ভারতে বিজেপি-বিরোধী জোট কি সম্ভব?

ভারতে বিজেপি-বিরোধী জোট কি সম্ভব?

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধী দলীয় নেতা নেত্রীদের একটি বৈঠক

ভারতে লোকসভা নির্বাচন আর বছর খানেক পরে। কিন্তু এর মধ্যেই বিজেপি বিরোধী দলগুলি একে অপরের সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু করেছে যে তারা একজোট হয়ে ভোটে লড়তে পারে কী না, তা নিয়ে।

জোটের বিষয়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারই বিভিন্ন রাজ্যভিত্তিক দলগুলির সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছেন।এই উদ্যোগকে সমর্থন করছে কংগ্রেস দলও।বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনে সারা দেশে গড়ে ৩৭.৩৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, অর্থাৎ বিজেপি বিরোধী দলগুলিই সিংহভাগ ভোট পেয়েছিল।তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে ওই ফলাফলের পরে কিছু রাজ্যে বিজেপির ভোট বেড়েছে।

যেভাবে শুরু হয় বিরোধীদের জোট আলোচনা

বিরোধী দলগুলির জোট বাঁধার প্রচেষ্টা প্রথম শুরু হয় এমাসের গোড়ার দিকে যখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার, দেখা করেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের সঙ্গে।ওই বৈঠকের শেষে মি. খড়্গে মন্তব্য করেছিলেন, “এটা একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত।“

গত সোমবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন নীতিশ কুমার। এর আগে তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্তালিনের সঙ্গে কথা হয়েছে মমতা ব্যানার্জীর।আবার উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবও দেখা করে গেছেন মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে।“নীতিশ কুমারের সঙ্গে বৈঠকের পরে মমতা ব্যানার্জী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন যে জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের মতো বিজেপিকে সরানোর উদ্যোগ শুরু হোক বিহারের মাটি থেকেই।

তার কথায়, “প্রথমে আমাদের এই বার্তাটা দিতে হবে যে আমরা সবাই একসঙ্গে আছি। আমাদের কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই। আমরা চাই বিজেপি শূন্য হয়ে যাক। কোনও কাজ না করেই বিজেপি শুধুমাত্র মিথ্যা কথা বলে আর ভুয়ো ভিডিও বানিয়ে হিরো হয়ে গেছে।“ওই বৈঠক নিয়ে নীতিশ কুমারের মন্তব্য ছিল যে আলোচনা খুবই ইতিবাচক হয়েছে।মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে বৈঠকের পরে নীতিশ কুমার দেখা করেন উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের সঙ্গেও।

সেই বৈঠকের পরে অখিলেশ যাদব মন্তব্য করেছেন, “বিজেপির একের পর এক ভুল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যার ফলে কৃষক, শ্রমিকরা ভয়াবহ সমস্যায় রয়েছেন। মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্ব চরমে পৌঁছিয়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টিকে হঠিয়ে দেশ বাঁচাতে হবে।“এই অভিযানে তিনি যে নীতিশ কুমারের সঙ্গেই আছেন, সে কথাও উল্লেখ করেন মি. যাদব।

“যেসব উদ্যোগ বা বৈঠকগুলোর কথা আমরা জানতে পারছি সংবাদ মাধ্যমে, তার বাইরে নিয়মিতই আলোচনা, যোগাযোগ থাকছে বিরোধী দলগুলো মধ্যে। আবার বিজেপি-বিরোধী দলগুলো যেসব রাজ্যে সরকার চালায়, তাদের মধ্যেও সরকার পরিচালনা নিয়েও নানা স্তরে আলোচনা চলছে আগে থেকেই। সেই প্রক্রিয়াগুলোকেই কী করে একটা ফোকাসে, অর্থাৎ, বিজেপি-বিরোধিতার জায়গাটাকে মূল লক্ষ্য করে তোলা যায়, সেটা নিয়েই এখন আলোচনা চলছে,” বলছিলেন কলামিস্ট ও বিশ্লেষক শিখা মুখার্জী।

