ভারত থেকে কেন মানুষের চুল পাচার করা হচ্ছে বাংলাদেশে?

ভারত থেকে কেন মানুষের চুল পাচার করা হচ্ছে বাংলাদেশে?

ভারত থেকে কেন মানুষের চুল পাচার করা হচ্ছে বাংলাদেশে?

ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচারের সময় মানুষের একশো কেজির বেশি মানুষের চুল আটক করেছে সেদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআই জানাচ্ছে, মেঘালয় সীমান্ত এলাকা থেকে একশো কেজি চুল বাংলাদেশে পাচার করার সময় জব্দ করে বিএসএফ।

সংস্থাটি বলছে, ভারত থেকে কাটা বা ফেলে দেয়া চুল পাচারের ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে ছাড়িয়ে নতুন ট্রানজিট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এসব চুল পরবর্তীতে চীনে চলে যাচ্ছে বলে তারা দাবি করেছে।এর আগে বিভিন্ন ধরণের পণ্য বা মাদক পাচারের কথা শোনা গেলেও, মানুষের চুল পাচারের এ ঘটনা অনেকটাই অভিনব।মানুষের চুলের মত একটি পণ্য বাংলাদেশে পাচারের পেছনে কী কারণ রয়েছে? এই বিষয়টি অনুসন্ধান করেছে বিবিসি বাংলা।

'উইগ' বা পরচুলার বিশাল শিল্প

বাংলাদেশের শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশকে বাংলাদেশে উইগ বা পরচুলার বিশাল শিল্প গড়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে এই শিল্পে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করছেন।কাটা বা ফেলে দেয়া চুল সংগ্রহ করে উইগ বা পরচুলা তৈরি করা হয়। এসব পরচুলার দেশের ভেতরে যেমন চাহিদা রয়েছে, তেমনি চীন, কোরিয়া, তাইওয়ান-সহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।

এরকম একটি উইগ তৈরির কারখানা, হেয়ারি উইগের মালিক মতিউর রহমান ২২ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। তিনি বলছেন, ''গত কয়েক বছরে আমাদের এখানে উইগের বিশাল শিল্প তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতিদিন এক হাজার কেজির বেশি চুল আমাদের দরকার হয়।""কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, দেশের ভেতর থেকে এর মাত্র ২০ বা ৩০ শতাংশ সংগ্রহ করা যায়" - বলেন তিনি।

ঢাকার কলাবাগানের একটি বিউটি পার্লারের মালিক তাহমিনা আক্তার বলছেন, ''বড় চুল কাটা হলে মেয়েরা সংগ্রহ করে রাখে। প্রতি সপ্তাহেই লোকজন এসে এই চুল নিয়ে যায়। আমরা আগে ঝাড়ু দিয়ে চুল ফেলে দিলেও এখন অবশ্য সংগ্রহ করে রেখে দেই।''অনেকেই ফেরি করে স্যালুন বা বিউটি পার্লার থেকে ফেলে দেয়া চুল সংগ্রহ করেন। এমনকি পাড়া বা মহল্লায় চুল কিনতে ফেরিওয়ালাদের ঘুরতেও দেখা যায়।

তারা এসব চুল সংগ্রহ করে উইগ বা পরচুলা তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করেন। রাজশাহী নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গাসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক জায়গাতে ফেলে দেয়া চুল হয়ে উঠেছে অনেকের রোজগারের উৎস।কাটা চুল কেজি প্রতি তিন-চার কিংবা ৫০০০ টাকাতেও বেচা-কেনা চলছে। তবে চুলের আকার হতে হবে আট ইঞ্চি লম্বা।বর্তমানে কোনও কোনও কোম্পানি এই চুল আইল্যাশ বা চোখের পাপড়ি তৈরিতে ব্যবহার করছে।

কিন্তু চাহিদার পুরোটা পূরণ না হওয়ার কারণে চুলের চাহিদার বড় যোগান আসে ভারত থেকে। সাধারণত প্রতি কেজি চুলের দাম পড়তো প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা, তার সঙ্গে সরকারি শুল্ক যোগ হতো।কিন্তু এই বছরের জানুয়ারি মাসে চুল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত।

