ডলারের জন্য ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বিদেশগামী যাত্রীরা

ডলারের জন্য ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বিদেশগামী যাত্রীরা

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে ডলার সঙ্কটের কারণে বিদেশ যাত্রায় নানা ধরণের ভোগান্তির মুখে পড়েছেন বিদেশগামীরা। বিশেষ করে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থী, চিকিৎসা বা হজযাত্রী কিংবা সাধারণ পর্যটক হিসেবে যারা বিদেশে যেতে আগ্রহী ডলার সংগ্রহে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে।

ব্যাংক সূত্রে জানা যাচ্ছে, পাসপোর্টে নগদ ডলার এনডোর্সমেন্টে বেসরকারি ব্যাংক থেকে ৫০০ ডলারের বেশি না দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, পাসপোর্টে ডলার এনডোর্সমেন্টের ক্ষেত্রেও নানা ধরণের ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের। বর্তমানে পাসপোর্টে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে একসাথে ৫০০ ডলারের বেশি নগদ এনডোর্স করা হচ্ছে না।

সরকারি ব্যাংকগুলোতে এই হার আরো কম। সরকারি ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে অ্যাকাউন্ট না থাকলে প্রতি পাসপোর্টের বিপরীতে ১৫০-২০০ ডলার পর্যন্ত এনডোর্স করা যাচ্ছে।

পর্যটনসহ বিদেশ সফর নিয়ে কাজ করেন এমন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সঙ্কটের কারণে নানা ধরণের সমস্যায় পড়ছেন বিদেশগামীরা। তা সে যে উদ্দেশ্যেই বিদেশে যাওয়া হোক না কেন।

দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে এবং এ সঙ্কট মেটাতে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলার সঙ্কটের কারণে দেশে খোলা বাজারে ডলারের দাম ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলেও এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।

এর আগে গত বছর সরকার ডলারের খরচ কমাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। গত আগস্টে ডলার সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশী নাগরিকদের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দশ হাজার ডলারের অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রির নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই সময়ের পর কারো কাছে অতিরিক্ত ডলার পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে।

১. শিক্ষা :
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পড়াশুনা করতে যান লাখো শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং সেখানে পড়াশুনার খরচ চালানোর জন্য তাদের বাংলাদেশ থেকে টাকা ডলার হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে হয়।

বিভিন্ন ব্যাংকে শিক্ষার্থীদের একটি হিসাব খোলার মাধ্যমে বিদেশে তাদের ফি পরিশোধ করতে হয়। যাকে বলা হয় স্টুডেন্টস ফাইল।

বাংলাদেশে বর্তমানে দুটি বেসরকারি ব্যাংক ছাড়া আর কোনো ব্যাংকে এই স্টুডেন্টস ফাইল খেলা যাচ্ছে না ডলার সঙ্কটের কারণে। বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে কড়াকড়ি রয়েছে বলে জানানো হয়।

পড়াশুনার জন্য ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা একজন শিক্ষার্থী। তার পাসপোর্টে ডলার এনডোর্সমেন্ট নিয়ে রীতিমত ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে তাকে। শুক্রবার যখন ওই শিক্ষার্থীর মামাতো ভাইয়ের সাথে কথা হয় তখন তিনি বলেন, নিজের পাসপোর্টে প্রয়োজনীয় ডলার এনডোর্স করতে না পারায় তার আত্মীয়দের পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তবে সেখানেও বিপত্তি বাধে।

ওই শিক্ষার্থীর মামাতো ভাই বলেন, যে বিদেশী বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ৫০০ ডলারের বেশি এনডোর্স করা হচ্ছে সেখানে ওই শিক্ষার্থী বা তার বাবা-মায়ের অ্যাকাউন্ট না থাকায় খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে। পরে বাধ্য হয়ে অপ্রচলিত উপায়ে ডলার কিনে নিয়ে গেছে সে, কী করবে?

