কীভাবে এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং

কীভাবে এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং

কীভাবে এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস এখন চলছে, যাতে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর তৃতীয় মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় থাকা অনুমোদিত হবে বলেই বিশ্লেষকরা বলছেন।

বিশ্ব-রাজনীতিতে চীনের নেতৃস্থানীয় ভূমিকাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা, চীনের অর্থনীতি, সামরিক শক্তি, তাইওয়ান প্রশ্ন, ইত্যাদি ক্ষেত্রে তৃতীয় মেয়াদে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জিনপিং?আরো প্রশ্ন, কীভাবে এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে চীনা সরকার?প্রেসিডেন্ট জিনপিং- এর ভাষণ ছাড়াও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারণা থেকে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়।

অনেকের চোখে মনে হতে পারে, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারণার ভাষা যাকে বল যায় 'শুষ্ক' এবং বিমূর্ত। কিন্তু অভিজ্ঞরা বলেন, ওই সব ঘোষণার ভেতরেই কিছু সাঙ্কেতিক শব্দ থাকে যাতে ইঙ্গিত দেয়া হয় যে চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা আসলে কী করতে যাচ্ছেন।

কিছু সাঙ্কেতিক ও অর্থপূর্ণ শব্দ

চীনে কী হচ্ছে, চীন কী করছে, এ নিয়ে বিশ্বের আগ্রহ এখন যে স্তরে উঠেছে, আগে তা কখনোই এমন ছিল না। কিন্তু চীনের রাজনীতি আগে যেমন ছিল ঠিক তেমনি অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে রয়ে গেছে।শি জিনপিং এখন চীনে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা। কমিউনিস্ট চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাওজেদং- এর পর কেউই তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হননি, যা শি জিনপিং হতে যাচ্ছেন।

চীনে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয় রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। আর এসব বৈঠকে যে সিদ্ধান্তগুলো হয় তা জানানো হয় এমন এক ভাষায় যার আসল অর্থ উদ্ধার করা সহজ নয়।

এ কারণেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কীভাবে কাজ করে বা তাদের নেতা শি জিনপিংই বা কী করতে চাচ্ছেন এগুলো বোঝা অনেক সময়ই বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের কাজের ধারা সম্পর্কে যারা অভিজ্ঞ তারা বলেন, পার্টির ওই শুষ্ক প্রচারণার ভাষার মধ্যে এমন অনেক ইঙ্গিত থাকতে পারে যাতে নেতার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আন্দাজ করা সম্ভব।

চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সবচেয়ে বড় সংবাদপত্র হচ্ছে দ্য পিপলস ডেইলি। এ দৈনিকটির পুরনো সংখ্যাগুলো খুঁজে বিবিসি এমন কিছু সাংকেতিক শব্দ চিহ্নিত করেছে যা প্রেসিডেন্ট জিনপিং- এর শাসনামলকে বুঝতে সহায়ক হবে।

দ্য 'কোর' বা প্রাণকেন্দ্র
নেতৃত্বের একটা কেন্দ্রবিন্দুর ধারণা প্রথম তুলে ধরেছিলেন মাও জেদং কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রথম নেতা।তিনি এই 'কোর' কথাটা ব্যবহার করেছিলেন ১৯৪০- এর দশকে ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি চীনে ক্ষমতাসীন হওয়ার আগেই।

সেটা ছিল এমন এক সময় যখন মাও পার্টির ভেতরে তার ক্ষমতা সঙ্ঘবদ্ধ করার চেষ্টা করছিলেন। এজন্য তিনি দলে 'শুদ্ধি অভিযান' চালিয়ে তার বিরোধীদের উচ্ছেদ করছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে সেটাই প্রথম শুদ্ধি অভিযান ছিল না এবং তার পরেও যে হয়নি তা নয়। কিন্তু ইতিহাসবিদরা মনে করেন ওই সময়কালটি থেকেই মাও 'কাল্ট' বা তার প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং ব্যক্তিপূজার সূচনা।শি জিনপিংকে ঘিরে এই ’কোর’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ২০১৬ সাল থেকে। এরপর এ শব্দটির ব্যবহার ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।

