'বিশ্বব্যাপী মুসলিম ক্রিকেটারদের জন্য একজন দৃষ্টান্ত আলিম দার'

'বিশ্বব্যাপী মুসলিম ক্রিকেটারদের জন্য একজন দৃষ্টান্ত আলিম দার'

'বিশ্বব্যাপী মুসলিম ক্রিকেটারদের জন্য একজন দৃষ্টান্ত আলিম দার'

পাকিস্তানের আম্পায়ার আলিম দার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের এলিট প্যানেল থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।এলিট প্যানেল হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আম্পায়ারদের সর্বোচ্চ শ্রেণি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের এলিট প্যানেল আম্পায়াররা সাধারণত বিভিন্ন আইসিসি টুর্নামেন্টের বড় বড় আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোতে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে আম্পায়ারিংয়ের দায়িত্বে থাকেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে এলিট প্যানেলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ আম্পায়ারদের দায়িত্ব দিয়ে থাকে আইসিসি।সেই এলিট প্যানেল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ম্যাচ কভার করা আম্পায়ার আলিম দার।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আলিম দার ৪৩৫টি ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।তিনি প্রথম পাকিস্তানি হিসেবে ২০০৪ সালে এলিট প্যানেলে জায়গা করে নিয়েছিলেন।তবে এলিট প্যানেল থেকে সরে দাঁড়ালেও আলিম দার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ পরিচালনা করতে পারবেন যদি পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড তাকে নির্বাচন করে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথিতযশা আম্পায়ারদের একজন আলিম দার ১৯ বছর আইসিসির সর্বোচ্চ পর্যায়ে আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছেন।ছাড়ার সময় তিনি বলেছেন, এলিট প্যানেলে আন্তর্জাতিক প্যানেল থেকে কারও সুযোগ পাওয়ার জন্যই তিনি দায়িত্ব ছেড়েছেন।আলিম দার কখনো ভাবেননি তিনি এই পেশায় এতো সফল হতে পারবেন।আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল ২০০২ সালে প্রথম এলিট প্যানেল তৈরি করে।এই তালিকা প্রতি বছর পরিবর্তন হয়।

ক্রিকেটার না হতে পেরেই আম্পায়ারিং

আলিম দার গত ১৯ বছরে বেশ কিছু রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন। যেমন, সবচেয়ে বেশি ম্যাচের দায়িত্বে ছিলেন তিনি, সবচেয়ে বেশি ওয়ানডে ম্যাচ, সবচেয়ে বেশি টেস্ট ম্যাচ এবং টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।টানা তিন বছর তিনি আইসিসির বর্ষসেরা আম্পায়ারের পুরস্কার জিতেছিলেন, ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে আলিম দার বলেছিলেন তার বাবা সবসময় চাইতেন যাতে ছেলে টেস্ট ক্রিকেটার হয়।“আমার বাবা পুলিশে চাকরি করতেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং ছিল বাবার। তাই তখনও ক্রিকেটে থিতু হতে পারিনি। পরে লাহোরে আসি এবং ক্রিকেট খেলা শুরু করি।”

আলিম দার ও ওয়াসিম আকরাম একই সময়ে যথাক্রমে ব্যাটসম্যান ও বোলার হিসেবে ডাক পান।নিজের ক্রিকেটার জীবনের স্মৃতিচারণে আলিম দার বলেন, “আমি লাহোরে আসার পর ক্রিকেট খেলা শুরু করি, ইসলামিয়া কলেজ সিভিল লাইন্স থেকে আমি ছিলাম প্রথম ব্যাটসম্যান, একই সময় ওয়াসিম আকরামও বোলার হিসেবে ডাক পেয়েছিলেন।“বাবা চাইতেন আমি ক্রিকেটার হই কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি, শেষ পর্যন্ত আম্পায়ার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।”

আলিম দার বলেন তার আম্পায়ারিং শুরুর মাত্র এক বছরের মাথায় টেস্ট ক্রিকেটে আম্পায়ার হিসেবে দাঁড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করেন তিনি, “এই যুগে যে কারও টেস্ট ক্রিকেটে আম্পায়ারিং করতে পাঁচ থেকে ছয় বছর লেগে যায়। আমি ছিলাম ভাগ্যবানদের একজন, মাত্র এক বছর লেগেছিল আমার।”আলিম দার বলেন, বাবা ও আমার পেশায় এক অর্থে মিল ছিল। বাবা দেশের আইন কানুন প্রতিষ্ঠায় কাজ করতেন আর আমার কাজ ছিল ক্রিকেটের আইন কানুন নিয়ে।”আলিম দারের জীবনে তার বাবার প্রভাব ছিল অনেক বেশি, “বাবা সবসময় ক্রিকেট নিয়ে আলাপ করতেন, আমার সিদ্ধান্ত নিয়েও অনেক আলোচনা করতেন।