লোকসভা ভোটের আগে মে মাসে কর্ণাটকে বিধানসভা নির্বাচন হবে, আর বছরের শেষ দিকে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানার মতো রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলিতে ভোট আছে।মিজ মুখার্জীর ব্যাখ্যা লোকসভা নির্বাচনে যাওয়ার আগে এই রাজ্য বিধানসভার ভোটগুলোতেও বিজেপি-বিরোধী জোট কতটা দানা বাঁধতে পারে, সেটাও যাচাই করে নেওয়ার একটা সুযোগ রয়েছে।

আগেও নেওয়া হয়েছিল এধরণের উদ্যোগ

গত বেশ কয়েকটি নির্বাচনের আগেই দেখা গেছে বিজেপি-বিরোধী দলগুলি একজোট হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু কোন-না-কোনভাবে তা ব্যর্থ হয়।ব্যর্থতার মূল কারণ হয়ে ওঠে বিরোধী জোটের নেতৃত্ব দেওয়া নিয়েই। এছাড়াও যে রাজ্যে যে আঞ্চলিক দল শক্তিশালী, তারাই সেখানে নিজেদের জন্য বেশি আসনে লড়তে চায়, তাই অন্য জোট সঙ্গীদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির আলোচনাও ভেস্তে যায়।

বিশ্লেষকরা মনে করেন কংগ্রেস সবসময়েই এধরণের জোটে নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে এসেছে, আবার তৃণমূল কংগ্রেসের মতো আঞ্চলিক দলগুলিও লোকসভায় যথেষ্ট সংখ্যক সংসদ সদস্য রয়েছে, তাই তাদেরও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা থাকে জাতীয় স্তরে বিরোধী জোটের নেতৃত্বে আসার।“কিন্তু এবার যে উদ্যোগটা নেওয়া হয়েছে, সেখানে কংগ্রেস নিজেদের ভূমিকাটা খুব বড় করে দেখাচ্ছে না। সেজন্যই নীতিশ কুমার আলোচনা চালাচ্ছেন আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে,” বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক রজত রায়।

মমতা ব্যানার্জীর একটা আকাঙ্ক্ষা থাকত বিরোধী জোটের নেতৃত্বে আসার। আবার তিনি কংগ্রেসকেও নেতৃত্বে আসতে দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন।“২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেও কলকাতায় সারা ভারতের সব বিজেপি বিরোধী নেতাদের নিয়ে এসে একটা বড় সমাবেশ করেছিলেন মিজ ব্যানার্জী। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব আর মায়বতীর দল বহুজন সমাজ পার্টি সেখানে ছিল না।"

"কিন্তু এবারে দেখা যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস সেই জায়গাটা থেকে সরে এসেছে। মমতা ব্যানার্জী বুঝতে পেরেছেন যে কংগ্রেস-হীন বিরোধী জোট করা প্রায় অসম্ভব। অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলো সেটা চায় না,” বলছিলেন রজত রায়।

আবার নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির আক্রমণাত্মক রাজনীতির কারণে, বিভিন্ন দুর্নীতিতে দলের শীর্ষ নেতাদের জড়িয়ে যাওয়ায় মমতা ব্যানার্জী কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছেন। তাই তিনি যাতে বিজেপি-বিরোধী জোটের ক্ষেত্রে একঘরে না হয়ে পড়েন, সেজন্যই তিনি আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন।রজত রায়ের কথায়, “এটা বিজেপি-বিরোধিতার ক্ষেত্রে মিজ ব্যানার্জীর নিজের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন।“

শুধু যে মমতা ব্যানার্জীর অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন এই বিজেপি-বিরোধী জোট তা নয়। বিহারের সিনিয়র সাংবাদিক নচিকেতা নারায়ণ বলছেন, “প্রতিটা বিরোধী দলের কাছেই একটা অস্তিত্বের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সবাই অনুভব করছে বিজেপি তাদের জন্য একটা বিপদ। সেটা যেমন কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে ব্যবহার করে বিরোধী দলীয় নেতা নেত্রীদের তদন্তের আওতায় আনার ঘটনাগুলোর জন্য, তেমনই বিজেপির হাতে থাকা বিপুল অর্থভাণ্ডারের জন্যও। তাই বিরোধী দলগুলো নিজেদের বাঁচাতেই এধরণের উদ্যোগ নিয়েছে।“

