তীব্র ঋণ সংকটে ভুগছে যেসব উন্নয়নশীল দেশ

তীব্র ঋণ সংকটে ভুগছে যেসব উন্নয়নশীল দেশ

সংগৃহীত

চরম ঋণ সংকটে ভুগছে বিশ্বের অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ। সামনের সপ্তাহগুলোয় এ সংকট আরও তীব্রতর হতে পারে। আগামী সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের বসন্তকালীন বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর, অর্থমন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে এই ঋণ সংকট।

জানা গেছে, উচ্চমূল্যস্ফীতি, ঋণ ব্যয় বৃদ্ধি ও শক্তিশালী ডলারের কারণে উন্নয়নশীল দেশের ঋণের কিস্তি ব্যয়বহুল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এতে চলতি বছরে অনেক দেশই ঋণখেলাপি হিসেবে হাজির হতে পারে। এবার যারা ঋণখেলাপি হতে পারে বা ঋণের কিস্তি পরিশোধে হিমশিম খেতে পারে তাদের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ।

মিশর
তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছে আফ্রিকার দেশ মিশর। করোনা মহামারীর ধাক্কার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খাদ্য ও জ্বালানির উচ্চমূল্য। ডলার সংকটে ভোগা দেশটি বিদেশি ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। গত ডিসেম্বরে আইএমএফ থেকে নতুন করে ৩০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা পেয়েছে মিশর। ইতোমধ্যেই দেশটির মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশ ছাঁড়িয়েছে, যা পাঁচ বছরের সর্বোচ্চ।

ঘানা
কয়েক দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আফ্রিকার আরেক দেশ ঘানা। গত বছর ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে সরকারি আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ। গত জানুয়ারিতে চতুর্থ দেশ হিসেবে ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন করেছে ঘানা। 

লেবানন
কয়েক দশকের দুর্নীতি ও অপশাসনের কারণে ২০১৯-এর পর ধসে পড়ে লেবাননের আর্থিক খাত। ২০২০ সালের শুরুতে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। গত ৩১ অক্টোবরের পর থেকে দেশটির নেই কোনও সরকারপ্রধান কিংবা সম্পূর্ণ সচল মন্ত্রিসভা। ২০২২ সালের এপ্রিলে আইএমএফের কাছে ৩ কোটি ডলারের ঋণ আবেদন করে লেবানন। ব্যাংকিং ও মুদ্রা বিনিময়সহ বিভিন্ন খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশটি বিপজ্জনক অবস্থানে রয়েছে বলে সতর্ক করে আইএমএফ।

পাকিস্তান
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং গত বছরের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় রেকর্ড মূল্যস্ফীতিতে পড়েছে পাকিস্তান। এতে বিপজ্জনক জোনে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি। আইএমএফের কাছ থেকে জরুরি ঋণ পেতে কয়েক দফা আলোচনা এগিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। পাকিস্তানের ব্যালান্স অব পেমেন্ট সংকট কাটাতে বিভিন্ন সংস্থার ঋণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। চীন এরই মধ্যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ১৮০ কোটি ডলার তহবিল সরবরাহ করেছে। কিন্তু আইএমএফের ১১০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তার কিস্তি বারবার পেছাচ্ছে। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের বেইলআউটে ৬৫০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছিল ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদাতা সংস্থাটি। কিন্তু ১১০ কোটি ডলারের কিস্তিটি কয়েকবার পেছাল। এদিকে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এত নিচে নেমে এসেছে, যা দিয়ে মাত্র চার সপ্তাহের আমদানি ব্যয় নির্বাহ সম্ভব।

শ্রীলঙ্কা
গত বছর আন্তর্জাতিক ঋণখেলাপি হিসেবে নাম লেখিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশ শ্রীলঙ্কা। করোনা মহামারী ও রাজনৈতিক সংকটে নাজেহাল দেশটির জরুরি পণ্য আমদানির মতো ডলারও নেই হাতে। গত মাসে ৩০০ কোটি ডলারের বেইলআউট প্যাকেজে সম্মত হয়েছে আইএমএফ। এছাড়া বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও অন্য ঋণদাতাদের কাছ থেকেও ৪০০ কোটি ডলারের ঋণ নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটি।

