ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে কেন বড় দলগুলো কাছে পেতে চায়?

ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে কেন বড় দলগুলো কাছে পেতে চায়?

ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে কেন বড় দলগুলো কাছে পেতে চায়?

বাংলাদেশের সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অংশ নেয়া সত্তরটির মতো ইসলামপন্থী দলের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ছিলো দশটি। এর মধ্যে ছয়টি ছিলো আওয়ামী লীগের সাথে আর দুটি ছিলো বিএনপি জোটের সাথে।আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেও নানা ধরণের তৎপরতার খবর পাওয়া যাচ্ছে ইসলামপন্থী ছোট-বড় বিভিন্ন দলকে ঘিরে।

যদিও ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে জামায়াত ছাড়া আর কেউই স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেনি এবং প্রধান দুই দলকে ঘিরেই তাদের রাজনীতি ঘুরপাক খেতে দেখা যায়।আর বড় দুটি দলের নেতাদের কথা থেকে বোঝা যায় যে ইসলামপন্থী দলগুলো জোটে থাকলে সেটি এক ধরণের স্বস্তি হিসেবে কাজ করে নির্বাচনের মাঠে।

নির্বাচন এলেই ইসলামপন্থী দলগুলোকে নিজেদের দিকে রাখার জন্য নানা তৎপরতা দেখা যায় এবং এমনকি কিছু ইসলামপন্থী দল নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সরকারের আনুকূল্য পেয়ে আসছে বলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে।কয়েকটি দলের কর্মসূচিতে সরকারের মন্ত্রী বা সরকারি দলের নেতাদেরও শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে গত কয়েক বছর ধরে।

বাংলাদেশে নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর ভোটের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা পাওয়া না গেলেও এর পরিমাণ খ়ুব কম বলেই ধারণা বিশ্লেষকদের, যার সিংহভাগই যায় জামায়াতে ইসলামীর বাক্সে।এই ভোটের ভাগের জন্যই ইসলামপন্থীদের নিয়ে দুই বড় দল টানাটানি করে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন।

তার মতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহার হতে শুরু করেছে আশির দশকে এবং এরপর থেকে বড় দলগুলো সবসময়ই নির্বাচন এলে ধর্মকে ব্যবহার করে নির্বাচনের মাঠের সুবিধা নেয়ার চর্চা করে আসছে।

“ধর্মভিত্তিক দলগুলো ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করে আর বড় দলগুলো এসব দলগুলোকে নিজেদের পক্ষে রেখে সেই ধর্মকেই নির্বাচনের মাঠে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের সমর্থন পাবার জন্য,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।যদিও বড় দুটি দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা ঠিক এভাবে ব্যাখ্যার সাথে একমত নন। ভোটের কৌশল হিসেবে এটি করার কথা মানলেও দল দুটির আলাদা ব্যাখ্যা আছে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে কাছে টানার বিষয়ে।

দরকষাকষির কৌশল আছে ইসলামপন্থী দলগুলোর

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামকে বাদ দিয়ে কিছু ধর্মভিত্তিক দল তৎপরতা শুরু করেছে গত বছরের মাঝামাঝি থেকেই।নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে পাঁচটিই এক সময় বিএনপি জোটে থাকলেও এখন আর তারা সেই জোটে নেই।আর এসব দলগুলোকে নিয়ে আলাদা একটি মোর্চা তৈরির চেষ্টা চলছে ইসলামপন্থী আরও কয়েকটি দলের।

ভোটের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকে এমন দলগুলোর মধ্যে আছে খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত আন্দোলন। আবার সরকারের সঙ্গে আছে সরাসরি জোটে আছে তরীকত ফেডারেশন আর জোটের বাইরেও ইসলামিক ফ্রন্ট ও জাকের পার্টিও আপাত দৃষ্টিতে সরকারের দিকেই আছে।

আর কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বারবার রাজনীতি থেকে দূরে থাকার কথা বললেও সংগঠনটির বেশ কয়েকজন নেতা বিভিন্ন ইসলামপন্থী দলের সাথে থাকাও তারা কখন কোন দিকে যায় তা নিয়েও আগ্রহ থাকে বড় দলগুলোর।যদিও হেফাজত ইসলাম গত কয়েক বছর ধরেই সরকারের উচ্চ মহলের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে আসছে।তাদের বেশ কিছু দাবি সরকার ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে।

অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশ দলীয় জোট থেকে পাঁচটি ইসলামপন্থী দল বেরিয়ে গেলেও দলটির নেতারা মনে করছেন বেশিরভাগ ইসলামপন্থী দলেরই নেতারা আওয়ামী লীগ বিরোধী হিসেবে পরিচিত হওয়ায় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে এসব দলের সমর্থন বিএনপির দিকেই আসবে, তবে তা নির্ভর করবে নির্বাচন কেমন হয় তার ওপর।আবার বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে চাপে রাখতে সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাথমিক কাজও শেষ করে এনেছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন এবং ইসলামি ঐক্যজোট।

এসব দলের নেতারা বলছেন নির্বাচন কেমন হয় তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। “আগের মতো হলে আওয়ামী লীগ থেকে যদি কিছু পাওয়া যায় তাতে খারাপ কি? আমাদের অনেক দল তো এভাবে সংসদে গেছে,” বলছিলেন জমিয়তে উলামায়ের একজন নেতা।

ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র আহমেদ আব্দুল কাইয়ুম অবশ্য বলছেন যে জোট মহাজোটের রাজনীতিতে দলের সংখ্যা বাড়ানোটা সব দলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নির্বাচনে।“ভোট যাই হোক আমাদের সংগঠন ও সমর্থন তো আছে। দলের সংখ্যা বাড়লে কিংবা ইসলামপন্থী দলগুলো সাথে থাকলে মানুষের কাছে যেতে সহজ হয় যেটা বড় দলের জন্য স্বস্তির হয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

তার মতে একটি দলের সঙ্গে বেশি সংখ্যক ইসলামপন্থী দল থাকার মানেই হলো সাধারণ মানুষের কাছে একটি বার্তা যাওয়া, যা নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরিন বলছেন ইসলামিকরণের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং সেটি বড় দুটি দলই তৈরি করেছে।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতারা যা বলছেন

আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বলছেন সব মত পথের মানুষকে কাছে রাখতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক একটি রাজনৈতিক দলের জন্য।

তবে তার মতে নির্বাচন এলেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে নানা অপপ্রচার হয় সেটি যাতে না হয় সে চেষ্টা থেকেই ইসলামপন্থী অনেক দলের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করেছে দলটি।“আবার এটাও ঠিক যে এসব সংগঠনের ভোট নেই। কিন্তু দেশের ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষ মুসলিম। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগকে নিয়ে কেউ যাতে কোনো ভুল বার্তা না দিতে পারে সেটা তো দলকে খেয়াল রাখতেই হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতি, দেশজুড়ে সাড়ে পাঁচশর মতো মডেল মসজিদ তৈরি করাসহ সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ইসলামের জন্য সরকারের করেছে বলে প্রচার করে থাকেন।“আমরা চাই নির্বাচনকে সামনে রেখে কেউ যেন ধর্মকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের ক্ষতি করতে কোনো উন্মাদনা তৈরি না করতে পারে। এ কারণে ইসলামপন্থী যেসব দল যারা সত্যিকার অর্থেই ইসলামকে ভালোবাসে তাদের কাছে রাখতে তো আপত্তি থাকার কারণ নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মিস্টার খান।

আর বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন তার দল বিএনপি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ সম্মানসহ সব ধর্মের মানুষের প্রতি কল্যাণের অঙ্গীকার প্রকাশ করে আসছে।“তবে বাংলাদেশে কিছু দল বা পীর আছেন যাদের ভোট যাই হোক না কেন অনেক অনুসারী আছেন। এ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা খুব একটা কম নয়। সে কারণেই তাদের কাছে পাওয়ার একটি চেষ্টা থাকাটাই স্বাভাবিক,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, বিএনপি জোটে থেকেই ইসলামী ঐক্যজোটের কয়েকজন নেতা বিভিন্ন সময়ে সংসদে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন ধর্মভিত্তিক কিছু দলকে গুরুত্বপূর্ণ বানানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও ভূমিকা ছিলো বিভিন্ন সময়ে।“সামরিক শাসক এরশাদ যেমন জাকের পার্টিকে পরিচিত করেছিলেন বারবার ফরিদপুরের জাকের মঞ্জিলে গিয়ে। এখন নির্বাচন এলে বন্ধুদের বাড়ানোর চেষ্টা সবাই করবে সেটাই স্বাভাবিক,” বলছিলেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি