আগামী নির্বাচনে ইতালির ক্ষমতায় আসছে উগ্র ডানপন্থীরা!

আগামী নির্বাচনে ইতালির ক্ষমতায় আসছে উগ্র ডানপন্থীরা!

ছবি: সংগৃহীত

সুইডেনের নির্বাচনে ডানপন্থী দলের বিজয়ের পর ইউরোপের মানুষ এখন এই মহাদেশের আরো একটি দেশের নির্বাচনের দিকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে।

ধারণা করা হচ্ছে, ইতালিতে ২৫ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম উগ্র ডানপন্থী কোনো নেতা ক্ষমতায় চলে আসতে পারেন।

সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা গেছে, জর্জা মেলোনির দল ব্রাদার্স অব ইতালি বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে রয়েছে। তিনি জয়ী হলে কয়েক দশক পর তার নেতৃত্বে দেশটিতে একটি ডানপন্থী জোট সরকার গঠিত হবে।

এই মধ্য-ডানপন্থী জোটের তিনটি দল হলো জর্জা মেলোনির ব্রাদার্স অব ইতালি, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক মাত্তেও সালভিনির নর্দার্ন লিগ ও আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডানপন্থী নেতা সিলভিও বারলুসকোনির ফরজা ইতালি।

শেষ পর্যন্ত যদি এই জোট জয়ী হয় তাহলে ইতালিতে তিনি যে শুধু প্রথম কোনো মহিলা প্রধানমন্ত্রী হবেন তা নয়, একনায়ক বেনিতো মুসোলিনির পর তিনি হবেন প্রথম কোনো উগ্র ডানপন্থী নেতা।

সম্প্রতি ইউরোপের আরো একটি দেশ সুইডেনের নির্বাচনেও এই প্রথমবারের মতো একটি উগ্র ডানপন্থী ও নব্যনাৎসী দল ক্ষমতার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।

ইতালিতে দু'মাস আগে গত জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘির পদত্যাগের পর তার নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের পতন ঘটে। এই পটভূমিতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের নির্বাচন যাকে ইউরোপের জন্যেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এবারের নির্বাচনের তাৎপর্য
ইতালির রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির কথা প্রায়ই শোনা যায়। দেশটিতে যেমন খুব দ্রুত কোনো একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটে, তেমনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা হারিয়েও যায়।

ফলে ইউরোপের চতুর্থ বৃহৎ অর্থনীতির এ দেশটিতে খুব ঘন ঘন সরকারের পতন ঘটে এবং এ কারণে প্রায়ই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

গত ৩০ বছরের ইতিহাসে ইতালিতে ১৯টি সরকারের ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। গড় হিসেবে দেখা যায়, প্রত্যেক দু’বছরে একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রত্যেক দেড় বছরে দেশটিতে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে।

এই ধারাবাহিকতায় রোববার অনুষ্ঠিত হচ্ছে আরো একটি সাধারণ নির্বাচন।

বিশ্লেষকরা বলেন, গত কয়েক দশক ধরে মধ্য-বামপন্থী জোট সরকারগুলোর ব্যর্থতার কারণে ভোটাররা এখন সরকার পরিচালনায় বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন চাচ্ছেন। বিশেষ করে বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক সঙ্কট, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, করোনা মহামারীর পরের পরিস্থিতি এব ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভোটাররা এই নির্বাচনকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করছেন। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালিতে করোনাভাইরাস মহামারী সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নেয়।

এছাড়াও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশটির জ্বালানি খাত বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে। কারণ ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি ও ইতালিই রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল।

ব্রাদার্স অব ইতালির জনপ্রিয়তার কারণ
এবারের নির্বাচনে যে দলটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেই ব্রাদার্স অব ইতালি মাত্র চার বছর আগে ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে মাত্র চার শতাংশ ভোট পায়। কিন্তু এবারের নির্বাচনের আগে জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে দলটি প্রায় ২৫ শতাংশ সমর্থন নিয়ে এগিয়ে রয়েছে।

তাকে সমর্থন দিচ্ছে আরো কয়েকটি ডানপন্থী দল। জরিপের ফলাফল থেকে ধারণা করা যায়, জর্জা মেলোনির নেতৃত্বে এই জোট দু’কক্ষের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে যাচ্ছে।

জনমত জরিপ অনুসারে, এই জোটের প্রতি ৪৮ শতাংশ ভোটারের সমর্থন রয়েছে। তাদের প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্বাধীন মধ্য-বামপন্থী জোটের প্রতি রয়েছে ২৯ শতাংশ ভোটারের সমর্থন।

৪৫ বছর বয়সী জর্জা মেলোনি ২০১২ সালে তার দল ব্রাদার্স অব ইতালি গঠন করেন। এর চার বছর আগে ২০০৮ সালে তিনি সিলভিও বার্লোসকোনির সরকারের একজন মন্ত্রী ছিলেন। ইতালির ইতিহাসে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী।

কিশোর বয়সে তিনি নব্য-ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের যুব শাখায় যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একনায়ক বেনিতো মুসোলিনির সমর্থকরা এই আন্দোলন গড়ে তুলে।

জর্জা মেলোনি ২০২১ সালে ’আই অ্যাম জর্জা’ নামে একটি বই লেখেন। সেখানে বলেন যে তিনি ফ্যাসিস্ট নন তবে মুসোলিনির উত্তরাধিকারীদের সাথে তিনি নিজের মিল খুঁজে পান। তিনি হাঙ্গেরির জাতীয়তাবাদী ও মুসলিমবিরোধী নেতা ভিক্টর ওরবানের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।