শি জিনপিং ২০১২ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে তার চার পূর্বসূরীর তিনজনকেই পার্টির ’কোর’ অভিধা দেয়া হতো। এরা ছিলেন মাও জেদং - আধুনিক চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা, দেং শিয়াওপিং - যিনি বিশ্বের জন্য চীনের দরজা খুলে দিয়েছিলেন, আর জিয়াং জেমিন - যিনি ১৯৯০এর দশক থেকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত চীনের উত্তরণে নেতৃত্ব দেন।

জিয়াং- এর উত্তরসূরী এবং শি জিনপিং- এর ঠিক আগে যিনি চীনের নেতা ছিলেন সেই হু জিনতাওকে কখনোই পার্টির ‘কোর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি।

তিনি ঠিক একচ্ছত্র নেতা বা 'স্ট্রংম্যান' ছিলেন না বরং ঐকমত্য গড়ে তোলার পথ নিয়েছিলেন। দেং শিয়াওপিং- এর সময়ই পার্টিতে যৌথ নেতৃত্বের নীতি প্রচলিত হয় আর হু জিনতাও- এর সময় এটাই স্বাভাবিক কার্যপদ্ধতিতে পরিণত হয়েছিল অন্তত লোকে তাই ভাবতো।বিশ্লেষকরা বলেন, প্রেসিডেন্ট জিনপিং যেভাবে দ্রুতগতিতে নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন, তাতে তিনি যে এক সময় নিজেকে পার্টির ’কোর’ হিসেবে তুলে ধরবেন এটা প্রায় অবধারিত ছিল।

'চায়না মিডিয়া প্রজেক্ট' সংস্থার পরিচালক ডেভিড বান্ডুরস্কি বলছেন, প্রেসিডেন্ট জিনপিং- এর দরকার ছিল মুখে ক্ষমতা সঙ্ঘবদ্ধ করার কথা বলা যা বাস্তবে ক্ষমতা সঙ্ঘবদ্ধ করার প্রায় সমতুল্য।তিনি বলেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এখন স্পষ্টতই এক ব্যক্তির নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিপূজার দিকে এগিয়ে চলেছে।

মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষক লি ইউয়ানও বলছেন, প্রেসিডেন্ট জিনপিংর চীন পেছন দিকে হাঁটছে এবং একক নিয়ন্ত্রণের যুগ শুরু হতে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এক দশক আগে যখন প্রেসিডেন্ট জিনপিং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হয়েছিলেন তখন দেশটির রাজনীতি, বাণিজ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের এলিটরা আশা করেছিলেন যে তিনি চীনকে আরো উন্মুক্ত, ন্যায়বিচারসম্পন্ন এবং সমৃদ্ধ করে তুলবেন।

লি ইউয়ান বলেন, কিন্তু এখন তাদের অনেকেই মনে করেন যে প্রেসিডেন্ট জিনপিং একটি একক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র গড়ে তুলেছেন।প্রেসিডেন্ট জিনপিং এখন চীনের তিনটি সর্বাধিক ক্ষমতাধর পদে আছেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর চেয়ারম্যান এবং প্রেসিডেন্ট।চীনের প্রেসিডেন্ট পদের ক্ষেত্রেও আগে এমন নিয়ম ছিল যে এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না।

চীনের সংস্কারক নেতা দেং শিয়াও পিং এটা করেছিলেন এই জন্য যেন চীনে আর কখনো মাও জেদং- এর মত একক নেতৃত্বের উত্থান না হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিনপিং- এর সময় সে নীতি বাতিল করা হয়েছে।

কীভাবে শি জিনপিং এত ক্ষমতাধর হলেন?

মাওজেদং- এর একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস হচ্ছে বন্দুকের নল।’গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর মাও এটা নিশ্চিত করেছিলেন যে চীনের সেনাবাহিনী বা পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) নিয়ন্ত্রণ করবে পার্টি - রাষ্ট্র নয়। তা ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির নেতাই তখন হতেন কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনেরও (সিএমসি) চেয়ারম্যান।ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট জিনপিং সামরিক বাহিনীর ভেতরে থাকা তার বিরোধীদের উচ্ছেদ করতে কোনো বিলম্ব করেননি।

সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাগুলো ঘটেছিল ২০১৪ ও ২০১৫ সালে, যখন সিএমসির ভাইস চেয়ারম্যান শু কাইহু এবং পিএলএর সাবেক জেনারেল গুও বক্সিওং- এর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়।

পেন্টাগনের অর্থে পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির সিনিয়র ফেলো জোয়েল উটনাও বলেন, এরা যদিও তখন অবসর নিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিনপিং এই পদক্ষেপের মাধ্যমে একটা জোরালো বার্তা দিয়েছিলেন যে সামরিক অফিসারদের কেউ যদি তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বাধা দেয়, তাহলে তার পরিণাম ভালো হবে না।

২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট জিনপিং সামরিক বাহিনীর কাঠামোতে পরিবর্তনে এনে চারটি হেডকোয়ার্টার ভেঙে দেন এবং ১৫টি ছোট ছোট এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে সিএমসির পক্ষে সরাসরি সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্তরে আদেশ পাঠানো সম্ভব হলো এবং প্রেসিডেন্ট জিনপিংর প্রতি আনুগত্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি জোরদার হলো।

মার্কিন থিংক ট্যাংক র‍্যান্ড কর্পোরেশনের সিনিয়র প্রতিরক্ষা গবেষক টিমোথি হীথ বলেন, পার্টির প্রতি চীনা সামরিক বাহিনীর আনুগত্যের মানে হচ্ছে ’তাদের কর্তব্য হবে পার্টি এবং বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট জিনপিংকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা।’

'আনুগত্য' হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ

'বন্দুকের নলে'র পর প্রয়োজন ছিল 'ছুরি' অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানটিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা।প্রেসিডেন্ট জিনপিং ক্ষমতায় আসার দু’বছর পর দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হন সাবেক অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধান ঝু ইয়ংকাং। তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিনপিংএর আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী বো শিলাই- এর ঘনিষ্ঠ।

এই তদন্ত চীনে রাজনৈতিক জগতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কারণ এতদিন সবার ধারণা ছিল যে চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা পলিটব্যুরোর স্ট্যান্ডিং কমিটির কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কখনো ফৌজদারি অপরাধের মামলা হবে না।নিল টমাস বলেন, প্রেসিডেন্ট জিনপিং এমন একজন কঠোর এবং তীক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ যার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার গতি এবং মাত্রা দেখে হয়তো কমিউনিস্ট পার্টির বয়স্ক নেতারাও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।

পর্যবেক্ষকরা বলেন, গত এক দশকে চীনে দুর্নীতিদমন কর্তৃপক্ষ ৪৭ লাখ লোকের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে এবং প্রেসিডেন্ট জিনপিং প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দিতে এই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ব্যবহৃত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রাজনীতিবিজ্ঞানী ভিক্টর শিহ বলেন, গত দু’বছরে প্রেসিডেন্ট জিনপিং এমন অনেক নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়েছেন যারা শুরুতে তার ক্ষমতায় আসাকে সমর্থন করেছিলেন।

তিনি বলেন, এখন চীনের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো যারা চালাচ্ছেন তারা অতীতে কোনো না কোনো সময় প্রেসিডেন্ট জিনপিং- এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং যাদের তিনি বিশ্বাস করেন।নিল টমাস বলেন, এখন সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে জিনপিং- এর অনুগতদের।

তার কথায়, ৩১টি প্রাদেশিক স্তরের পার্টি সচিব পদের ২৪টিতেই আছেন প্রেসিডেন্ট জিনপিং- এর সহযোগীরা যারা তার পারিবারিকভাবে পরিচিত, তার সাথে লেখাপড়া করেছেন, তার অধীনে বা তার ঘনিষ্ঠ কোনো সহযোগীর অধীনে কাজ করেছেন।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলোর ২৮১ জন সদস্যের প্রায় সবাইকে পদোন্নতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জিনপিং।এ ছাড়া ২০১৮ সালে শি জিনপিংএর ’নতুন যুগের জন্য চীনা বৈশিষ্টসমৃদ্ধ সমাজতন্ত্র বিষয়ক চিন্তাধারা’ চীনের সংবিধানেও যুক্ত হয়েছে। মাওজেদংএর পর আর কোনো চীনা নেতার 'চিন্তাধারা' এভাবে সংবিধানের অংশ হয়নি। চীনের আধুনিকায়নের স্থপতি দেং শিয়াওপিং- এর অবদান যুক্ত হয়েছে শুধু একটি 'তত্ত্ব' হিসেবে।

