মহিমান্বিত মহররম

মহিমান্বিত মহররম

ফাইল ছবি

রাসূল সা:-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য চান্দ্রমাসের হিজরি সন সূচনা। আরবি বর্ষপঞ্জির সাথে পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলমানের আবেগ-অনুভূতি ও ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান সর্বোপরি ইবাদত-বন্দেগির বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত। হিজরি সন মুসলমানদের অশেষ ঐতিহ্যের অবদানে মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়ায় বিশ্বের সর্বত্র সমানভাবে সমাদৃত। রাসূল সা: ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে মদিনায় হিজরত করেন, কিন্তু এর প্রস্তুতি ও আকাবার শেষ বায়আতের পরবর্তী সময়ে হিজরতের সিদ্ধান্ত নেয়ার পরে প্রথম যে চাঁদটি উদিত হয়েছিল, তা ছিল সম্মানিত মহররম মাসের।

অন্যান্য সাহাবায়ে কিরামের হিজরত মহররম থেকে শুরু হয়েছিল, তাই হিজরি সনের প্রথম চান্দ্রমাস মহররম থেকে ধরা হয়।
মহররম মাস অত্যন্ত সম্মানিত, রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাস গণনায় ১২টি, তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত’ (সূরা তাওবা-৩৬)। ১. মহররম; ২. রজব; ৩. জিলকদ ও ৪. জিলহজ। এ মাসগুলোতে আরব দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত বন্ধ থাকত। এ চার মাস আরব দেশে শান্তি বিরাজ করত বিধায় এ সময়ে মানুষ হজ ও ওমরাহ পালন করত। ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের সৃষ্টিকুলের প্রাথমিক বিভাজন-প্রক্রিয়ার সূচনা হয় আশুরায়। আদম আ:-এর সৃষ্টি, স্থিতি, উত্থান ও পৃথিবীতে অবতরণ- সব ঘটনাই ঘটেছিল আশুরায়। নূহ আ:-এর নৌযানের যাত্রা শুরু এবং বন্যা-প্লাবনের সমাপ্তি আশুরাতেই ঘটেছিল। মূসা আ: সমুদ্রপথে রওনা হওয়ার দিনটি ছিল আশুরা। এরই ধারাবাহিকতায় রাসূল সা: আশুরায় কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। আশুরা এলে তিনি বিনয়ে বিনম্র থাকতেন ও রোজা পালন করতেন (তাফসিরে তাবারি, মুহাম্মদ ইবনে জারির)।

আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশারা’ থেকে এসেছে। এর অর্থ ১০। আর আশুরা মানে দশম। ইসলামী পরিভাষায় মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলে। সৃষ্টির শুরু থেকে মহররমের ১০ তারিখে তথা আশুরার দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ফলে আশুরার মর্যাদা ও মাহাত্ম্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে রাসূল সা:-এর দৌহিত্র হোসাইন রা:-এর শাহাদাত এই দিনকে বিশ্ববাসীর কাছে সর্বাধিক স্মরণীয় ও বরণীয় করে আজো রেখেছে। আশুরার রোজা রাসূল সা: আমলেই ছিল। রাসূল সা: মক্কায় থাকতেও আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসে রাসূল সা: দেখতে পেলেন, ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখছে। রাসূল সা: তাদের এই দিনে রোজা রাখার কারণ জানতে চাইলেন।

জানতে পারলেন এ দিনে মূসা আ: সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত কিতাব লাভ করেন। এই দিনেই তিনি বনি ইসরাইলদের ফেরাউনের জেলখানা থেকে উদ্ধার করেন এবং তাদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। আর ফেরাউন সেই সাগরে ডুবে মারা যায়। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ইহুদিরা এই দিন রোজা রাখে। রাসূল সা: বললেন, মূসা আ:-এর সাথে আমাদের সম্পর্ক তাদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ও অগ্রগণ্য। এরপর তিনি ১০ মহররমের সাথে ৯ মহররম অথবা ১১ মহররম মিলিয়ে দু’টি রোজা রাখতে বললেন। কারণ, ইহুদিদের সাথে মুসলমানদের যেন সাদৃশ্য না হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে রমজানের রোজা রাখার পর আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ। এ মাসের নফল রোজা ও অন্যান্য ইবাদত রমজান মাস ব্যতীত অন্য যেকোনো মাস অপেক্ষা সবার্ধিক উত্তম (মুসলিম ও আবু দাউদ)।

১০ মহররম আশুরার রোজা রাখা সুন্নত। আশুরার দিনে ও রাতে নফল নামাজ পড়া। মহররম মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়ামে বিজের সুন্নত রোজা; ২০, ২৯ ও ৩০ তারিখ নফল রোজা এবং প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার সুন্নত রোজা। আশুরায় ৯ ও ১০ তারিখ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ মিলিয়ে দু’টি রোজা রাখা। এটি সম্ভব না হলে শুধু ১০ তারিখে একটি রোজাও রাখা যাবে। যদি কেউ শুধু ১০ তারিখে রোজা রাখেন এবং ৯ বা ১১ তারিখ রাখতে না পারেন; তবে এই একটি রোজার জোড়া মেলানোর জন্য অন্য দিন রোজা রাখার প্রয়োজন হবে না।

কাতাদা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ এর ওছিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন’ (তিরমিজি ও মুসনাদে আহমাদ)। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘রমজানের রোজার পরে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ; যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন।’ আশুরার দিনে (আগে বা পরে এক দিনসহ) আমরা রোজা রেখে আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণ লাভ করার সুযোগ গ্রহণ করি। মহররম মাসের গুরুত্ব অনুধাবন করে, দৃঢ়তার সাথে আমল করলে, রাব্বে কারিম অবশ্যই আমাদের আগের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। তাই আমাদের বেশি বেশি নফল রোজা, নফল নামাজ ও তাসবিহ তাহলিল পাঠ এবং বেশি বেশি দরুদ শরফি পাঠ করতে হবে।

মহররম উপলক্ষে হায় হোসেন, হায় হোসেন বলে কান্নাকাটি করা, বুক চাপড়ানো, ব্লেড বা ছুড়ি দিয়ে আঘাত করা, নিজের শরীর থেকে চাবুক মেরে রক্ত বের করা, খালি পায়ে হাঁটা ইত্যাদি মনগড়া কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

লেখক : মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক

 প্রাবন্ধিক ও মুদ্রণ ব্যবস্থাপক