তিউনিসিয়া
তীব্র খাদ্য স্বল্পতায় ভুগছে উত্তর আফ্রিকার আরেক দেশ তিউনিসিয়া। আইএমএফের কাছ থেকে ১৯০ কোটি ডলার ঋণ প্রক্রিয়া কয়েক মাস ধরে স্থগিত। 

ইউক্রেন
এদিকে আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তি হিসেবে ২৭০ কোটি ডলার ঋণ সংগ্রহ করেছে ইউরোপের দেশ ইউক্রেন। আইএমএফের ১ হাজার ৫৬০ কোটি ডলারের চার বছর মেয়াদি ঋণ কর্মসূচির আওতায় এ কিস্তি পেল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি। গত বছর সব ধরনের ঋণ পরিশোধ স্থগিত করে কিয়েভ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ইউক্রেনের ঋণ পুনর্গঠন আলোচনা চালাতে হবে। আইএমএফের প্রাক্কলন, দেশটির কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে মাসে ৩০০-৪০০ কোটি ডলার প্রয়োজন পড়বে।

এল সালভাদর
এল সালভাদর গত জানুয়ারিতে ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করেছে। এখনও মধ্য আমেরিকার দেশটিতে প্রায় ৬.৪ বিলিয়ন ইউরোবন্ড বকেয়া রয়েছে। যদিও ২০২৫ সাল পর্যন্ত ঋণের কিস্তি প্রদান বকেয়া নেই, তবে এল সালভাদরের উচ্চ ঋণ পরিষেবার খরচ, এর অর্থায়ন পরিকল্পনা ও আর্থিক নীতি দেশটির গভীর চাপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বিটকয়েনকে বৈধতা দেওয়ায় আইএমএফ  দেশটির জন্য অর্থায়নের দরজা বন্ধ করে দেয়। তবে পরে আইএমএফ  অবশ্য স্বীকার করেছে, এল সালভাদরের বিটকয়েনের বৈধতার ঝুঁকি “বস্তুকৃত হয়নি।”

মালাবি
চরম বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিতে ভুগছে আফ্রিকার দেশ মালাবি। দেশটি ১.৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট ঘাটতিতে রয়েছে, দেশটির মোট জিডিপির ৮.৭ শতাংশ।

দাতা-নির্ভর দক্ষিণ আফ্রিকার দেশটি নভেম্বরে জরুরি তহবিল অনুমোদনকারী আইএমএফ  থেকে আরও তহবিল পেতে ঋণনীতি পুনর্গঠনের চেষ্টা করে।

জাম্বিয়া
২০২০ সালে করোনাকালে ঋণখেলাপি হওয়া প্রথম আফ্রিকান দেশ জাম্বিয়া। ঋণ পুনর্গঠন প্রবাহ অব্যাহত রাখতে মহামারী চলাকালে জি২০-এর কমন ফ্রেমওয়ার্ক উদ্যোগের জন্য জাম্বাবিয়াকে অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এ সংক্রান্ত আলোচনা খুবই ধীরগতি চলছে। আর ইতোমধ্যে দেশটির বৈদিশক ঋণ বেড়ে ১৮.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।

এজন্য দেশটির বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতা চীনকে দায়ী করেছেন পশ্চিমা কর্মকর্তারা। যদিও দেশটি এগিয়ে যেতে কতটা ঋণ বহন করতে পারবে তা নিয়ে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে।

জাম্বিয়ার মুদ্রা কোয়াচা, এ বছর মার্কিন ডলারের বিপরীতে ১০ শতাংশেরও বেশি অবনমন হয়েছে, যা মুদ্রাস্ফীতিতে যুক্ত হচ্ছে বলে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে। এজন্য ঋণ পুনর্গঠন নীতিমালা বিলম্ব হওয়াকে আংশিকভাবে দায়ী করেছে জাম্বিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সূত্র: রয়টার্সবিজনেস রেকর্ডার