আমাদের কাছে ১৫ আগস্টের দাবি কী

আমাদের কাছে ১৫ আগস্টের দাবি কী

সংগৃহীত

প্রতি বছর ১৫ আগস্ট আমাদের মাঝে শোকের মাতম নিয়ে উপস্থিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ভক্তকুল এক বুক বেদনা ও হাহাকার নিয়ে সে দিনকার সেই বিয়োগান্তক ট্র্যাজেডিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে স্মরণ করে। দেশময় দোয়া-দরুদ, মিলাদ মাহফিল, কাঙালিভোজ ইত্যাদির মাধ্যমে নিহতদের রূহের মাগফিরাত কামনা করা হয়। গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর সর্বত্র গুরুগম্ভীর আলোচনা-সমালোচনা, স্মৃতিচারণ ও শোক সমাবেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের প্রতি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। ঘটনার পর প্রায় অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও শোকে বিহ্বল মানুষ নানা আঙ্গিকে বিচার-বিশ্লেষণ করে আজো বোঝার চেষ্টা করে, কেন ঘটেছিল সে দিনকার সেই ট্র্যাজেডি? কী ছিল এর কার্যকারণ? এ ঘটনা কি ঠেকানো যেত? এ ঘটনা কি এই ইঙ্গিত বহন করে যে, সে দিন বঙ্গবন্ধুর জন্য নেয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঘাটতি ছিল? নাকি তাকে স্রেফ নিজ জনগণের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও শিশুসুলভ অন্ধবিশ্বাসের বলি হতে হয়েছিল? দেশী-বিদেশী কী ধরনের ষড়যন্ত্র নিহিত ছিল এ ট্র্যাজেডির অন্তরালে? সর্বোপরি এ ঘটনার ফলে বাংলাদেশ নামের সদ্য-স্বাধীন এ দেশটির ভাগ্যাকাশ কতটুকু ও কিভাবে প্রভাবিত হয়েছিল?

মানব ইতিহাসে ক্ষমতার পালাবদলে মারামারী-হানাহানি নতুন কোনো ঘটনা নয়। শ’ কয়েক বছর আগেও যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা রক্তপাত ব্যতিরেকে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হতে পারে- এমনটি ভাবাই দুষ্কর ছিল। এমনকি ক্ষমতার উত্তরাধিকারের দাবিতে একই রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে কলহ-বিবাদ এবং ক্ষেত্রবিশেষে পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ অনেকটাই নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। অধুনা বিশ্ব পরিমণ্ডলে শিক্ষাদীক্ষায় বৈপ্লবিক অগ্রগতি এবং বিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য অংশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হাতবদলের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে এ ধরনের রক্তপাতের ঘটনা কমে আসে, তবে একেবারে যে বন্ধ হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির বিশেষত্ব হলো, সেদিন বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেলসহ তার স্ত্রী, পুত্র কিংবা পুত্রবধূ- কেউই ঘাতকের নির্মম বুলেট থেকে রেহাই পাননি। শুধু দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তাদের পরিবারবর্গ দেশের বাইরে থাকার সুবাদে ভাগ্যগুণে বেঁচে যান। ইতিহাসে এরকম নির্মম হত্যাকাণ্ডের নজির খুব বেশি পাওয়া যাবে না।

ইতিহাসের মানদণ্ডে ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির বিচার করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ও রাজনীতিকরা হয়তো নিজ নিজ অবস্থান থেকে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ হাজির করবেন, তবে বাংলাদেশ নামের এ ভূখণ্ডটি যত দিন তার স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকবে ১৫ আগস্ট এ দেশের মানুষের কাছে ফি বছর বিশেষ ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু কেন? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চিতরূপে এটিই যে, এ দেশের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার সুতীব্র আকাক্সক্ষা জাগরিত করে বঙ্গবন্ধু যেভাবে ’৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তুলেছিলেন, তা তাকে বাঙালি জাতির সহস্র বছরের ইতিহাসে এক অবিসংবাদিত মহানায়কে পরিণত করে। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ নির্বাচনে এক শ্রোতা জরিপের আয়োজন করে এবং শীর্ষ ২০ জনের একটি তালিকা তৈরি করে, যাতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে শীর্ষস্থান লাভ করেছেন।