২. হজ :
হজে যাওয়ার নিবন্ধনের মৌসুম শুরু হয়েছে। ডলার বিপরীতে টাকার দর ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় এবারের হজ প্যাকেজের দামও বেড়েছে বেশ।

হজ এজেন্সিগুলোর সংগঠন হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) এরই মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে হজ ব্যবস্থাপনার খরচের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।

সংস্থাটি বলছে, এবার হজের সর্বনিম্ন খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ছয় লাখ ৭২ হাজার টাকার বেশি। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় দেড় লাখ টাকা বেশি।

এর কারণ হিসেবে সংস্থাটি বলছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে হজ ব্যবস্থাপনার খরচও বেড়েছে। সর্বনিম্ন হিসাবের যে প্যাকেজটি ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে একজন হাজি কোরবানি দিতে পারবেন না। কোরবানির টাকা তার নিজের বহন করতে হবে।

একটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক এস এম সাইমন মাহমুদ সিদ্দিকী বলেন, যে হজ প্যাকেজ আগে সাড়ে চার লাখ টাকা ছিল সেটা এবার সাত লাখ টাকার কাছাকাছি চলে গেছে। যারা মধ্যম আয়ের মানুষ ছিলেন এবং হজে যেতে চেয়েছিলেন তাদের এখন সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জানা গেছে, তবে ব্যয় বৃদ্ধি শুধু হজের ক্ষেত্রে নয় বরং সব ধরণের বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রেই বেড়েছে।

সাইমন সিদ্দিকী বলেন, বছরে তারা তাদের এজেন্সি থেকে যেখানে প্রতি মাসে ২০-৩০টি ট্যুরের আয়োজন করতেন। বর্তমানে সেখানে ৫-৭টা ট্যুর হচ্ছে।

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ডলার বাইরে পাঠানো যাচ্ছে না ব্যাংকে ডলারের সঙ্কট থাকার কারণে। আর ওপেন মার্কেটে ডলার কিনতে গেলে খরচ অনেক বেশি বেড়ে গেছে।

উদাহরণ হিসেবে সাইমন সিদ্দিকী বলেন, ‘ব্যাংককে আগে একটা হোটেল ৪-৫ হাজার টাকায় পাইতেন আর এখন এটা ৮-৯ হাজার টাকায় উঠে গেছে পার নাইট।’

৩. চিকিৎসা :
সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন যারা চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।

চিকিৎসার খরচ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে টাকা নিতে পারছেন না ডলার সঙ্কটের কারণে। এমন একজন চট্টগ্রামের একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইমন বিশ্বাস শুভ।

তিনি জানান, সম্প্রতি একজন নিকটাত্মীয়ের ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যেতে হচ্ছে তাকে। ভিসা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করানোর চেষ্টা করছেন তিনি।

প্রথমে বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ হাউজে গিয়েছেন। সেখানে ডলার সঙ্কটের কারণে ডলার এনডোর্স করানোর কোএনা উপায় নেই বলে তাকে জানানো হয়। পরে তিনি যান ব্যাংকে। বেশ কিছু দিন ধরে চট্টগ্রামের একাধিক ব্যাংকে চেষ্টা-তদবীর করেও ডলার এনডোর্স করাতে পারেননি তিনি। এমনকি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেও প্রয়োজনীয় ডলার এনডোর্স করাতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।

এর কারণ হিসেবে ব্যাংকগুলো তাকে জানিয়েছে যে, ডলার সঙ্কটের কারণে এটি তারা করতে পারছেন না।

ইমন বিশ্বাস বলেন, ‘তারা বলছে যে আমরা পারবো না বা প্রসেটাকে খুব দীর্ঘ করছে। যেখানে প্রসেসটা দ্রুত করা দরকার। কারণ ট্রিটমেন্ট পারপাস। কিন্তু আমরা করতে পারছি না।’

তিনি বলেন, ‘বাইরে ট্রিটমেন্ট করতে গেলে একটা বিশাল অংকের টাকা নিয়ে যেতে হয়। আমরা কার্ডে এনডোর্সমেন্টের কথাও বলেছিলাম, কিন্তু তারা সেটাও পারছে না।’