লাল দেশ

এই শব্দবন্ধটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে 'লাল নদী ও পর্বতমালা' এবং উদ্ভব হয় ১৯৬০’র দশকে।চীনের সমাজে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সে সময়কার 'সাংস্কৃতিক বিপ্লব।'

সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মাও জেদং সে সময় যে আহ্বান জানিয়েছিলেন তাতে চীনা বিপ্লবের সাথে প্রতারণা করেছে বলে কাউকে সন্দেহ হলেই তার বিরুদ্ধে সহিংস পন্থা নেয়ার আভাস ছিল।সে সময় শ্লোগান ছিল, ’এটা নিশ্চিত করুন যেন দেশের রঙ কখনো বদলাতে না পারে’ এবং এটা ছিল কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার এক মারাত্মক আহ্বান।

তবে মাওএর মৃত্যুর পর চীন অর্থনৈতিক সংস্কারের পথ নিলে এই প্রবণতা ঝিমিয়ে পড়েছিল। বিশ্বের জন্য চীনের দরজা খুলে যাওয়ার পর মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে পার্টির ভূমিকা অনেক পেছনে চলে গিয়েছিল এবং এই 'লাল' দেশের কথা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে ।১৯৮০ দশক থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পিপলস ডেইলির পাতায় লাল দেশের উল্লেখ পাওয়া যায় ২০টিরও কম। কিন্তু এখন কথাটা আবার ফিরে এসেছে। শুধু গত বছরই এর উল্লেখ করা হয়েছে ৭২ বার।

নিল টমাস, ইউরেশিয়া গ্রুপের একজন সিনিয়র চীন বিশ্লেষক এ প্রসঙ্গে বলেন, এই শব্দটার পুনরুত্থান দেখে বোঝা যায় প্রেসিডেন্ট জিনপিং চান যে চীনা রাজনীতি ও সমাজে কমিউনিস্ট পার্টিকেই হতে হবে কেন্দ্রীয় শক্তি।প্রেসিডেন্ট জিনপিং অনেকবার তার দেশের মানুষের প্রতি ’তাদের হৃদয় ও রক্তে লাল জিনকে সঞ্চালিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ’লাল দেশকে কায়েম রাখা যায়।’

চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এখন মানুষের জীবনের প্রতি স্তরে ফিরে এসেছে এবং তা যে শুধু ’লাল দেশ’ শব্দবন্ধটি দিয়েই বোঝা যাচ্ছে তা নয়।চীনে তালিকাভুক্ত প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে এখন তাদের প্রতিষ্ঠানে কমিউনিস্ট পার্টির শাখা খুলতে হয়। পার্টির শতবার্ষিকীর সময় এমনকি বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও পার্টির ইতিহাসভিত্তিক কুইজে অংশ নিয়েছিলেন। সিনেমাতেও এখন দেশপ্রেমমূলক চলচ্চিত্রগুলো প্রাধান্য পাচ্ছে।

নিল টমাস বলেন, প্রেসিডেন্ট জিনপিং এমন একজন ব্যক্তি যার পার্টির মিশন এবং চীনের পুনরুজ্জীবনে তার ভূমিকার ওপর প্রকৃত বিশ্বাস রয়েছে।তিনি আরো বলেন, এই মিশনের অংশ হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে চীনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা এবং প্রেসিডেন্ট জিনপিং একে একটি ঐতিহাসিকভাবে উজ্জ্বল অবস্থান বলেই মনে করেন।

'চীন-বিরোধী শক্তিসমূহ'

