ডায়রিয়া- কলেরার রেকর্ড সংখ্যক রোগী, চিকিৎসা সক্ষমতা কতটা আছে

ডায়রিয়া- কলেরার রেকর্ড সংখ্যক রোগী, চিকিৎসা সক্ষমতা কতটা আছে

ডায়রিয়া- কলেরার রেকর্ড সংখ্যক রোগী, চিকিৎসা সক্ষমতা কতটা আছে

ঢাকায় ডায়রিয়াসহ এ ধরণের রোগের মূল চিকিৎসা কেন্দ্র আইসিডিডিআরবিতে দৈনিক রেকর্ড সংখ্যক রোগী আসছে গত দু সপ্তাহ ধরে যাদের বেশিরভাগই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। তবে এদের অনেকের নমুনা পরীক্ষা করে কলেরা জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে।হাসপাতালটিতে দৈনিক সর্বোচ্চ ৬০০ রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও গত কিছুদিন দৈনিক প্রায় বারশো'র বেশি রোগী চিকিৎসার জন্য আসছে।

আইসিডিডিআরবির হেড অফ হসপিটাল ডাঃ বাহারুল আলম বলছেন, গত মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছিলো। কিন্তু ২২শে মার্চের পর থেকে বারশো/তেরশো করে রোগী আসছে প্রতিদিন এবং এ সংখ্যা এখনো কমেনি।"সাধারণ গরমের সময়ে ডায়রিয়া, কলেরা হয়। আমরা সেভাবে প্রস্তুতিই নেই। কিন্তু এবার একটু আগেই প্রকোপটা শুরু হয়েছে,"  বলছিলেন তিনি।

অথচ এর আগে কখনো এক সাথে এতো রোগী দেখেনি আইসিডিডিআরবি। বিশেষ ঢাকা মহানগর ও আশেপাশের এলাকায় যারা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের অনেকের দেহে কলেরার জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে।কিন্তু কেন এটি হচ্ছে বা এবার কলেরায় বেশি আক্রান্ত হওয়ার কারণ কী, সে সম্পর্কে অনুসন্ধান এখনো শেষ হয়নি।

"এখন আমরা চিকিৎসায় জোর দিচ্ছি এবং বেশিরভাগ রোগীকেই চিকিৎসা দিয়ে প্রয়োজনীয় উপদেশসহ বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারা ভালোও হচ্ছে। খুব জটিল যারা তাদের হাসপাতালে ভর্তি করছি এবং তারাও সুস্থ হচ্ছেন," বলছিলেন তিনি।এখানে বলে রাখা ভালো যে কলেরা একটি প্রাচীন রোগ এবং বিশ্বের ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ এ রোগের ঝুঁকিতে যার বেশিরভাগই দক্ষিণ এশিয়ায়।

কলেরা কেন হয় ?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলছেন, ডায়রিয়ার একটি ফর্ম হলো কলেরা, যার জীবাণু সাধারণত অপরিচ্ছন্ন খাবার বা দূষিত পানি থেকে আসে।"তবে এবার ঢাকায় বা এর আশে পাশে কেন কলেরা রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে সেটি গবেষণা ছাড়া বলা যাবে না। যদিও ডায়রিয়াটা এ সময়ে বেশি হয় পানির কারণেই। গরমে পানি কমে যাওয়ার ফলে রোগটার প্রকোপ বাড়ে," বলছিলেন মি. হোসেন।

বরগুনার করিমন নাহার সম্প্রতি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও পরে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন।তিনি বলছেন, প্রতি বছরই এই সময়ে তাদের এলাকায় অনেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন।নূরজাহান কুসুম নামে আরেকজন জানিয়েছেন, মূলত রান্না ও বাসন ধোয়ার কাজে তারা পুকুরের পানি ব্যবহার করেন।

"আমার ধারণা পুকুরের পানির কারণেই এবার আমরা পরিবারের সবাই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি। তবে কারও হাসপাতালে যেতে হয়নি। বাসাতেই চিকিৎসা নিয়েছি," বলছিলেন তিনি।চিকিৎসকরা বলছেন, কলেরার জন্য দায়ী একটি বিশেষ ব্যাকটেরিয়া এবং এই ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনটাই কলেরা।

কলেরার জীবাণুতে আক্রান্ত হলে শরীরে ডায়রিয়ার দেখা দেয় ও রোগী ক্রমাগত বমি করতে পারে। এছাড়া শরীরেও নানা লক্ষ্মণ দেখা দেয়। বিশেষ করে রোগী বারবার বমি ও মলত্যাগ করতে থাকে।এছাড়া রোগী পানির তৃষ্ণা বেড়ে যেতে পারে। আবার দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়া কিংবা হার্টবিট বেড়ে যেতে পারে অনেকের।