তবে তার ডানপন্থী মিত্রদের মতো তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি সহানুভূতিশীল নন। তিনি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ও ইউক্রেনের পক্ষে। জর্জা মেলোনি সমকামীদের অধিকারের বিপক্ষে প্রচারণা চালান।

’ঈশ্বর, পিতৃভূমি ও পরিবার’ পুরনো এই মূলমন্ত্রকে তিনি স্বাগত জানান।

এছাড়াও লিবিয়া থেকে অবৈধ অভিবাসীরা যাতে ইতালিতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তিনি সমুদ্রে নৌবাহিনীর অবরোধ তৈরি করার কথাও বলেন।

সীমান্ত সুরক্ষিত করা এবং গণহারে অভিবাসন বন্ধ করা ছাড়াও তার নির্বাচনী প্রচারণায় ইসলামপন্থীদের সহিংসতা দমনে পদক্ষেপ নেয়ার কথাও উল্লেখ করেন।

একই সাথে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নির্বাহী কমিটিতে ইতালির ভিন্ন ধরনের উপস্থিতির ওপরেও তিনি জোর দেন। তবে কী ধরনের উপস্থিতির কথা তিনি বলছেন সেটা পরিষ্কার নয়।

জর্জা মেলোনি বলেন, ‘এর অর্থ এটা নয় যে আমরা ইউরোপকে ধ্বংস করতে চাই, কিংবা আমরা ইউরোপ ছেড়ে চলে যেতে চাই, অথবা আমরা পাগলামি ধরনের কিছু করতে চাই।’

তার জোটের অন্য শরিক দলগুলোরও দাবি অভিবাসন কমানো এবং দেশটির ওপর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রভাব দুর্বল করা।

জর্জা মেলোনির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা ৫৬ বছর বয়সী এনরিকো লেটা। তিনি ২০১৩-১৪ সালের ১০ মাসের জন্য ইতালির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

মধ্য-বামপন্থী এই নেতার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, কট্টর ডানপন্থীদের ক্ষমতায় আসা ঠেকানো। তিনি নবয়ানযোগ্য জ্বালানি ও শিক্ষা খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করার কিছু পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। তিনি অভিবাসীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ করা, এলজিবিটি বৈষম্য দূর করা ও সমকামীদের বিবাহ বৈধ করারও প্রতিশ্রুতি দেন।

যেসব ইস্যুতে ভোট হচ্ছে
মোটা দাগে বলতে গেলে দেশটির অর্থনীতি, জীবনযাত্রার ব্যয়, অভিবাসন, ইউক্রেন যুদ্ধ, সমকামিতা এসব ইস্যুতেই এবারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিই ভোটারদের প্রধান উদ্বেগ।

এক জরিপে দেখা গেছে, এ নিয়ে ৯০ শতাংশ নাগরিকই উদ্বিগ্ন। রাজনৈতিক দল ও জোটের পক্ষ থেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মোকাবেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।

বিশেষ করে জ্বালানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকজনকে এ সংক্রান্ত আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার কথাও বলা হচ্ছে। একই সাথে আয়কর কর্তন করার পাশাপাশি নূন্যতম মজুরি, পেনশনসহ অন্যান্য ভাতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো দল নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও এর ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে।

অভিবাসীদের পরের প্রজন্মের নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা থেকে শুরু সমকামীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং তাদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেরও প্রস্তাব করেছে কোনো কোনো দল। এ ছাড়াও ভোটাররা আরো যেসব ইস্যু বিবেচনা করছে তার মধ্যে রয়েছে গাঁজা বৈধ করা, ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করা ইত্যাদি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইতালিতে আগের বেশ কয়েকটি সরকারই ছিল জোট সরকার। নির্বাচনে একক কোনো দল জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারেনি। জোটের ভেতরে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতবিরোধের কারণে তারা বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

এখন জনগণ যে দলটিই ক্ষমতায় আসুক না কেন করোনা পরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা তাদের কাছ থেকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ আশা করছে।

নির্বাচনের পরে কী হবে
নির্বাচনের ফলাফলে যদি জনমত জরিপ প্রতিফলিত হয় তাহলে শুধু ইতালিতে নয়, দেশটির বাইরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপরে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। যদিও ডানপন্থীদের এই জোট পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর প্রতি তাদের অঙ্গীকারের কথা জোর দিয়ে প্রকাশ করেছে।

জর্জা মেলোনি বলেন, ইউক্রেনের প্রতি ইতালির সমর্থন অব্যাহত থাকবে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এ নিয়ে তার জোটের অন্য শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা যে প্রশ্ন তুলবেন সে বিষয়ে তাদের কোনো সন্দেহ নেই। কারণ এর আগে সিলভিও বার্লোসকোনি ও মাত্তেও সালভিনির সাথে ভ্লাদিমির পুতিন ও ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

সরকার পরিচালনায় জর্জা মেলোনির দলের অভিজ্ঞতা নেই। ফলে তার প্রয়োজন হবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লোসকোনি ও মাত্তেও সালভিনির পূর্ণ সমর্থন।

তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, নির্বাচনের ফলাফল শেষ পর্যন্ত কী হবে সেটা এখনো নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। কারণ জরিপে দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ ভোটার এখনো সিদ্ধান্ত নেননি তারা কাকে ভোট দেবেন।

সূত্র : বিবিসি