চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির চার দিনেও শনাক্ত হয়নি কেউ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে  ছাত্রীকে যৌন হয়রানির চার দিনেও শনাক্ত হয়নি কেউ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির চার দিনেও শনাক্ত হয়নি কেউ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ক্যাম্পাসের ভেতরেই যৌন হয়রানির পর চার দিনেও অভিযুক্তদের কাউকে এখনো শনাক্ত করা যায়নি।

এ ঘটনায় হয়রানির শিকার ছাত্রী অজ্ঞাত পরিচয় ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারি থানায়।থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানিয়েছেন,মামলায় কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন।

এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া জানান, যৌন হয়রানির ঘটনায় তাকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এখনো কাউকে শনাক্ত করা যায়নি।গত ১৭ ই জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় যৌন হয়রানির শিকার হয় এক ছাত্রী।

শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

গত ১৭ই জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির এই ঘটনা ঘটলেও এটি বিশেষভাবে সামনে আসে ২০শে জুলাই রাতে।বুধবার(২০শে জুলাই) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ ঘটনার প্রতিবাদে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিলে সে খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করেন তাদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আশরাফি নিতু। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য।

মিজ নিতু জানান, গত ১৭ই জুলাই যৌন হয়রানির ঘটনাটির পরের দিন মেয়েদের হলে প্রবেশের সময় বেধে দেয়া হয়। নতুন নিয়মে বলা হয় যে, কোন ছাত্রী রাত ১০ টার পর হলে প্রবেশ করতে পারবে না।এর আগে হল থেকে সন্ধ্যার পর বের হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও হলে প্রবেশের বিষয়ে কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না।এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে চার দফা দাবিতে অবস্থান নেয়।

তাদের দাবি গুলোর মধ্যে রয়েছে, ক্যাম্পাসে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা করা এবং হলে প্রবেশ এবং মেডিকেল সেবায় সময়সীমা বেধে দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধী সেল ভেঙ্গে দিয়ে নতুন সেল গঠন করা, চলমান সব যৌন হয়রানির বিচার চার কর্মদিবসে শেষ করা এবং এই পদক্ষেপগুলো চার কর্মদিবসের মধ্যে বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে প্রোক্টরিয়াল বডি নিজেই পদত্যাগ করা।

মিজ নিতু জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল ইসলাম যিনি নিজেও প্রোক্টরিয়াল বডির সদস্য, তিনি তাদের দাবি মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যার কারণে তারা বুধবার রাতে আন্দোলন আপাতত বন্ধ রেখেছেন।তবে এই সময়সীমার মধ্যে তাদের দাবি বাস্তবায়িত না হলে আরো বড় আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে বলেও তিনি জানান।

আশরাফি নিতু বলেন, তার জানা মতে, শুধু গত ১৭ই জুলাই রাতে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির ঘটনাই নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধী যে সেল রয়েছে তাদের কাছে অন্তত চারটি অভিযোগ জমা রয়েছে। যেগুলোর কোনটিরও বিচার এখনো পর্যন্ত হয়নি।তিনি বলেন, "এই সেলটি একটা লুপ-হোলের মতো। এখানে কোন অভিযোগ গেলে তার আর কোন সুরাহা হয় না।"এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেলে একটি যৌন হয়রানির অভিযোগের বিচার করে সেলটি।

মিজ নিতু বলেন, "সেখানে যে বিচার হয়েছিল সেটিও হাস্যকর। রাতে যৌন হয়রানি হয়েছিল বলে, রাত নয় টার পর ছাত্রীদের মেডিকেল সেবা না নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।"এ ধরণের বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ জমে আছে বলেও জানান বর্তমান আন্দোলনের এই নেত্রী।

 

আলাদা তদন্ত

এদিকে গত ১৭ই জুলাইয়ের যৌন হয়রানির ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও।এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে তার প্রধান প্রোক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া।তিনি জানান, চার কর্ম-দিবসে ঘটনার বিচার সম্পন্ন করে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়েছেন তারা।এর আওতায় তারা তদন্ত করছেন।