আবার অনেক রোগীর রক্তচাপও কমে যেতে দেখা যায়। আর কারও অবস্থা জটিল হয়ে গেলে কিডনি ফেইলিউর হলে, শকে চলে গেলে বা প্রস্রাব কমে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা গেলে মাইক্রো বায়োলজিক্যাল পরীক্ষার দরকার হয়।যেসব জেলায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি তার মধ্যে পটুয়াখালী একটি। সেখানকার সিভিল সার্জন সিভিল সার্জন ডা: এস এম কবির হাসান বলছেন, এ বছর খরা প্রবণতার কারণে পানি লবণাক্ত হয়ে গেছে বলে আগেই ডায়রিয়ার প্রকোপ শুরু হয়েছে।

"পটুয়াখালীতে গত জানুয়ারিতে দিনে ৩০-৩২ জন রোগী আসতো। সেখানে গত চব্বিশ ঘণ্টায় এসেছে ৭১ জন। আমরা সাধারণ লক্ষ্মণ বুঝে চিকিৎসা দেই। বেশিরভাগই সহজে ভালোও হয়ে যাচ্ছেন," বলছিলেন তিনি।আর কারও নমুনা পরীক্ষার দরকার হলে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়।

চিকিৎসার সক্ষমতা কতটা আছে?

ডাঃ বাহারুল আলম বলছেন, ডায়রিয়া এবং কলেরাসহ এ ধরণের রোগের চিকিৎসায় বাংলাদেশ বেশ ভালো অবস্থানে আছে।"সারা দেশেই এর চিকিৎসা আছে। এবং চিকিৎসকরাও এ বিষয়ে জানেন ও বোঝেন। আর কারও অবস্থা জটিল হলে তাদের জন্য আইসিডিডিআরবি ছাড়া ও সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আছে।

"চিকিৎসাটা জটিল কিছু নয়। শরীরে পানি শুন্যতা হয়। বেশি জটিলতা না থাকলে সেটাকেই বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঠিক করতে হয়। এ জন্য শিরায় স্যালাইন দিতে হয় এবং এটি যে কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই সম্ভব," বলছিলেন তিনি।স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে আসার পর বেশিরভাগ রোগী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই স্থিতিশীল হচ্ছেন বলে জানান তিনি।ডাঃ মুশতাক হোসেন বলছেন, প্রতিটি হাসপাতালে এ সংক্রান্ত কর্নার আছে যেখানে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী ও স্যালাইনসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা আছে।

তবে ডায়রিয়ার এমন চিকিৎসা দেশজুড়ে থাকলেও যারা কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য মাইক্রো বায়োলজিক্যাল যে ল্যাবরেটরি থাকা দরকার সেটি দেশের উপজেলা কেন্দ্রগুলোতে নেই বলে জানিয়েছেন একাধিক সিভিল সার্জন।ফলে কেউ কলেরায় আক্রান্ত হলে নমুনা সরকারি মেডিকেল কলেজ বা বিভাগীয় পর্যায়ে বড় হাসপাতালগুলোতে পাঠাতে হয়।দেশে এখন ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আছে।

চলমান প্রকোপ ঠেকাতে বিশেষ ব্যবস্থা

কলেরা শনাক্ত করতে আইসিডিআরবির বিজ্ঞানীরা স্থানীয়ভাবে কলকিট নামের একটি ডিপস্টিক তৈরি করেছে।এটি এমন একটি পরীক্ষা পদ্ধতি বা মলের নমুনা যুক্ত টিউবের মধ্যে ডুবালে পনের মিনিটের মধ্যেই ফল দেখা যায়।

প্রসঙ্গত কলেরা নির্ণয় করার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো গবেষণাগারে মল কালচার পরীক্ষা করা।ডাঃ বাহারুল আলম জানিয়েছেন যে এবার ডায়রিয়ার প্রকোপ শুরুর পর দু'দফায় সিনিয়র চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে আইসিডিডিআরবি।

এসব চিকিৎসকরাই আবার কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে তাদের সহকর্মী চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেবেন।"গতকাল ও আজ বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফার প্রশিক্ষণ হলো সরকারি ডাক্তারদের নিয়ে। দু'দফায় বেশ কিছু সংখ্যক চিকিৎসক এ প্রশিক্ষণ পেলেন। এটা চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সহায়ক হবে বলে আশা করছি আমরা," বলছিলেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি