ডিএনএ পরীক্ষায় পরিচয় বের করতে কেন অনেক সময় লাগে?

ডিএনএ পরীক্ষায় পরিচয় বের করতে কেন অনেক সময় লাগে?

ডিএনএ পরীক্ষায় পরিচয় বের করতে কেন অনেক সময় লাগে?

সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপো অগ্নিকাণ্ডে যে ৪১ জন নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে এখনো ১৭ জনের পরিচয় জানা যায়নি। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের পরিচয় বের করা হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

ডিএনএ পরীক্ষার জন্য তাদের নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগ।চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বুথ স্থাপন করে গত দুইদিনে ৩৯ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ খালেদ বলেছেন, যারা নিখোঁজ রয়েছেন স্বজনরা জানিয়েছেন, সোমবার তাদের মোট ৩৭ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। আর কেউ যদি নিখোঁজ থাকেন, তাদের স্বজনরা আমাদের এখানে এসে নমুনা দিতে পারবেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মরদেহের নমুনা সংগ্রহ করা হবে।

প্রতিটি পরিবারের দুইজনের কাছ থেকে নমুনা হিসাবে রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে অন্তত একমাস সময় লাগতে পারে বলে তিনি জানান।ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে কীভাবে পরিচয় যাচাই করা হয়? সেটি শেষ হতে কেন একমাস সময় লাগবে বলে কর্মকর্তারা বলছেন?

ডিএনএ প্রোফাইলিং কী?

প্রতিটি প্রাণীর শরীরে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিয়িক অ্যাসিড হচ্ছে একটি নিউক্লিক অ্যাসিড, যেখানে ডিএনএ জিনোম থাকে। একে জীবনের নীলনকশা বলেও বর্ণনা করা হয়। কারণ এর ভেতরে জীবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণের জিনগত সব তথ্য থাকে।প্রতিটি জীবের ডিএনএ-র ধরন আলাদা হয়ে থাকে। ফলে কারও ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা গেলে তার জিনগত তথ্য পাওয়া যায়।বিজ্ঞানীরা বিশেষ যন্ত্র ও পদ্ধতির মাধ্যমে এই ধরন শনাক্ত করে থাকেন।

ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে কীভাবে পরিচয় শনাক্ত করা হয়?

প্রতিটি মানুষের ডিএনএ আলাদা হলেও তার বাবা-মা, সন্তান, বা ভাই-বোনের সঙ্গে কিছুটা মিল থাকে। বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে ডিএনএ জিনোমের এই মিল শনাক্ত করে তাদের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়।চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে আগুনের ঘটনায় এখনো ১৭ জনকে শনাক্ত করা যায়নি। তাদের মৃতদেহ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি রুমানা আক্তার বলছেন, ''আগুনে যে মৃতদেহগুলো অনেক বেশি পুড়ে গেছে, তাদের হাড়, দাঁত বা কংকাল নমুনা হিসাবে সংগ্রহ করা হয়। আবার কারও শরীরে টিস্যু পাওয়া গেলে টিস্যুও সংগ্রহ করা হয়।''

সেই সঙ্গে স্বজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে যারা দাবি করছেন, তাদের শরীর থেকে নমুনা হিসাবে রক্ত নেয়া হয়ে থাকে। স্বজনদের নমুনা নেয়ার ক্ষেত্রে নিহতদের বাবা-মা বা সন্তানদের প্রাধান্য দেয়া হয়। কিন্তু এরকম পাওয়া না গেলে ভাই-বোনেরও নমুনা নেয়া হয়ে থাকে।এগুলো সিআইডি ল্যাবে আসার পরই পরীক্ষার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।

প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি রুমানা আক্তার বলছেন, ''শুধুমাত্র রক্ত বা মুখের লালা পরীক্ষার মাধ্যমে ডিএনএ পরিচয় বের করতে আট থেকে ১০ দিন লাগে। কিন্তু হাড় বা দাঁত থেকে কারও ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করতে অন্ততপক্ষে চার সপ্তাহ সময় লাগে। সেখানে মিল না পাওয়া গেলে আবার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে হতে পারে। তাতে আরও বেশি সময় লাগতে পারে।''

এজন্য ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ, কাগজপত্র তৈরি করা, পরীক্ষার নানারকম ধাপ পার হয়ে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এই সময় দরকার হয় বলে তিনি জানান।

''হয়তো একটি ডেডবডি থেকে টিস্যু নিয়েছে, হাড় নিয়েছে, দাঁত নিয়েছে। প্রথমে হয়তো আমরা টিস্যু নিয়ে কাজ শুরু করলাম। সেটা ব্যর্থ হলে হাড় নিয়ে কাজ শুরু করি। সেটাও কাজ না করলে দাঁত নিয়ে প্রোফাইলিং শুরু করি। চকবাজার আগুনের ক্ষেত্রে প্রোফাইলিং শেষ করতে আমাদের বেশ সময় লেগে গিয়েছিল,'' তিনি বলছেন।

মৃত ব্যক্তির ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়ার পর সেটা কম্বাইন্ড ইনডেক্সিং ডিএনএ সফটওয়্যার বা কোডিস নামের একটি সফটওয়্যারে প্রবেশ করানো হয়। সেই সঙ্গে যারা নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবি করছেন, তাদের ডিএনএ প্রোফাইল তৈরির পর সেটাও সংরক্ষণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআই এই সফটওয়্যারটি সিআইডিকে দিয়েছে।

এরপর এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে মিলিয়ে দেখা হয় যে, স্বজন হারানো দাবিদার কারও সঙ্গে নিহত ব্যক্তির ডিএনএ মিলছে কিনা। কারও ডিএনএ মিলে গেলে তার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে যায়।

কিন্তু কারও ডিএনএ না মিললে আবার নতুন করে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়। মৃতদেহের অন্য অংশের নমুনা সংগ্রহ, নিখোঁজ দাবিদারদের ভাই-বোন বা অন্য স্বজনদের নমুনাও তখন সংগ্রহ করা হয়।২০১৪ সালে ডিএনএ পরীক্ষা শুরু করে সিআইডি। তবে তার আগে থেকে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের একটি ডিএনএ ল্যাব ২০০৬ সাল থেকে কাজ করছে, যেটি ঢাকা মেডিকেল কলেজে রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক শরীফ আখতারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, পুরো প্রক্রিয়ার সময় নির্ভর করে কী ধরনের নমুনা থেকে ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছে, কতগুলো স্যাম্পল পরীক্ষা করা হচ্ছে, তার ওপরে।''মুখের লালা বা রক্ত পরীক্ষা করে ডিএনএ প্রোফাইল করতে গেলে আট থেকে ১০ দিনের মধ্যে সেটা করতে পারা সম্ভব।

কিন্তু মৃতদেহ থেকে নেয়া বা পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ থেকে নেয়া নমুনার ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষা সম্পন্ন করতে সময় বেশি লাগে। বাবা-মা, সন্তানদের সঙ্গে ডিএনএ না মিললে ভাই-বোনদের কাছ থেকে নমুনা নিতে হবে। তখন সেটা আরও কঠিন আর সময়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে,'' বলছেন অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।

এর আগে ২০১৯ সালে ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ৭০ জনের ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় শনাক্ত করে সিআইডি। ২০২১ সালের নারায়ণগঞ্জের একটি জুস কারখানায় নিহতদের পরিচয় এবং অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন নিহতদের, ২০১৪ সালে পিনাক-৬ লঞ্চ নিহতদের পরিচয় ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বের করা হয়।

বড় একটি সমস্যা মৃতদেহ বদল হয়ে যাওয়া

২০১২ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দুই শতাধিক মানুষের পরিচয় ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে বের করা হয়েছিল। সেই পরীক্ষা তত্ত্বাবধান করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক শরীফ আখতারুজ্জামান।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, রানা প্লাজা বা সীতাকুণ্ডের ঘটনার মতো বড় ডিজাস্টারের পর ডিএনএ পরীক্ষার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো যে, অনেক সময় দুর্ঘটনার পরপর ছোটখাটো মিল দেখে মৃতদেহ স্বজনদের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। হয়তো কারও পোশাক, হাতের দাগ বা বিশেষ কোন চিহ্ন দেখে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়ে যায়।পরবর্তীতে ডিএনএ পরীক্ষা করতে গিয়ে তখন অনেকের ডিএনএ প্রোফাইলের আর ম্যাচিং হয় না।

রানা প্লাজার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। তাদের মধ্যে আটশোর বেশি মৃতদেহ নানা মিল দেখে দিয়ে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সেখানে ভুল হয়েছিল। তার ফলে পরবর্তীতে আর ১১ জনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি।তার পরামর্শ, যেকোনো দুর্ঘটনার পরেই সব মৃতদেহ হস্তান্তর করার সময় নমুনা নিয়ে রাখা উচিত। তাহলে ভুলক্রমে কোন মৃতদেহ অন্য কারও কাছে চলে গেলে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় জানা সম্ভব হয়। কিন্তু সেটা না হলে যে গ্যাপ তৈরি হয়, পরবর্তীতে আর সেই শূণ্যতা পূরণ করা যায় না।

সূত্র : বিবিসি