মজার ব্যাপার হলো বঙ্গবন্ধু তার পরে তালিকায় ২য় স্থান পাওয়া রবিঠাকুরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ পয়েন্ট লাভ করেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে পরে পাকিস্তান রাষ্ট্রে এ ভূভাগের মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর মতো অনেক বড় মাপের নেতার দেখা পেয়েছে, যাদের প্রত্যেকেই ছিলেন নিজ নিজ কীর্তিগুণে এক একজন মহীরুহ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির এক মাহেন্দ্রক্ষণে তার সময়োচিত কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে যেভাবে এ ভ‚ভাগের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে ভাষা দিতে পেরেছিলেন তা তাঁকে জনপ্রিয়তার এমন এক উচ্চ শিখরে উন্নীত করেছিল, যা এ দেশের মানুষ এর আগে কখনো দেখেনি, ভবিষ্যতেও হয়তো দেখবে না।

পাকিস্তানের কারাগারে অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯টি মাস শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও তার নেতৃত্ব সামনে রেখেই এ দেশের মানুষ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং অবশেষে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে মুক্তির সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। ৭ই মার্চের সেই অগ্নিঝরা ভাষণ, তার সেই বজ্রকণ্ঠে তেজোদ্দীপ উচ্চারণ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- যুদ্ধের ময়দানে তাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছে নিরন্তর। যুদ্ধ শেষে মুক্ত বঙ্গবন্ধু যখন তার পর্বতপ্রমাণ জনপ্রিয়তা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন, তার ওপর যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটিতে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে এটিকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়। এই গুরুদায়িত্ব পালনে তার দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত তিনি সাকুল্যে সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো। ইতিহাসের বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাওয়ার সুযোগ এখানে নেই, তবে কিছু সমালোচনা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও এটুকু বললে অত্যুক্তি হবে না যে, মোটা দাগে তিনি সঠিক পথেই এগোনোর চেষ্টা করেছিলেন।

প্রাথমিক পর্যায়ে তার সামনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা। যুদ্ধের সময় যারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের প্রায় সবাই অস্ত্র ফিরিয়ে দেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি দেশ থেকে ভারতীয় সেনাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হন। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে তিনি দেশকে একটি সংবিধান উপহার দেন। সময়ের পরিক্রমায় এই সংবিধানে নানাবিধ কাটাছেঁড়া হলেও অদ্যাবধি এটিই এ দেশে সাংবিধানিক শাসনের ভিত্তিভ‚মি হিসেবে কাজ করছে।

বঙ্গবন্ধু জানতেন, এ জাতিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে শিক্ষাই হবে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তাই শিক্ষার ভিত্তিমূল মজবুত করার প্রয়াসে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালু করে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি মুক্ত পরিবেশে নির্বিঘ্নে জ্ঞানচর্চার সুযোগ করে দিতে তিনি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক বিষয়াদির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। উচ্চতর মেডিক্যাল শিক্ষা ও গবেষণার পথ সুগম করতে তিনি তৎকালীন ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল রিসার্চ (আইপিজিএমআর)- আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির (বিএসএমএমইউ) শয্যা সংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০-এ উন্নীত করে একে বৃহত্তর কলেবর প্রদান করেন। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) প্রতিষ্ঠা করেন। দেশে ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন করেন।

বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, কৃষি ও কৃষকরাই এ দেশের অর্থনীতির মূল শক্তি। এ কারণে কৃষি ক্ষেত্রে প্রণোদনা দানে তিনি বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল কৃষকদের বিএডিসির মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে সার ও সেচযন্ত্র বিতরণের ব্যবস্থা করা। কৃষি গবেষণার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাঝে সমন্বয়ের জন্য তিনি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) প্রতিষ্ঠা করেন। জ্বালানি খাতেও বঙ্গবন্ধু বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ অনুসন্ধান, উত্তোলন ও ব্যবহারের লক্ষ্যে তিনি নিজস্ব ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ মিনারেল, এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (বিএমইডিসি) এবং খনিজ তেল ও গ্যাস খাতকে নিয়ে বাংলাদেশ মিনারেল, অয়েল অ্যান্ড গ্যাস করপোরেশন (বিএমওজিসি) গঠন করেন। এর ফলে তার সময়কালেই আটটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। শিল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছুটা সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, তবে অনেকটা অবাঙালি শিল্পপতিদের অর্থকড়িসমেত দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে, বঙ্গবন্ধু বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। কিন্তু সীমিত শাসনকাল, ব্যবস্থাপনায় অনভিজ্ঞতা, বহির্বিশ্বের পরিস্থিতিসহ অভ্যন্তরীণ নানা সঙ্কটের কারণে এ লক্ষ্য অর্জন ব্যাহত হয়।

