বাংলাদেশের জন্য রফতানি আয় বাড়ানো কতটা চ্যালেঞ্জিং হতে যাচ্ছে?

বাংলাদেশের জন্য রফতানি আয় বাড়ানো কতটা চ্যালেঞ্জিং হতে যাচ্ছে?

সংগৃহীত

বিশ্ব জুড়ে মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনেতিক মন্দার পূর্বাভাসের মধ্যে বাংলাদেশের রফতানি আয়ও কমতে শুরু করেছে। আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রফতানি আয় কমে আসার কারণে বাণিজ্যের ঘাটতিও আরো বড় হয়েছে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের রফতানি আয় হয়েছে ৪.৩৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের অক্টোবর মাসের তুলনায় আট শতাংশ কম।

এর আগে সেপ্টেম্বর মাসেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। সেই মাসে রফতানি আয়ে ৬.২৫ শতাংশ কমে যায়। তবে জুলাই ও অগাস্ট মাসে ভালো রফতানি আয় করেছিল বাংলাদেশ। এরপরেই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যায়।

রফতানির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্সও কমেছে।

বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে রফতানি আয় আরো বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে বাংলাদেশের সরকার।

রফতানি আয় বাড়ানো কতটা চ্যালেঞ্জিং
বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে। এই সময়ে এই খাত থেকেই আয় হয়েছে ৩১৬ কোটি ডলার।

এরপরেই রয়েছে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়া জাত পণ্য, ওষুধ, বাইসাইকেল, প্লাস্টিক পণ্য, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য ইত্যাদি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানোমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলছেন, ''বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের বেশিরভাগটাই নির্ভর করে বড় যে দুটি বাজার রয়েছে, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা, সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপরে।''

''সাম্প্রতিক যে বিশ্ব মন্দার যে প্রভাব ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে তা হয়তো আরো গভীর হবে। যেভাবে ফেডারেল রিজার্ভসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের সুদের হার বাড়িয়েছে, তাতে ভোক্তাদের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে।''

ড. সেলিম রায়হান বলছেন, ‘’এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মূল্যস্ফীতির প্রভাব কমাতে সুদের হার বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। কিন্তু তার প্রভাব শেষ পর্যন্ত এসে পড়ে আমাদের মতো দেশের ওপরে, যাদের রফতানি এসব দেশের ওপরে অনেক বেশি নির্ভরশীল। তাদের ক্রেতারা যদি পণ্য কেনা কমিয়ে দেয়, তাহলে আমাদের রফতানিও কমে যাবে। কারণ আমরা যে ধরনের পণ্য রফতানি করি, তা মূলত এই ভোক্তাদের ওপরেই নির্ভরশীল।‘’

মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার ফলে ওই সব দেশে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে, ফলে ভোক্তাদের নতুন ফ্যাশনের প্রতি আকর্ষণ কমে গেছে। তার এই বক্তব্যের প্রমাণ মিলছে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের বক্তব্যেও।

বাংলাদেশ রফতানি খাত থেকে যত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে, তার ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।

কিন্তু তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর মালিকরা বলছেন, কোভিড পরবর্তী কার্যাদেশের কারণে গত বছর অনেক বড় অংকের রফতানি হয়েছিল। কিন্তু এই বছর সারা বিশ্ব জুড়েই অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়ায় তার আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্যে।

তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''বাংলাদেশের প্রধান মার্কেট হচ্ছে ইউএস এবং ইউরোপ। কোভিডের পরে ওরা প্রচুর পরিমাণে মাল নিয়েছে। ফলে অন্যান্য বছরের তুলনায় গত বছর আমাদের এক্সপোর্ট ভলিউম বাড়তি ছিল।''

গত অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় প্রথমবারের মতো ৫২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক পেরিয়ে গিয়েছিল। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

‘’কিন্তু সেসব পণ্য বিক্রি না হওয়ায় এবং ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব জুড়ে যেভাবে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা গিয়েছে, তার প্রভাব পোশাক খাতে পড়েছে। তাদের টার্গেট অনুযায়ী বিক্রি না হওয়ায় এখন আমাদের যেসব পণ্য উৎপাদন শেষ হয়ে পাঠানোর কথা ছিল, কোন কোন ক্ষেত্রে তার ৩০ পার্সেন্ট পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধ করে রেখেছে। হয়তো পরবর্তী বছর নিতে পারে,‘’ বলছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

অন্যদিকে, ইউরোপের দেশগুলোতে ডলারের বিপরীতে ইউরো ও পাউন্ডের বিনিময় মূল্য কমে যাওয়ায় তাদের আমদানির খরচ বেড়েছে এবং এর ফলে ওইসব দেশেও আমদানি কমছে। একই চিত্র দেখা গেছে জুতা ও চামড়াজাত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রেও।