অনেক মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে এক হাজার ডলার এনডোর্স করাতে হলেও কমপক্ষে সপ্তাহ খানেক আগে যোগাযোগ করতে হচ্ছে।

৪. পর্যটন :
পর্যটনের জন্য যারা দেশের বাইরে যাচ্ছেন তারাও ডলার এনডোর্স করা নিয়ে নানা ঝামেলায় পড়ছেন। এমন একজন মেজবাহ উদ্দিন।

সপ্তাহ খানেক হলো দুবাই থেকে ঘুরে এসেছেন তিনি। এর আগে ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পাসপোর্টে ডলার এনডোর্স করাতে হয় তাকে। পরে ডলার কিনতে গিয়েও ঝামেলায় পড়েন তিনি।

নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে মেজবাহ উদ্দিন বলেন, প্রথমে মানি এক্সচেঞ্জে ডলার কিনতে যান। তবে সেখানে এনডোর্স করিয়ে দিতে রাজি হননি তারা। পরে ব্যাংক থেকে এনডোর্স করাতে গিয়ে বেশ কয়েক দিন ঘুরতে হয়েছে তাকে।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় দু‘দিন ধরে ঘুরেও ডলার এনডোর্স করাতে পারেননি তিনি। এক দিন ঘুরেছেন বিদেশী একটি বেসরকারি ব্যাংকেও।

পরে সেখানেও না পেয়ে শেষমেশ জনতা ব্যাংকে গিয়ে ডলার এনডোর্স করান তিনি। অ্যাকাউন্ট না থাকার কারণে মাত্র দেড় শ‘ ডলার এনডোর্স করান তিনি।

মেজবাহ উদ্দিন জানান, ওই দিন সরকারি রেট ১০৬ টাকা করে থাকলেও ব্যাংক থেকেই ১১৪ টাকা দরে ডলার কিনেছেন তিনি। তারপর ডলার দেয়া হয়েছে ৫০ ডলারের পুরনো নোট যা নিয়ে পরবর্তীতে ঝামেলায় পড়েছেন তিনি। কারণ সেগুলো আসলে কেউ নিতে চাচ্ছিল না।

তিনি বলেন, ‘রুলস হচ্ছে দেড় শ‘ ডলার করে যে কেউ নিতে পারবে। কিন্তু কেউ কিনতে গেলে প্রথমে ফিরায় দিবে, ফিরায় দিচ্ছে যে না, ডলার নাই, ডলার দেয়া হচ্ছে না।’

মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ডলার এনডোর্স করানোর তিন-চার দিন পর নগদ ডলার কিনতে পেরেছেন তিনি।

চট্টগ্রামে ট্রাভেল বার্ড নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক এস এম সাইমন মাহমুদ সিদ্দিকী বলেন, তারা তাদের গ্রাহকদের ভিসা এবং ডলার এনডোর্সমেন্ট করানো নিয়ে বেশ ভোগান্তিতে পড়েছেন।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামে কোন ব্যাংকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া কেউ ক্যাশে ডলার এনডোর্স করাতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে তারা গ্রাহকদের বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জে ডলার এনডোর্সমেন্টের জন্য পাঠাচ্ছেন। তবে সেখানকার সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, তারা এক সাথে এক হাজার ডলারের বেশি এনডোর্স করাতে পারে না এবং দিতেও পারে না।

৫. বিদেশে অভিবাসন
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছরই বিপুল সংখ্যক মানুষ অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যায়। ডলার সঙ্কটের কারণে এদের যাতায়াত খরচ অনেক বেশি বেড়ে গেছে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

ট্রাভেল বার্ড নামে ট্রাভেল এজেন্সির মালিক এস এম সাইমন মাহমুদ সিদ্দিকী বলেন, আগে যেখান একজন শ্রমিক ৩৫-৪০ হাজার টাকায় যেতে পারতেন, এখন তাদের যাওয়ার জন্য খরচ হচ্ছে লাখেরও বেশি টাকা।

সূত্র : বিবিসি