অপরাধীদের শনাক্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্ট স্থাপন করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে সেগুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে।একই সাথে ওই ছবিগুলো যৌন হয়রানির শিকার ওই ছাত্রীকেও দেখানো হচ্ছে যাতে তিনি অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারেন।

তবে যে স্থানে ঘটনা ঘটেছে সেখানে কোন ক্যামেরা ছিল না উল্লেখ করে মি. ভূঁইয়া জানান, ঘটনার আশেপাশের দুই ঘণ্টা সময়ে ওই এলাকায় প্রবেশ এবং বের হওয়ার পথে যে ক্যামেরাগুলো রয়েছে সেগুলোর ফুটেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।তিনি বলেন, "আমাদের কিছু প্রোগ্রেস আছে তবে তদন্তের জন্য আমরা অনেক কিছু বলছি না যেহেতু হয়তো এটা জানলে যারা অভিযুক্ত ব্যক্তি তারা গা ঢাকা দিতে পারে।"

কী ঘটেছিল

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া জানান, ১৭ই জুলাই রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তার একজন বাইরের বন্ধুসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন চত্বর থেকে মূল ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছিল।

যে রাস্তা দিয়ে তারা হেঁটে যাচ্ছিল সেটা বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকা হয়ে কিছুটা ঘুরে গিয়ে মূল ক্যাম্পাসে মেশে।তিনি বলেন, মেয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, ওই সময় পাঁচ জন অজ্ঞাতনামা তাদেরকে ধরে হয়রানি করে, মারধর করে এবং মোবাইল ছিনতাই করে বোটানিক্যাল গার্ডেন সংলগ্ন এলাকায়।

"বোটানিক্যাল গার্ডেন সংলগ্ন এলাকায় তো আসলে সন্ধ্যার পরেই যাওয়াই উচিত না," তিনি বলেন।মি. ভূঁইয়া বলেন, তারপরও আমরা বিভিন্ন সিসি ক্যামেরার ছবি সংগ্রহ করে ওই মেয়ের সাথে প্রতিদিন যোগাযোগ করে কাজ করার চেষ্টা করছি।"এদিকে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থী আশরাফি নিতু বলেন, ঘটনার পরের দিন ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয় তার।সেসময় ওই শিক্ষার্থী তার সাথে হওয়া ঘটনার কথা বিস্তারিত তাদেরকে জানায়।

মিজ নিতুর ভাষায়, ওই ছাত্রী প্রথম দিন বলেছিল যে: তারা বোটানিক্যাল গার্ডেনের রাস্তা দিয়ে হেটে আসছিল। তখন ৫-৬ জন ছেলে তাদেরকে আটকায় এবং বিভিন্ন ধরণের কথাবার্তা বলে।এক পর্যায়ে ওই ছাত্রীর সাথে থাকা ছেলেটিকে মারধর শুরু করে। সেসময় তাদের কাছে ৩ হাজার ৭শ টাকা ছিল। সেই টাকা এবং তাদের দুজনের দুটি মোবাইল ফোন ছিনতাই করে।

ছিনতাই করার পর তাদের বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছনের দিকের রাস্তা যেটি প্রায় অন্ধকার থাকে, সেখানে নিয়ে গিয়ে কাপড় খুলে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে।সেসময় তাকে যৌন হয়রানিও করা হয় বলে জানায় ওই ছাত্রী।এরপর তাকে হুঁশিয়ারি দেয়া হয় যে, সে যদি এই ঘটনা অন্য কোথাও বলা হয় তাহলে সেই ভিডিও প্রকাশ করে দেয়া হবে।

মিজ নিতু বলেন, "তারা আসলে সবাই ক্যাম্পাসেরই কেউ এবং আমরা আসলে শুনতে পাচ্ছি যে, সে চার জন বা পাঁচ জনকে শনাক্ত করেছে। তবে কাদেরকে শনাক্ত করেছে সেটা এখনো উন্মোচন করছে না প্রোক্টরিয়াল বডি।"শিক্ষার্থীরা বলছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের দাবি বাস্তবায়ন করা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে বড় আন্দোলনে যাবে তারা।

 সূত্র : বিবিসি