এ কথাটি ব্যবহার করা হয় পশ্চিমা বিশ্ব এবং চীনের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থানের সমালোচনা করার সময়। এটি চালু আছে বহু দশক ধরেই।পিপলস ডেইলিতে এ শব্দটি সচরাচর দেখা যায় না। তবে হঠাৎ কখনো কখনো এর ব্যবহার অনেক বেড়ে যায় বিশেষ করে যখন চীনের কোনো পদক্ষেপ দেশে বা বিদেশে সমালোচনা সৃষ্টি করে বা পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে তাদের কোনো বিবাদ তৈরি হয়।

ইদানীং যুক্তরাষ্ট্র বা সার্বিকভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে চীনের সম্পর্কের অবনতি হওয়ার ফলে এ শব্দটির ব্যবহার বেড়ে গেছে।ওয়াশিংটনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধ, শিনজিয়াং বা অন্যত্র চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, হংকং’র ওপর চীনের নিয়ন্ত্রণ, বা তাইওয়ানের ব্যাপারে চীনের কথাবার্তা নিয়ে নানা খবরের প্রেক্ষাপটে এই 'চীন-বিরোধী শক্তি' কথাটার ব্যবহার হতে দেখা যায়।

চীনের ভেতরে জাতীয়তাবাদী মনোভাবও এখন বাড়ছে।কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে চীন-বিরোধী আখ্যা দেয়া হয়, তা ছাড়া লোকজনকে উৎসাহও দেয়া হয় যেন কেউ এধরনের আচরণ করলে তা তারা কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করে।

চীনের ব্যাপারে নেতিবাচক মত প্রকাশ করলে তা দেশটির স্বার্থের হানি ঘটায় বলে মনে করা হয়। বান্ডুরস্কি বলেন, প্রেসিডেন্ট জিনপিং এবং তার পার্টি এখন যেকোনো সমালোচনার ব্যাপারে অনেক বেশি স্পর্শকাতর এবং সন্দেহপ্রবণ।

বেইজিং প্রায়ই অভিযোগ করে যে ওয়াশিংটন চীনের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার চেষ্টা করছে।এ কারণে বান্ডুরস্কি বলেন, প্রেসিডেন্ট জিনপিং বিদেশী শক্তির অনুপ্রবেশের ভয়ে থাকেন এবং যে কোনো বিরোধিতাকেই বৈদেশিক বলে চিত্রিত করাটাকে তিনি পাল্টা আঘাত হানার ক্ষেত্রে একটি কার্যকর পন্থা মনে করেন।

'দ্য গ্রেট স্ট্রাগল' বা 'মহান সংগ্রাম'
এই সংগ্রাম কথাটা মাও- এর যুগের এবং তিনি প্রায়ই এ কথাটাকে তার পেছনে জনসমর্থন তৈরির জন্য ব্যবহার করতেন।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় এই সংগ্রামের কথা বলে মাও সমর্থকরা শ্রেণী শত্রুদের অপমান এবং কখনো কখনো সহিংস আক্রমণ করতো।প্রেসিডেন্ট জিনপিংও এখন 'মহান সংগ্রাম' কথাটাকে নিজের করে নিয়েছেন যা এখন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

২০২১ সালে পিপলস ডেইলিতে এ কথাটা যতবার ব্যবহৃত হয়েছে তা ২০১২ সালের তুলনায় (যখন প্রেসিডেন্ট জিনপিং ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন) ২২ গুণ বেশি।ল্যাংকাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের চীন ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক জেং জিংহান বলেন, এ শব্দটি ব্যবহার করার পেছনে আছে মাওয়ের সময়কার স্মৃতি জাগিয়ে তোলা এবং কমিউনিস্ট পার্টির মূল চেতনার ব্যাপারে আবেদন সৃষ্টি করার প্রয়াস।

দেশের ভেতরেই হোক বা বাইরেই হোক চীনের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে তা নিয়ে আলোচনার সময় এই 'মহান সংগ্রাম'-এর কথা বার বার ঘুরেফিরে আসে।নিল টমাস বলেন, শি জিনপিং- এর নেতৃত্বাধীন পার্টি যে এসব চ্যালেঞ্জের মোকাবিল করত সক্ষম সেই আত্মবিশ্বাস ও আনুগত্য সৃষ্টি করার জন্যও এ শব্দটি একটি অস্ত্র।

সূত্র : বিবিসি