নেটফ্লিক্স পাসওয়ার্ড শেয়ার নিষিদ্ধ করলে গ্রাহকরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন?

নেটফ্লিক্স পাসওয়ার্ড শেয়ার নিষিদ্ধ করলে গ্রাহকরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন?

নেটফ্লিক্স পাসওয়ার্ড শেয়ার নিষিদ্ধ করলে গ্রাহকরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন?

ভিডিও স্ট্রিমিং সেবা প্রতিষ্ঠান নেটফ্লিক্স বলেছে, যেসব ব্যবহারকারী পাসওয়ার্ড শেয়ার করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে তারা। সম্প্রতি গ্রাহক সংখ্যা কমে যাওয়ায় এই ধরণের পদক্ষেপ নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।প্রতিযোগিতা বাড়ায় এ বছরের প্রথম তিন মাসে নেটফ্লিক্স ব্যবহার করা পরিবারের সংখ্যা কমেছে দুই লাখ।রাশিয়া থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়া এবং সেবার মূল্য বাড়ানোর কারণে গ্রাহকের সংখ্যা কমেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

নেটফ্লিক্স তার অংশীদারদের সতর্ক করেছে যে, আগামী তিন মাসে আরো দুই লাখ গ্রাহক তাদের সেবা নেয়া বন্ধ করে দিতে পারে।মঙ্গলবার বছরের প্রথম তিনমাসের অর্থনৈতিক প্রতিবেদন প্রকাশ করার সময় প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারহোল্ডারদের জানায়: "আমাদের আয়ের বৃদ্ধি যথেষ্ট কমেছে।"

"পরিবার প্রতি আমাদের উচ্চ গ্রাহক হার থাকলেও বিপুল সংখ্যক অ্যাকাউন্ট শেয়ার হওয়ায় ও প্রতিযোগিতার কারণে আমাদের আয় বৃদ্ধির হার কমেছে।"নেটফ্লিক্সের অনুমান, পাসওয়ার্ড শেয়ার করার মাধ্যমে অন্তত ১০ কোটি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম ভাঙছে।

নেটফ্লিক্সের প্রধান নির্বাহী রিড হেস্টিংস এর আগে বলেছিলেন যে এই প্রবণতা 'স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে হবে' এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পাসওয়ার্ড শেয়ার করা 'ন্যায্য।'তখন প্রতিষ্ঠানটি ধারণা প্রকাশ করেছিল যে অ্যাকাউন্ট শেয়ার করার কারণেই নেটফ্লিক্সের দর্শক সংখ্যা বেড়েছে এবং এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে।

তবে মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মি. হেস্টিংস জানিয়েছেন যে কিছু কিছু দেশে নতুন গ্রাহক আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে নেটফ্লিক্স।শেয়ারহোল্ডারদের উদ্দেশ্যে মি হেস্টিংস বলেন, "যখন আমরা দ্রুতহারে উন্নতি করছিলাম, অ্যাকাউন্ট শেয়ারিংয়ের বিষয়টি তখন অগ্রাধিকার ছিল না। কিন্তু এখন আমার এটি নিয়ে গুরুত্বের সাথে কাজ করছি।"

প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে যে ল্যাটিন অ্যামেরিকায় পাসওয়ার্ড শেয়ার বন্ধ করার বিষয়ে তারা কাজ করছে, যা অন্যান্য দেশেও বাস্তবায়ন করা হতে পারে।গত মাস থেকে চিলি, কোস্টারিকা ও পেরুর নেটফ্লিক্স ব্যবহারকারীদের জন্য পরিবারের বাইরে কাউকে পাসওয়ার্ড শেয়ার করা নিষিদ্ধ করেছে কর্তৃপক্ষ।

ল্যাটিন অ্যামেরিকার দেশগুলোতে একটি অ্যাকাউন্টে নিয়মিত ফি থেকে মাসে দুই থেকে তিন ডলার বেশি দিয়ে অতিরিক্ত দু'জন ব্যবহারকারীর প্রোফাইল যোগ করা যায়।তবে এই পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেসম্পর্কে পরিষ্কার করে কিছু জানায়নি নেটফ্লিক্স।