খুব তাড়াতাড়ি পরিস্থিতির বদল দেখছেন না ব্যবসায়ীরা
সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলছেন, ‘’আমরা এখন সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছি যে, ইউরোপ আমেরিকায় যদি অবস্থা ভালোও হয়, বাংলাদেশে বর্তমানে জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে নির্বাচনী বছরে দেশে খানিকটা অস্থিরতা তৈরি হয়। সেসবের ওপর আমাদের ক্রেতারা নজরদারি করছে। এসব খবরে তারা অন্য দেশে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’’

বাংলাদেশের সরকার চাইছে রফতানি আয় আরো বাড়াতে চাইছে। সেজন্য নানা উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এখনো রফতানি আয়ের ওপরে সরকার প্রণোদনা দিয়ে থাকে।

কিন্তু রফতানি কতটা হবে, তা নির্ভর করে অন্য দেশগুলোয় পণ্যের কতটা চাহিদা রয়েছে তার ওপরে। কিন্তু বিশ্ব মন্দা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করার মতো বিষয় তো বাংলাদেশের হাতে নেই।

অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলছেন, ‘’বিশ্বমন্দা যদি সামনের বছর আরো গভীর হয়, তাহলে সামনের বছরেও রফতানির প্রবৃদ্ধি কম দেখতে পাওয়া যাবে।‘’

বাংলাদেশের ব্যবসায়ী এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রফতানি আয়ের যে নেতিবাচক ধারা তৈরি হয়েছে, খুব তাড়াতাড়ি তার বদল ঘটবে বলে তারা মনে করছেন না।

এর মধ্যেই বাংলাদেশের সরকারও ২০২৩ সাল একটি ‘ক্রাইসিস ইয়ার’ হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছে। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে।

ব্যবসায়ী নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলছেন, ‘’এখন আমাদের যেসব অর্ডার পাওয়ার কথা ছিল, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ক্রেতারা অর্ডারও কমিয়ে দিয়েছে। ফলে আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ২০ পার্সেন্ট অর্ডার কমে গেছে।‘’

বিশ্বমন্দা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরিস্থিতি না পাল্টালে এই অবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না।

পোশাক বা দামী পণ্য রফতানিতে বিশ্ব মন্দার প্রভাব পড়লেও তার উল্টো চিত্র খাদ্যপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে দেখা গেছে।

বাংলাদেশের সবজি রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর আলম বলছেন, ‘’আমাদের সেক্টরে রফতানি হচ্ছে। সেখানে এখনো কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়েছি, সেরকম সম্ভাবনাও দেখছি না।‘’

রফতানি বাড়ানোর বিকল্প কী আছে?
ড. সেলিম রায়হান বলছেন, রফতানি আয় বাড়ানোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে বাজার বহুমুখী করা এবং রফতানি পণ্যও বহুমুখী করে তোলা।

এনিয়ে বহুদিন ধরেই অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিচ্ছেন। ভিয়েতনামের মতো দেশ এই নীতি নিয়ে সাফল্য পেয়েছে।

বাংলাদেশের সরকারও বিভিন্ন সময় রফতানিকারকদের পণ্যের বহুমুখীকরণ ও নতুন বাজার খুঁজে বের করার জন্য পরামর্শ দিয়েছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি কিছুদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘’অর্থনীতি গতিশীল রাখতে রফতানি বৃদ্ধির বিকল্প নেই। সেজন্য আগামী চার বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১০ হাজার কোটি টাকার পণ্য রফতানি করতে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছি। সেজন্য যেসব চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলো মোকাবেলার জন্য কাজ শুরু করেছি।‘’

‘’পাশাপাশি আইসিটি, লেদার, পাট, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংসহ অন্তত ১০টি পণ্য রফতানি বাড়াতে আমরা আলাদা করে উদ্যোগ নিয়েছি। এগুলোর রফতানি বাড়ছে,‘’তিনি বলেছেন।

তিনি জানান, কয়েকটি দেশের সাথে পিটিএ বা এফটিএ অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে। আর যেসব দেশের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি আছে, সেই ব্যবধান কমাতেও আলোচনা চলছে।

তবে অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলছেন, ‘’কিন্তু সমস্যা হলো, পণ্যের বহুমুখীকরণ বা বিকল্প বাজার খুঁজে বের করা, এটা তো রাতারাতি করা সম্ভব নয়। এতদিনে এ ক্ষেত্রে সাফল্য খুব বেশি পাওয়া যায়নি। কিন্তু ভিয়েতনামের মতো দেশ এই নীতিতে ভালো সাফল্য পেয়েছে।‘’

বিশেষ করে ২০২৬ সাল নাগাদ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ চলে গেছে অনেক দেশে পাওয়া শুল্কমুক্ত সুবিধা আর থাকবে না। বিশেষ কোটাও পাওয়া যাবে না। ফলে তখন রফতানি নিয়েও কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হবে।

সূত্র : বিবিসি