বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসার গাইডলাইন

বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসার গাইডলাইন

বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসার গাইডলাইন

বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সিজোফ্রেনিয়ার রোগের চিকিৎসার জন্য একটা গাইডলাইন করেছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইক্রিয়াট্রিস্ট।

এই গাইডলাইন অনুযায়ী সঠিকভাবে চিকিৎসা করলে ৫০ শতাংশ রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে বলে চিকিৎসকরা দাবি করছেন।

কী আছে গাইডলাইনে

২৪শে এপ্রিল রবিবার বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইক্রিয়াট্রিস্ট এই গাইডলাইনটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া।বিশেষজ্ঞ বলছেন সিজোফ্রেনিয়া একটা জটিল মানসিক রোগ।

মানসিক রোগের মধ্যে এটাই সবচেয়ে জটিল এবং এটার চিকিৎসাও জটিল।এই রোগ পুরুষ নারী উভয়ের সমানভাবে হয়। তবে পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।বাংলাদেশে প্রতি একশ জনের মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত হয়।বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইক্রিয়াট্রিস্ট বলছে রোগটা নিয়ে মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণাও রয়েছে।

সব দিক বিবেচনা করে তারা এই গাইডলাইন করেছে :

১.চিকিৎসকদের চিকিৎসার মধ্যে অসামঞ্জস্য ছিল। যারা এই রোগের চিকিৎসা করবে তারা যেন আন্তর্জাতিক মান যেটা ঠিক করা আছে সেটা ফলো করে চিকিৎসা করেন,এবং এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন।

২.নন স্পেশালিষ্ট যারা চিকিৎসক আছেন তাদের ভূমিকা কি হবে সেটা ঠিক করা।

৩. সোশ্যাল সার্পোটের ব্যবস্থা করা।

৪. এই রোগ কী তা জানাতে এবং চিকিৎসার ভূমিকা বাড়াতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া।

সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে অসচেতনতা

চিকিৎসকরা বলছেন ২০ বছর বয়সের শুরুর দিকে এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয় মানুষ । ৪৫ এর পর কমে যায়। ৫০ বছরে পর আর হয় না। ৫৫ বছরের পর নতুন করে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা খুব কম।ঢাকার ধানমন্ডি থাকেন অপরাজিতা (এখানে তার ছদ্ম নাম ব্যবহার করা হচ্ছে)। তার মেয়ের বয়স ২৫ এর উপরে।

অপরাজিতা যখন থেকে বুঝতে পারেন তার মেয়ে তার বয়সী অন্য মেয়েদের মত আচরণ করছে না বা আচার-আচরণে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করছেন তখন বেশ চিন্তিত হয়ে পরেন।প্রথম দিকে বুঝতে পারেন নি, ফলে নানা রকমের চিকিৎসা করেছেন।পরিণতিতে অবস্থা আরো খারাপ হয়। পরে তিনি জানতে পারেন তার মেয়ে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত।

অপরাজিতা বলেন "এখন মেয়ের দেখাশোনা আমিই করি। কখন উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে, কখন তার মুড পরিবর্তন হচ্ছে সব খেয়াল করি। আর ডাক্তারের দেয়া প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ খাওয়াই।"তিনি আক্ষেপ করে বলেন "আমার মেয়ের এই রোগটা অনেক দেরিতে ধরা পড়েছে। ফলে তার শৈশবটা কেটেছে মায়ের থেকে দুরে। খালাদের কাছে। অনেকে নানা কথা বলতো। তাই সঠিক চিকিৎসা পায়নি দীর্ঘদিন।"

সিজোফ্রেনিয়া কি?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণগুলি হল ডিলুশন এবং হ্যালুসিনেশন অর্থাৎ ভুল ধারণা, অবাস্তব চিন্তাভাবনা, অকারণ সন্দেহ, বিভ্রান্তি, বিড়ম্বনা ইত্যাদি।সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত সব রোগীর লক্ষণ এক হয় না। লক্ষণগুলি রোগীর ওপর নির্ভর করে।

কোনও কোনও রোগীর ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণগুলি কয়েক মাস বা বছর ধরে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করতে পারে বা হঠাৎ করে দেখা দিতে পারে।এই গাইডলাইন তৈরির যে ওয়ার্কিং কমিটি তার একজন সদস্য ডা. মো. ফারুক হোসেন বলেন, এই রোগের কিছু লক্ষণ হল :

১ রোগী এমন কিছু শুনতে পায় বা দেখতে পায় যেটা বাস্তবে থাকে না

২ কথা বলা বা লেখায় অদ্ভুত বা অযৌক্তিক ধরন, আচরণ

৩ গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে উদাসীন বোধ করা

৪. নিজের যত্ন নেয়ার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়া

৫.কোন কাজে মনযোগ না থাকা

৬. আবেগ ,অনুভূতি কমে যায়।

সিজোফ্রেনিয়ার কারণ :

এই রোগের সঠিক কারণ জানা যায়নি। তবে, যে যে কারণগুলিকে এই রোগের জন্য দায়ী করা হয়, সেগুলি হল- জেনেটিক বা বংশগত এই রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও দেখা যায়। বাবা, মা-এর কারো এই রোগ থাকলে সন্তানেরও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চিকিৎসকরা বলছেন জেনেটিক ইনফ্লুয়েন্স থাকে ৮০ শতাংশ। বাবা- মা দুজনের এই রোগ থাকলে সন্তানের হওয়ার সম্ভাবনা ৪০গুন বেড়ে যায়। জমজ বাচ্চার একজনের থাকলে আরেকজনের ঝুঁকি ৫০ গুন বেশি থাকে।এছাড়া সন্তান মাতৃগর্ভে থাকার সময় কোন সমস্যা হলে বা জন্মের সময় কোন ক্ষতি হয় বা অক্সিজেনের অভাব হলে এই রোগ হতে পারে। চাইল্ডহুড ট্রমা , সেনসেটিভ পারসোনালাটি হলে তার সঙ্গে কোন ভয়াবহ ঘটনা ঘটলে ঐ ব্যক্তির সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে।

চিকিৎসা কী:

ডা. মো. ফারুক হোসেন বলেন ওষুধ দিয়েই মূলত নিয়ন্ত্রণ করা হয় রোগটিকে।"প্রথমে সাইকো এন্টি সাইকোটিক মেডিসিন। এরপর সাইকোথেরাপির দিকে যেতে হয়। ৮০ভাগ রোগি কিছু দিন ভালো কিছু দিন খারাপ থাকে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভালো হয় না। বাকি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ঠিক হয়ে যায়।"

তিনি বলেন , এই রোগীদের মৃত্যুর হার বেশি কারণ তাদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দেয়। "পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ সুইসাইড করে।"বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইক্রিয়াট্রিস্ট বলছে এই গাইডলাইন কার্যকর করার জন্য প্রশাসনিক , লজিস্টিক সার্পোট লাগবে। তার জন্য মন্ত্রণালয়ের সাহায্য লাগবে। চিকিৎসকরা বলছেন, যেকোন উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে একটা আন্তর্জাতিক মানের গাইডলাইন করা হয়েছে এটা।

সূত্র  : বিবিসি