নেটফ্লিক্সের প্রধান পণ্য কর্মকর্তা গ্রেগ পিটারস বলেছেন, "আমাদের হাতে থাকা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হল, যারা নিজেদের পরিবারের বাইরে এই পাসওয়ার্ড শেয়ার করতে চায় তাদের কাছ থেকে কিছুটা বেশি ফি নিতে চাওয়া।"তবে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কানটারের গবেষক ডমিনিক সুনেবোর মতে বর্তমান সময়ে এই পরিকল্পনা হিতে বিপরীত ফল নিয়ে আসতে পারে কারণ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে মানুষ এখন টাকা বাঁচানোতে বেশি আগ্রহী।

"পাসওয়ার্ড শেয়ার করার বিরুদ্ধে নেয়া পরিকল্পনা যদি অতি আগ্রাসী ভাবে বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ গ্রাহক হারানোরও সম্ভাবনা তৈরি হয়। কারণ পরিবারের বাইরে যারা পাসওয়ার্ড শেয়ার করে, তাদের অনেকে জানেনই না যে তারা সাবস্ক্রিপশনের শর্ত ভঙ্গ করছেন।"

বিশ্বব্যাপী গ্রাহক হ্রাস

নেটফ্লিক্স জানিয়েছে যে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের কারণে মার্চে রাশিয়া থেকে কার্যক্রম উঠিয়ে নেয়ার পর তাদের সাত লাখ গ্রাহক কমে গেছে।এছাড়া জানুয়ারিতে সেবার মূল্য বৃদ্ধি করার পর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার আরো ছয় লাখ গ্রাহক কমে গেছে তাদের।যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের ব্যবহারকারীদের জন্যও সেবার মূল্য বৃদ্ধি করেছে নেটফ্লিক্স।

নেটফ্লিক্স জানিয়েছে, গ্রাহকের সংখ্যা কমলেও মূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রতিষ্ঠানটির মোট আয় বাড়বে। তবে জীবনযাপনের ব্যয় বাড়ার সাথে সাথে স্ট্রিমিং সার্ভিসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক পরিবারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।যুক্তরাজ্যে এ বছরের প্রথম তিন মাসে ১৫ লাখের বেশি পরিবার স্ট্রিমিং সেবা নেয়া বন্ধ করেছে, যাদের মধ্যে ৩৮% বলছে যে তারা টাকা বাঁচানোর লক্ষে এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

বাংলাদেশের নেটফ্লিক্স গ্রাহকরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন?

নেটফ্লিক্স আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে থাকা দর্শকদের জন্য তাদের সেবা শুরু করে ২০১৬ সালে।বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন ও রেগুলেটরি বোর্ড, বিটিআরসি'র ২০২০ সালের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশি গ্রাহকদের কাছ থেকে বছরে দুই কোটি ডলারেরও বেশি আয় করে নেটফ্লিক্স।বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২০২০-এর হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে নেটফ্লিক্সের গ্রাহক সংখ্যা দুই লাখের কিছু বেশি।আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে নেটফ্লিক্সের চার ধরনের অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন গ্রাহকরা।

এই অ্যাকাউন্টগুলোর মাসিক খরচ ৩.৯৯ ডলার থেকে ১১.৯৯ ডলার পর্যন্ত। এর মধ্যে মাসিক ১১.৯৯ ডলারের প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে আলাদা আলাদা ডিভাইস থেকে একসাথে সর্বোচ্চ চারজন ব্যবহারকারী ভিডিও দেখতে পারেন।তবে ব্যবহারকারীদের মধ্যে কেউ কেউ একজনের ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড শেয়ার করে একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করে থাকেন।

যেমন কুমিল্লার বাসিন্দা তওফিক আহমেদ গত বছর নেটফ্লিক্সের মোবাইল সেবার সাবস্ক্রিপশন নিয়েছিলেন, যেটিতে মাসিক খরচ হয় প্রায় সাড়ে তিনশো টাকা।কিন্তু কিছুদিন পরেই তিনি খেয়াল করেন যে দিনের একটা লম্বা সময় যখন তিনি তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তখন এই সেবাটি অব্যবহৃত পড়ে থাকে।