মতিউর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ''করোনাভাইরাসের কারণে চীনের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশে থেকে অর্ডার পেয়েছিল। তারা সেসব মালামালের জন্য বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে। আমাদের কাছ থেকে উইগ ও চুলের নানা পণ্য কিনে নিয়ে তারা সরবরাহ করছে। গত কিছুদিন ধরে চীন থেকে প্রচুর উইগের অর্ডার আসছে বাংলাদেশে। ফলে এখানেও কাঁচামালের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। ''ভারত থেকে রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় কাঁচামালের জন্য ব্যবসায়ীরা কালোবাজারের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছেন। আর এই কারণেই ভারত থেকে অবৈধ পথে বাংলাদেশে চুলের পাচারও বেড়েছে।

কারখানা চীনে, কাঁচামাল ভারতে

অবজারভেটরি অফ ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির তথ্য অনুযায়ী, কাঁচামাল হিসাবে মানব চুল আমদানিতে শীর্ষ দেশ চীন, অন্যদিকে রপ্তানিতে শীর্ষ দেশ ভারত।

বাংলাদেশে উইগ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ভারত কাঁচামাল হিসাবে চুলের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় সংকটে পড়েছে চীনে উইগ শিল্প। ফলে একদিকে তারা নির্ধারিত সময়ে অর্ডার সরবরাহ করতে বাংলাদেশ থেকে উইগ তৈরি করে ক্রেতাদের কাছে দিচ্ছেন। অন্যদিকে নিজেদের কারখানার জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে পরিত্যক্ত চুল সংগ্রহ করছে।

রপ্তানি নিষিদ্ধ থাকায় চোরাচালানের মাধ্যমে এসব চুল ভারত থেকে পাচার হয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে আসছে। সেখান থেকে কুরিয়ার ও নানা হাত ঘুরে চীনে পাচার হয়ে যাচ্ছে।চীনেও উইগের বিশাল শিল্প থাকায় তারা কাঁচামালের সংকটে ভুগছে। কারণ বিশ্বে মানব চুলের বড় বাজার ভারত। কিন্তু ভারতে রপ্তানি বন্ধ থাকায় চোরাপথে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে চুল নিয়ে আসার পর তা কিনে নিচ্ছে চীনের ব্যবসায়ীরা।

এসব কারণে বাংলাদেশে পরিত্যক্ত চুলের চাহিদা হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে উইগ ও চুল কিনছে থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার উৎপাদকরাও। এ কারণে গত কয়েক মাসে ভারত থেকে বাংলাদেশে চুলের চোরাচালানও অনেক বেড়েছে।ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত সীমান্তে চোরাচালানের সময় যে পরিমাণ চুল আটক হয়েছে, তা পাচারের আসল পরিমাণের তুলনায় অনেক নগণ্য।

একজন ব্যবসায়ী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ''আমাদের কারখানা তো চালু রাখতে হবে। হাজার হাজার মানুষ এখানে কাজ করছে। বাধ্য হয়ে তাই চড়া দাম দিয়ে কালোবাজার থেকে চুল কিনছি। কারণ যতো অর্ডার আসছে, তার জন্য পর্যাপ্ত চুল দেশের ভেতরে পাওয়া যায় না।''রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তালিকায় উইগ এবং হিউম্যান হেয়ারকে অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে বলা হচ্ছে। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ৫৫ লাখ ডলারের বেশি এ ধরণের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।তবে কাঁচামাল হিসাবে চুলের এই সংকটের বিষয়ে অবগত নয় বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো।

ব্যুরোর মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''উইগ শিল্প গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে অনেক বড় হয়েছে। এর সঙ্গে যারা রয়েছেন, তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আমাদের মিটিং হয়,কথা হয়। তারা কিন্তু কখনো আমাদের কাঁচামাল হিসাবে চুলের সমস্যায় পড়েছেন, তা বলেননি। সেটা জানালে তো অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।''

সূত্র : বিবিসি