাথে চীনের নতুন করে আরো পাকাপোক্ত হওয়া সম্পর্কের মধ্যে কোন 'সীমা নেই'।

বেইজিং-এ ভ্লাদিমির পুতিন এবং শি জিনপিং মুখোমুখি সাক্ষাৎ করেছেন, গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন এবং একসাথে শীতকালীন অলিম্পিকস-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে গেছেন।

অলিম্পিকস শেষ হওয়ার কয়েকদিনের মাথাতেই ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া।চীনের সরকার এই হামলার নিন্দা অথবা সমর্থন কোনটিই করেনি, এমনকি আক্রমণ শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করেনি। চীন সবসময় বলে এসেছে তারা অন্য কারো আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলায় না। এটি তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি।

চীনের নীতিতে কি পরিবর্তন হচ্ছে?

কিন্তু এই সপ্তাহের শুরুর দিকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে চীন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত।

মি. ওয়াং ইউক্রেনের 'সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে চীনের পূর্ণ সমর্থন' ব্যক্ত করেছেন এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধে যতটুকু করা সম্ভব - তার জন্য চীন প্রস্তুত বলে তিনি ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন।ইউক্রেনে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের ঘটনায় 'অতিশয় উদ্বিগ্ন' উল্লেখ করে যুদ্ধের বিষয়ে 'দুঃখ' প্রকাশ করেছে চীনের সরকার।

কিন্তু চীন একই সাথে আরো একটি কাজ করেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার নিন্দা করে জাতিসংঘে যে প্রস্তাবনা পাশ হয়েছে - তাতে ভারতসহ যে ৩৪ টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল, চীনও তার একটি।অনেকেই এতে অবাক হয়েছেন। চীন রাশিয়ার পক্ষে ভোট দেবে এমনটাই মনে করা হয়েছিল। তাহলে চীনের নীতিতে কিছুটা হলেও কি পরিবর্তন এসেছে?

ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব এবং যাকে বলা হচ্ছে, 'নিরাপত্তা নিয়ে রাশিয়ার ন্যায়সঙ্গত উদ্বেগ', চীন সম্ভবত এই দুটি অবস্থানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে।সম্পর্ক আরো পাকাপোক্ত করতে, জোটবদ্ধ হতে পাঁচ হাজার শব্দের যে নথিতে শি জিনপিং এবং ভ্লাদিমির পুতিন স্বাক্ষর করেছেন সেটির দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে নেটোর সম্প্রসারণ প্রশ্নে তারা একমত।

যদিও এই চুক্তিতে কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন, মহাকাশ ও উত্তর মেরু অঞ্চলে একে অপরের কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা এরকম আরো অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত ছিল।এই চুক্তিকে বলা হচ্ছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চীন ও রাশিয়ার যৌথ লক্ষ্য ও স্বপ্ন যাতে দুপক্ষেরই পারস্পরিক স্বার্থ রয়েছে, যা অর্জনে দুপক্ষ একসাথে কাজ করবে।

তাইওয়ান প্রশ্ন

চীন কি কারণে রাশিয়া ও ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সখ্যতা পাকাপোক্ত করছে বা ইউক্রেনে হামলার নিন্দা করেনি, সেই প্রশ্নে আর একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় হল তাইওয়ান। একটি স্ব-শাসিত দ্বীপ, চীন যাকে নিজের অংশ বলে মনে করে এবং মাতৃভূমির সাথে যার পুনর্মিলন চায়।

মি. শি যদি সামরিক শক্তি দিয়ে সেটি অর্জন করার চেষ্টা করেন, তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধে যেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছে, সেই একই রকম বা আরো জোরালো নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দিক থেকে ।তাইওয়ান অবশ্যই ইউক্রেন নয়। অন্তত এই দুটি দেশের আইনগত অবস্থান এক নয়।

'নিরাপত্তা নিয়ে রাশিয়ার ন্যায়সঙ্গত উদ্বেগের' দাবিকে স্বীকৃতি, আবার একই সাথে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকেও সম্মান দেয়ার মাধ্যমে, ভবিষ্যতে তাইওয়ানে সম্ভাব্য কোন হামলা বিশ্বের কাছে যুক্তিসঙ্গত করে তোলা এবং তাতে রাশিয়ার সহযোগিতা পাওয়া, চীনের নেতা সম্ভবত এমন একটি ভবিষ্যৎ দেখছেন।এখানে আরো একটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে, আর তা হল মি. শি এবং মি. পুতিনের মধ্যেকার ব্যক্তিগত সখ্যতা। তারা দুজনে কমপক্ষে ৪০ বার সাক্ষাৎ করেছেন।

শীতকালীন অলিম্পিকসের সময় ভ্লাদিমির পুতিন যখন বেইজিং পৌঁছালেন তখন তিনি ছিলেন করোনাভাইরাসের আগমনের পরে চীন সফরে যাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বনেতা।দুজনকেই বলা হয় স্বৈরাচারী নেতা, যারা জনগণের আনুগত্য এবং মাতৃভূমির সাথে তাদের আরো গভীর সম্পর্ক সৃষ্টিতে একই রকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন।

শি জিনপিং চীনের এমন এক ভবিষ্যৎ দেখেন যেখানে দেশটির অর্থনীতি হবে আরো আত্মনির্ভর এবং সুবিশাল। তিনি কিছু বৈশ্বিক সম্পর্ক থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন হতে চান যা থেকে চীন সুবিধা পেয়ে এসেছে।রাশিয়ার সাথে নতুন করে আরো পাকাপোক্ত, সীমাহীন বন্ধুত্বের অর্থ এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্র, তার মিত্র এবং একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব ব্যবস্থা থেকে দুরে সরে যাওয়া।

চীন নিজেই বরং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সক্রিয়তা, জাতিসংঘে শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ, এসবের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে আরো বেশি যুক্ত হয়েছে।আভ্যন্তরীণ রাজনীতির কথাও চীনকে বিবেচনায় রাখতে হবে। ভোটের রাজনীতি নয় বরং যুদ্ধরত একটি দেশের সাথে সখ্যতার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

চীনা জনগণ কতটুকু জানবে এবং দেখবে সেটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু আজকের যুগে যুদ্ধের ভয়াবহতার প্রতিটি মুহূর্ত বিস্তারিত ধারণ করে রাখছে সোশাল মিডিয়া।রাশিয়ার ব্যাপারে কোন অবস্থানে থাকা উচিৎ সেই হিসেব নিকেশে এটিও সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে কাজ করছে।

শি জিনপিং এবং তার কাছের শীর্ষ নেতারা সম্ভবত এই উপসংহারে পৌছবেন যে সকল সম্পর্কের মধ্যেই সীমা থাকে এবং তাদের উচিৎ আরো দু-এক পা পিছু হটে মস্কোর সাথে বরং মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখা।এই ভূমিকা পালনে চীন প্রস্তুত, ইউক্রেনকে এমন ধারণাই দিয়েছে দেশটি কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেই পথে এগুনোর কোন লক্ষণ প্রদর্শন করেনি।

সূত্র : বিবিসি