তওফিক আহমেদ বলেন, "যখন দেখলাম দিনের অধিকাংশ সময়ই আসলে নেটফ্লিক্স ব্যবহার করা হয় না, তখন আমি আমার বন্ধুর সাথে পাসওয়ার্ড শেয়ার করি। ফলে যে যখন ফ্রি থাকি তখন সে দেখে, আবার আমার ফ্রি সময়ে আমি দেখি।""আর দুইজন ব্যবহার করায় খরচটাও ভাগাভাগি করা যায়, ফলে দু'জনেরই সুবিধা হয়।"এভাবে চারজনের জন্য নির্ধারিত প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্টও অনেকে ব্যবহার করছেন, এরকম নজির রয়েছে।

যেমন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাজিফা নূর তার বন্ধুদের সাথে মিলে চারজনের একটি প্রিমিয়াম অ্যাকাউন্ট নিলেও বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই ঐ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে নেটফ্লিক্সে ভিডিও দেখে থাকেন।নাজিফা বলছিলেন, "বন্ধুদের অনেকের কাছেই অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড আছে। একসাথে চারজনের বেশি লগ ইন না করলেই যেহেতু কোনো সমস্যা নেই, তাই আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে যার যার সুবিধামত এটি ব্যবহার করি।"

নেটফ্লিক্স পাসওয়ার্ড শেয়ার করার সুযোগ বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশে এরকম গ্রাহকদের অনেকেই এই সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।তবে গ্রাহকদের অনেকে মনে করেন নেটফ্লিক্স পাসওয়ার্ড শেয়ার করার সুযোগ বন্ধ করে দিলে অন্যান্য ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিসের দিকে ঝুঁকবে গ্রাহকরা।

বাংলাদেশে বর্তমানে নেটফ্লিক্স ছাড়া অন্য কোনো বিদেশি ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা না করলেও অ্যামাজন প্রাইম, জি ফাইভ, হটস্টার সহ বেশ কয়েকটি ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সেবা অনানুষ্ঠানিক ভাবে নিয়ে থাকেন অনেকেই।বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সাদিয়া মুফতাহিম বলছিলেন যে নেটফ্লিক্স পাসওয়ার্ড শেয়ারের সুযোগ বন্ধ করে দিলে তিনি সম্ভবত তাদের সেবা আর ব্যবহার করবেন না।

"আমি নেটফ্লিক্সের পাশাপাশি অ্যামাজন প্রাইম ও জি ফাইভও ব্যবহার করি। নেটফ্লিক্স যদি পাসওয়ার্ড শেয়ার অপশন বন্ধ করে দেয় তাহলে শুধু শুধু বেশি টাকা খরচ করে কেন নেটফ্লিক্স রাখবো?"মিজ মুফতাহিমের মতে, নেটফ্লিক্স পাসওয়ার্ড শেয়ারের সুযোগ না দিলেও তার খুব একটা ক্ষতি হবে না, কারণ নেটফ্লিক্সের বদলে একাধিক ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সেবা অপেক্ষাকৃত কম অর্থ খরচে তখন তিনি পেতে পারবেন।

নেটফ্লিক্স যেভাবে সমন্বয় করার পরিকল্পনা করছে

পাসওয়ার্ড শেয়ারের সুবিধা বন্ধ করে দিলে বিশ্বব্যাপী গ্রাহক কমবে বলে আশঙ্কা করছে নেটফ্লিক্স কর্তৃপক্ষও।প্রধান নির্বাহী রিড হেস্টিংস তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ডিজনি ও এইচবিওর মত একটি বিজ্ঞাপন ভিত্তিক সেবাও চালু করার কথা চিন্তা করছে।বিশ্লেষকরা মনে করেন এর ফলে নেটফ্লিক্সের আয়ের নতুন একটি পথ খুলবে। নেটফ্লিক্স এতদিন কোনো ধরণের বিজ্ঞাপন গ্রহণ করতো না।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নেটফ্লিক্সের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যামাজন, অ্যাপল ও ডিজনির মত ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো, যারা তাদের স্ট্রিমিং সার্ভিসের পেছনে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করছে।২০১১ সালের অক্টোবর থেকে বিশ্বের শীর্ষ স্ট্রিমিং সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সের গ্রাহক সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও ত্রৈমাসিক হিসেবে এ বছরের প্রথম তিন মাসে প্রতিষ্ঠানটির লাভের পরিমাণ আগের তিন কোয়ার্টারের চেয়ে কম হয়েছে।

সূত্র : বিবিসি