পররাষ্ট্রনীতিতে বঙ্গবন্ধু ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’- এই মূলনীতি গ্রহণ করেন এবং বাংলাদেশকে জাতিসঙ্ঘসহ প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হন। পাকিস্তানের প্ররোচনায় দেশের জন্মলগ্ন থেকে মুসলিম বিশ্বের একটি বড় অংশের সাথে যে টানাপড়েন চলছিল, তা তিনি বহুলাংশে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন এবং ওআইসির সদস্য পদ অর্জন করেন। তবে এ জন্য তাকে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও আজন্ম শত্রু পাকিস্তানের সাথে একটি বোঝাপড়ায় আসতে হয়। এই স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসেবে তিনি ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন। একই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ’৭৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশে ’৭১-এর গণহত্যার নেপথ্য কুশীলব তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোও বাংলাদেশ সফরে আসেন।

একজন জাতীয় নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু একটি ঐক্যবদ্ধ দেশ গড়ার প্রয়োজনীয়তা সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন। এ কারণে সব ধরনের বিরোধ ভুলে তিনি সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেন। বহির্বিশ্বে যেমন তিনি সবার প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, দেশের অভ্যন্তরেও তেমনি স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতের মুঠোয় পেয়েও তাদের প্রতি ঔদার্য প্রদর্শন করেছিলেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি দেশের প্রধানের জন্য এমন মহানুভবতা প্রদর্শন খুব সহজ বিষয় ছিল না, তবে পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক দেশেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বাস্তববাদী নেতাদের দেশ ও জাতির পুনর্গঠনের প্রয়োজনে সমঝোতার পথে হাঁটতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকা, যেখানে নেলসন ম্যান্ডেলাকে তার বিরোধীদের প্রতি অতীত ভুলে গিয়ে অকাতরে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে দেখা যায়।

এভাবে বলা চলে সদ্য স্বাধীন এ দেশের গতিধারা ঠিক করে দিতে বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনমাফিক সব ক্ষেত্রেই হাত দিয়েছিলেন। এ দেশের মানুষ বিশ্বের দরবারে গর্বিত বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে, এটিই ছিল তার নিরন্তর কামনা। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে রাতারাতি পাল্টে দেয়ার মতো কোনো আলাদিনের চেরাগ তার হাতে ছিল না। কিছু লোকের দুর্নীতি ও ক্ষেত্রবিশেষে সমন্বয়ের অভাবও তার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুবাদে দেখা দিতে শুরু করে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কিছু সশস্ত্র গ্রুপ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু সব দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বাকশাল গঠন করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। কিন্তু অনেকে এখানে গণতন্ত্রের ইতি দেখতে শুরু করে এবং এটি তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগানোর প্রয়াস পায়। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ১৫ আগস্টের দুঃখজনক ঘটনায় তার কর্মময় জীবনের অকাল পরিসমাপ্তি ঘটে। ফলে তার এ উদ্যোগ কতটুকু ফলপ্রসু হতো তা দেখার মতো যথেষ্ট সময় মেলেনি। এ কারণে এটি নিয়ে হয়তো বা প্রশ্ন থেকেই যাবে।

বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে নেই। রেখে গেছেন অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত ও গুণগ্রাহী। আর রেখে গেছেন এ দেশ ও জাতিকে নিয়ে তার সেসব স্বপ্নগাথা, যা তিনি পূরণ করে যেতে পারেননি। ফি বছর ১৫ আগস্ট আমাদের মাঝে উপস্থিত হয় আর ভক্ত-অনুরক্তদের উদ্দেশে প্রশ্ন রাখে, বঙ্গবন্ধুর সেসব অপূর্ণ স্বপ্নসাধ পূরণে তারা কী করেছে এবং করছে? শোক ও দুঃখ নিয়ে তাকে ও তার পরিবারবর্গকে স্মরণ কেবল তখনই অর্থবহ হতে পারে, যখন তিনি যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং আমাদের দেখিয়েছিলেন তা অর্জিত হবে। গত ৫০ বছরে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেশের প্রভ‚ত উন্নতি হয়েছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে ঐক্যবদ্ধ, স্বাধীন, স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, তার কতটুকু অর্জিত হয়েছে? এ জন্য যে মতপার্থক্য কমিয়ে এনে সর্বস্তরের জনতার মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, তার মতো সেই উপলব্ধি কি আমাদের মাঝেও কাজ করে?

লেখক: ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন

অধ্যাপক ও সভাপতি, ফার্মেসি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়