হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম কেন?

হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম কেন?

হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম কেন?

দুয়ারে কড়া নাড়ছে নতুন আরেকটি বছর। আমাদের থেকে বিদায় নিচ্ছে ১৪৪৩ হিজরি। আগমন ঘটছে ১৪৪৪ হিজরির। আজ আপনাদের বলব, এই হিজরি সনের ইতিহাস। কিছু লোক জানলেও, বেশির ভাগ মুসলমান এ বিষয়ে অজ্ঞাত। এটি মুসলমান হিসেবে আমাদের জন্য অতি লজ্জার বিষয়!

১২ মাসে এক বছর। সেই বছরে ১২টি মাসের প্রথা সৃষ্টির শুরুলগ্ন থেকে ছিল। আসমান, জমিন সৃষ্টির পরপরই এই বারোটি মাসের পদ্ধতি আল্লাহ তায়ালা চালু করে দেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ ফরমান, নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় ১২টি মাস আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে (সূরা তাওবাহ- ৩৬)।

এর পর থেকে বিভিন্ন কওম, বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সে দিনটিকে এক ধরে সন গণনা শুরু করত। একসময় এসে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এভাবে আরেকটি কওম কোনো একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন গণনা শুরু করে। যেমন, হজরত ইবরাহিম আ: কওমেরা ইবরাহিম আ:-কে অগ্নিতে নিক্ষেপ করার দিন থেকে সন গণনা শুরু করে। পরবর্তী বায়তুল্লাহ নির্মাণের পর তা বিলুপ্ত হয়ে নতুন করে আবার সন গণনা শুরু হয়। এক সময় এসে এই সন গণনা বিলুপ্ত হয়ে যায়।ইসলামের আগমনের আগে সর্বশেষ আবরাহার বাহিনী খানায়ে কাবাকে ধ্বংস করতে এসে আবাবিল পাখির পাথরবৃষ্টির মধ্যে তারা নিজেরাই ধ্বংস হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন গণনা শুরু হয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা যে সন গণনা করি, তার সূচনা কিভাবে হলো?

হিজরি সন গণনা শুরু হয় হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ইন্তেকালের ছয় বছর পরে। হজরত ওমর রা:-এর যুগে হজরত আবু মূসা আশআরি রা: ইরাকের খলিফা নিযুক্ত হন। ওমর রা: খিলাফতের দিকনির্দেশনায় পত্র প্রেরণ করেন আবু মূসা আশআরি রা:-এর কাছে। সেখানে তারিখ হিসেবে লেখা ছিল শাবান মাস। এতে আবু মূসা আশআরি রা: বিভ্রান্তিতে পরে গেলেন।

পরে আবু মূসা আশআরি রা: ওমর রা:-এর কাছে একটি পত্র প্রেরণ করেন। পত্রে লেখেন, ‘জনাব! আপনার চিঠিতে তারিখ না থাকায় অনেক সময় বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। পত্রে লেখা আছে শাবান মাস। এই মাস কি চলতি বছরের নাকি গত বছরের? হজরতের কাছে অনুরোধ রইল চিঠিতে তারিখ দেয়ার জন্য।’ওমর রা: এই পত্রখানি পড়েন এবং এই বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেন। উসমান রা:, হজরত আলী রা: এবং আরো অন্যান্য প্রবীণ সাহাবিকে নিয়ে মাশওয়ারা করেন। এই সমস্যার সমাধান কী হতে পারে?

ওমর রা: পত্রটির কথা সবাইকে বলেন। সবাই একেকজন একেকরকম মতামত পেশ করেন। কেউ কেউ বলেন, রাসূল সা:-এর জন্মদিন থেকে তারিখ গণনা করা হোক। আবার কেউ কেউ বলেন, রাসূল সা:-এর মৃত্যুদিন থেকে গণনা করা হোক। আলী রা: বলেন, হুজুর সা: হিজরির বছর থেকে সন গণনা করা হোক।ওমর রা: সবার মতামত মন দিয়ে শুনলেন এবং যাচাই করলেন। এরপর বলেন, যদি হুজুরে পাক সা:-এর জন্মদিন থেকে যদি সন শুরু করা হয়, তাহলে ইহুদিদের সাথে মিলে যাবে। কেননা, তারা ঈসা আ:-এর জন্মদিন হিসাব করে গণনা করেন। ইহুদিদের সাথে সামান্য ব্যাপারেই সাদৃশ্য হওয়া ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

আর যদি মৃত্যুদিন থেকে তারিখ গণনা করা হয়, তাহলে রাসূল সা:-এর আশেকগণদের মনে শোকের ছায়া নেমে আসবে। পরের জমানার মানুষ মনে করবে, রাসূল সা:-এর মৃত্যুর জন্য তারিখ গণনা করা হয়েছে।এরপর ওমর রা:-এর মতামতকে প্রাধান্য দেন। এ কথার ওপর সবাই একমত পোষণ করেন। তখন থেকেই শুরু হয় আরবি হিজরি সন। এই হলো হিজরি সনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। সেই থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত চালু আছে।

তবে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। সেটি হলো, নবী সা: হিজরত করেন রবিউল আউয়াল মাসে। তাহলে বছরের প্রথম মাস মহররম হলো কিভাবে? হিজরি তারিখ যাদের মোটামুটি জানা আছে, তাদের এই প্রশ্ন উত্থাপন হতেই পারে। তাদের জন্য বলছি, যখন মক্কায় মুশরিকদের অসহনীয় নির্যাতন মুসলমানদের ওপর সীমাতিরিক্ত করতে লাগল, আল্লাহ ও নবী সা:-এর আদেশে সর্বপ্রথম যে দলটি হিজরত করেন তখন ছিল মহররম মাস। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক দল হিজরত করতে থাকেন। যখন রাসূল সা: যখন হিজরত করেন তখন ছিল রবিউল আউয়াল মাস। এ জন্য হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম।

তবে মজার বিষয় হলো, বছরে বারোটি মাস যেভাবে আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করেছিলেন, তেমনি মাসের দিনক্ষণও আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করেন। মাস ২৯ দিনের হবে নাকি ৩০ দিনের হবে, তা মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন নির্ধারণ করে দেন। এই ফায়সালা দেন চাঁদের মাধ্যমে। আল্লাহর ফায়সালার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কারো নেই। মাসের ২৯তম দিনে আমাদের চেয়ে থাকতে হয় চাঁদপানে। কবে উদিত হচ্ছে নতুন মাসের চাঁদ। যদি উদিত না হয়, তাহলে এই মাস হবে ৩০ দিনে। আর উদিত হলে হবে ২৯ দিনে। কিন্তু ইংরেজি মাস কিংবা বাংলা মাসের তারিখ নিজেদের তৈরি পদ্ধতিতে হয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গল্পকার।