শিখা মুখার্জী বলছেন, নীতিশ কুমারের সঙ্গে বৈঠকের পরে মমতা ব্যানার্জী একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, যে এখানে কোনও ইগোর ব্যাপার নেই।তার বিশ্লেষণ, এই কথাটার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে বিরোধী জোটের নেতৃত্ব নিয়ে আগে তার যে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটা সরিয়ে রেখেই তিনি এগোতে চান অন্য বিরোধী নেতাদের সঙ্গে।বিজেপিও বিরোধী জোট প্রচেষ্টার নেতৃত্ব নিয়েই কটাক্ষ করছে।দলের তথ্যপ্রযুক্তি সেলের প্রধান অমিত মালভীয়া টুইট করেছেন যে বিরোধীরা সবাই তো একে অপরের সঙ্গে বৈঠক করছেন, কিন্তু এদের নেতা কে?

বড় রাজ্যগুলিতে কোন দলের কী পরিস্থিতি?

সেফলজিস্ট বা নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন ২০১৯ সালে বিজেপি বিপুল সংখ্যক আসন নিয়ে ক্ষমতায় এলেও দেশের মোট ভোটদাতার মাত্র ৩৭.৩৬ শতাংশ তারা পেয়েছিল।তার পর থেকে কোনও রাজ্যে তাদের ভোট বেড়েছে, কোথাও তাদের বিরোধী দলও পেয়েছে বাড়তি ভোট।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরীর কথায়, “পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দেখা যাবে ২০১৯ এর পরে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রায় ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে, আবার বিজেপির ভোটও বেড়েছে এখানে।""বিহারে গত নির্বাচনের সংখ্যাতত্ত্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রীয় জনতা দল এবং জনতা দল ইউনাইটেডের মোট ভোট বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের থেকে অনেক বেশি। তাই ওই রাজ্যে বিজেপি বিরোধী সম্ভাব্য জোট ভাল অবস্থানে আছে।

“লোকসভা আসনের নিরিখে সব থেকে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে বিজেপির যেমন ভোট বেড়েছে, আবার প্রধান বিরোধী দল অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টির ভোটও বেড়েছে। কংগ্রেসর সামান্য ভোট আছে সেখানে, ১০ শতাংশ মতো।""কিন্তু উত্তরপ্রদেশের সমস্যা হচ্ছে মায়বতীর বহুজন সমাজ পার্টি কোনভাবেই বিজেপি বিরোধী জোটে আসবেন বলে মনে হয় না। আবার যোগী আদিত্যনাথের একটা ইমেজও সেখানে কাজ করবে। তাই উত্তরপ্রদেশে বিজেপি বিরোধী জোট কতটা ফলপ্রসূ হবে বলা কঠিন,” বলছিলেন মি. বসুরায়চৌধুরী।

মহারাষ্ট্রও আসন সংখ্যার দিক থেকে বড় রাজ্য। সেখানে ৪৮টি লোকসভা আসন আছে। কিন্তু কংগ্রেস-শারদ পাওয়ারের এনসিপি এবং শিবসেনার সরকার উল্টিয়ে দিয়ে বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতা দখল করেছে শিবসেনার একটি বড় অংশ।আবার এনসিপির ভেতরেও একটা অংশ বিজেপির দিকে কিছুটা ঝুঁকে আছে, এমন খবর সংবাদমাধ্যমেই বেরচ্ছে।এই রাজ্যে বিরোধী জোট কতটা সফল হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।তবে সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী বলছেন, “সম্ভাব্য বিরোধী জোটের একটা পরীক্ষা হবে মে মাসের কর্ণাটক নির্বাচনে।“

পশ্চিমবঙ্গ, কেরালায় কীভাবে সম্ভব বিরোধী জোট?

এই দুটি রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী দলগুলি আবার একে অপরের প্রবল বিরোধী।পশ্চিমবঙ্গে যেমন কংগ্রেস আর তৃণমূল কংগ্রেস পরস্পরের বিরোধী, তেমনই এই রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস-বিরোধী জোটে আছে কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট।তারা কি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপি-বিরোধী জোটে অংশ নেবে?পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস আর বামফ্রন্ট একজোট হয়েছে, কিন্তু কেরালাতে চিত্রটা সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে ক্ষমতায় আছে বামফ্রন্ট আর তাদের প্রবল লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গে।সেখানেও বিজেপি-বিরোধী জোটে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের এক মঞ্চে আসা কঠিন।

সূত্র : বিবিসি