“বাবা সবসময় চাইতেন আমি যাতে সেরা আম্পায়ারের পুরস্কার পাই। এটা বাবার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আমি ২০০৯ সালে যেবার প্রথম এই পুরস্কার পাই তখন বাবা আর পৃথিবীতে নেই।”প্রথমবার এই পুরস্কার জয়ের পর আলিম দার বিমানবন্দর থেকে সোজা বাবার কবরে গিয়েছিলেন, পুরস্কার সেখানে রেখে কেঁদেছিলেন এই আম্পায়ার।

যে কারণে আলিম দার 'একজন দৃষ্টান্ত'

আলিম দার তার লম্বা ক্যারিয়ারে এমন অনেক ম্যাচেই আম্পায়ারিং করেছেন যেখানে বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।কার্ডিফ টেস্ট ২০০৯ এ আলিম দার প্রশংসিত হয়েছিলেন দারুণ সব সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য।অ্যাশেজের এই ম্যাচে মন্টি পানেসার ও জেমস অ্যান্ডারসন ১১ ওভার তিন বল ব্যাট করে ইংল্যান্ডের পরাজয় এড়িয়েছিলেন।আলিম দার বলেন এই টেস্টের শেষ মুহূর্তগুলো মনে হচ্ছিল যেন একেকটা পরীক্ষা।মন্টি পানেসারের প্রথম টেস্ট উইকেটের কথাও তিনি স্মরণ করেন, ব্যাটসম্যান ছিলেন শচীন টেন্ডুলকার।

আলিম দার আম্পায়ার হিসেবে কতোটা বিদগ্ধ তার প্রমাণ দিয়েছিলেন তিনি ২০১১ বিশ্বকাপে, সেবার আলিম দারের ১৫টি সিদ্ধান্তের রিভিউ চেয়েছিলেন ক্রিকেটাররা, ১৫বারই প্রমাণিত হয়েছিল আলিম দার ছিলেন সঠিক।ক্যারিয়ারের নানা সময়ে ক্রিকেটারদের তোপের মুখে পড়েছেন আলিম দার।দুই হাজার দশ সালের অ্যাশেজের মেলবোর্ন টেস্টে অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক রিকি পন্টিং আলিম দারের ওপর চড়াও হয়েছিলেন, পরে অবশ্য ক্ষমাও চেয়েছিলেন বিশ্বকাপ জয়ী এই ক্রিকেটার।

বিবিসি উর্দুর সাবেক ক্রিকেট প্রতিবেদক আব্দুল রশিদ শাকুর ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ক্রিকেটারদের মতোই আম্পায়ারদেরও শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হয়। আলিম দারের এসব গুণাবলিই ছিল, গোটা ক্যারিয়ার জুড়ে তিনি সম্মান পেয়েছেন।আলিম দারের সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদেরও খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, মিরপুরের একাডেমি মাঠে আলিম দার মুশফিকুর রহিমকে নেটে বলও করেছিলেন তিনি।তবে আলিম দারের একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের ঢাকায় মানববন্ধন পর্যন্ত হয়েছিল।ওয়ানডে বিশ্বকাপ ২০১৫ এর কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ বনাম ভারত ম্যাচে আম্পায়ার ছিলেন আলিম দার, সেই ম্যাচে রোহিত শর্মাকে করা রুবেল হোসেনের একটি বলকে নো বল ঘোষণা করা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল।

আলিম দার বিশ্বব্যাপী মুসলিম ক্রিকেটার ও ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের জন্য দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন পাকিস্তানের সাংবাদিক সাজ সাদিক।দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার হাশিম আমলার পরামর্শে ২০১৮ সাল থেকে দাঁড়ি রাখা শুরু করেন আলিম দার।“আমার ইচ্ছা ছিল দাঁড়ি রাখার কিন্তু হাশিম আমলার কথায় বেশি অনুপ্রাণিত হই। আমি যদি দাঁড়ি রাখি মানুষ জানবে যে একজন মুসলিম আন্তর্জাতিক আম্পায়ার আছেন।”

ক্যারিয়ারে গুটিকয়েক সিদ্ধান্ত ভুল নিয়েছিলেন আলিম দার, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অনেক আম্পায়ারদের জন্যই তিনি একটা মান ঠিক করে দিয়েছেন।আলিম দার বলেন, “রিভিউ আসার পর আম্পায়ারদের ওপর চাপ বেড়েছে তবে একটা জিনিস সবসময় মাথায় রেখেছি, কোনও সিদ্ধান্ত যাতে মাথায় না থাকে, প্রতিটা বলই নতুন বল এবং নতুন সিদ্ধান্ত।”আলিম দার ২০০৭ ও ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ এবং ২০১০ ও ২০১২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে আম্পায়ারিং করেছিলেন।আলিম দার এলিট প্যানেল থেকে সরে দাঁড়ানোর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল ইতোমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার আদ্রিয়ান হোল্ডস্টক এবং পাকিস্তানের আহসান রাজাকে এলিট প্যানেলের অর্ন্তভুক্ত করে নিয়েছে।

সূত্র : বিবিসি