জ্বালানি তেলের দাম স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নির্ধারণ হলে ভোক্তাদের কি লাভ হবে?

জ্বালানি তেলের দাম স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নির্ধারণ হলে ভোক্তাদের কি লাভ হবে?

জ্বালানি তেলের দাম স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নির্ধারণ হলে ভোক্তাদের কি লাভ হবে?

আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করতে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। যেটাকে বলা হচ্ছে, জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি বা অটোমেটেড প্রাইসিং ফর্মুলা।এই ফর্মুলায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যে দামে তেল আমদানি করা হবে, সেই দামেই তেল বিক্রি করা হবে।

জ্বালানি মন্ত্রনালয়ের একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাম নির্ধারণ হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে কবে নাগাদ এটি বাস্তবায়ন হবে সেটি এখনো ঠিক হয়নি। কিন্তু সে কর্মকর্তা ধারণা দিয়েছেন যে আগামী কয়েকমাসের মধ্যেই এটি বাস্তবায়নের জোরালো সম্ভাবনা আছে।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যেসব শর্ত দিয়েছে, তার একটি হচ্ছে জ্বালানি তেলের ওপর থেকে ভর্তুকি কমিয়ে আনা। সেখানে জ্বালানির মূল্য-নির্ধারণ পদ্ধতি বাজারের ওপরেও ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে প্রতিমাসে যেন তেল ও গ্যাসের মতো জ্বালানির মূল্য সমন্বয় কীভাবে করা যায়, সেই সংক্রান্ত একটি কৌশল নির্ধারণের কাজ চলছে।

আইএমএফ এর একটি প্রতিনিধিদল এখন বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন এবং তাদের এই সফরে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের বিষয়টি আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে।প্রশ্ন হচ্ছে, জ্বালানি তেলের দাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারণ করা হলে ভোক্তাদের কী লাভ হবে?জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিশ্ব বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করার উদ্যোগটি ইতিবাচক। তবে এর ফলে ভোক্তার ওপর যেন কোনও নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

পরিবহন ভাড়া ও দ্রব্যমূল্য জটিল ইস্যু

বাংলাদেশে প্রতিবারই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবহন ভাড়া ও দ্রব্যমূল্যও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।নতুন পদ্ধতি অনুযায়ী বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশেও দাম বাড়বে এবং বিশ্ববাজারে দাম কমলে বাংলাদেশেও দাম কমবে।বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলছেন, জ্বালানি তেলের দাম কমলে তখন পরিবহন ভাড়া কি কমবে?সাধারণ মানুষের অভিযোগ হচ্ছে, বাংলাদেশে শুধু দাম বৃদ্ধির প্রবণতাই দেখা যায়, কখনো কমে না।

স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ হলে পরিবহনের ভাড়া কীভাবে নির্ধারণ করা হবে, তা একটা জটিল ইস্যু বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এজাজ হোসাইন।তিনি মনে করেন, প্রতিবেশী দেশ বা অন্য যেসব দেশ এই ফর্মুলায় চলছে সেটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সরকারকে কাজ করতে হবে যাতে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়।

“তেলের দাম কখনও ১২০ ডলারে যাবে কখনও আবার কখনও ৬০ ডলারেও আসতে পারে। তাহলে বাস বা ট্রাকের ভাড়াটা কীভাবে নির্ধারণ হবে? মাঝামাঝি কোনও এটা জায়গায় দামটা ফিক্সড করে দিলে সেখান থেকে ১০ ডলার বেশি বা কম হলে তাহলে সেটা অ্যাডজাস্টেবল হবে” বলছিলেন মি. হোসাইন।এক্ষেত্রে সরকারি নজরদারি খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।“এসব বিষয় কখনোই নজরদারি ছাড়া ঠিকমতো প্রয়োগ হয় না। তেলের দাম নির্ধারণের ফর্মুলা, ভাড়ার ফর্মুলা ও নজরদারি এই তিনটা যদি একসঙ্গে কাজ করানো যায় তাহলে ভোক্তারা লাভবান হবে”।

পরিবহনের সাথে দ্রব্যমূল্যের একটা বড় সংযোগ আছে। পরিবহনের ভাড়া ঠিকমতো যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় না তাহলে মূল্যস্ফীতির এই সময়টায় আমদানি-রপ্তানির পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও একটা ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সবসময় দেখা গেছে যে জ্বালানি তেলের দাম যতটা বৃদ্ধি পায়, তার চেয়ে পরিবহন ভাড়া অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়।

"আবার যখন জ্বালানি তেলের দাম কমলো তখন কিন্তু ভাড়া কমার কমা। কিন্তু সেটা হতে আমরা দেখি না। ফলে স্বয়ংক্রিভাবে আমাদের দেশে এটা কাজ না করার আশঙ্কাই বেশি” বলেন মি. মোয়াজ্জেম ।যেসব দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারিত হয়, সেসব দেশের সরকার বিষয়টিকে দক্ষতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে। যাতে দর উঠা-নামার সুযোগে জনজীবন বিপর্যস্ত না হয়।বিভিন্ন খাতে এই স্বয়ংক্রিয় মেকানিজমগুলো কীভাবে কাজ করবে এবং অন্যান্য দেশে এগুলো কীভাবে নিশ্চিত করা হয়, সে বিষয়গুলোর দিকে সরকারের ঘনিষ্ঠ নজর রাখা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মেকানিজম নির্ধারণ

বাংলাদেশে এখন যেভাবে এলপিজির দাম নির্ধারণ করা হয় সেভাবে প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের দামও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্ধারণ করার কথা ভাবা হচ্ছে।

যে নতুন কৌশল নেয়ার পরিকল্পনা চলছে তার মাধ্যমে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমাতে পারবে সরকার। এখানে উল্লেখ্য, আইএমএফ এর সুপারিশ ছিল জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে নেয়া।বিশ্লেষকরা বলছেন আইএমএফ এর শর্ত পূরণে এই অটোমেটেড প্রাইসিং ফর্মুলার দিকে এগুচ্ছে সরকার এবং এর মাধ্যমে সরকার নিজেও ভর্তুকি ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

যে ফর্মুলার কথা বলা হচ্ছে এটা নতুন কোনো ফর্মুলা নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই এভাবে বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়।আমদানি করা জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে সারা বিশ্বে প্রধানত তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।অধিকাংশ দেশ মার্কেট ডিটারমাইন্ড বা বাজার দরের সঙ্গে সমন্বয় পদ্ধতি অনুসরণ করে। আবার কোন কোন দেশ সর্বোচ্চ দর বা প্রাইস সিলিং পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশের মতো কিছু দেশ ফিক্সড প্রাইস বা নির্ধারিত দরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে।

নতুন ফর্মুলা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মাসের শুরুর দিকে যে দাম থাকবে, তার সঙ্গে পরিবহন খরচ, ডিলারদের কমিশন ইত্যাদি যোগ করে দেশের বাজারে তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হবে।ফলে যখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে, দেশের বাজারেও সেটা বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে গেলে দেশের বাজারেও দাম সেই হারে কমবে।

এরকম হলে ভোক্তা লাভবান হবে উল্লেখ করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেছেন “অটো-অ্যাডজেস্টমেন্ট ভালো সিস্টেম। আমাদের দেশে যেটা আছে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে বাড়লে আমরা বাড়ায়ে দেই কিন্তু কমলে তখন আর ওভাবে দেশে কমে না”।কোভিডের সময় আর গত বছর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে তেলের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে মি. ইমাম বলেন- “যখন তেলের মূল্য বিশ্বে একদম নীচে নেমে গেছিল আমাদের দেশে কিন্তু সেরকম হয় নাই। অথচ আগে যে উচ্চ মূল্যে চলে গেছিল সেটাই রয়ে গেছে”। ফলে এমন ফর্মুলা ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে বলেই মনে করছেন তিনি।

তবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে সরকারের বিবেচনায় রাখা দরকার বলে মনে করছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডির গবেষণা পরিচালক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন।তিনি বলছেন “ এই মুহূর্তে জ্বালানি তেলের যে মূল্যটি রয়েছে বাজারকেন্দ্রিক সঠিক মূল্য নয়। সঠিক মূল্যটি নির্ধারিত হওয়া দরকার”।

তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে তেল-ভিত্তিক কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে। এই ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ যে অর্থ খরচ হচ্ছে সেটি জ্বালানি তেলের দামের ভেতরে দেখানো হচ্ছে।ক্যাপাসিটি চার্জ বাদ দিয়ে যেন জ্বলানি তেলের বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হয় সে পরামর্শ দিচ্ছেন মি. মোয়াজ্জেম।বাজারমূল্য নির্ধারণ করবার ক্ষেত্রে যে মানদণ্ড ব্যবহার করা হবে সেটি যেন সঠিকভাবে ওঠানামা করে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সরাসরি ওঠানামা না করে একটা ‘গ্যাপ নিয়ে’ যেন মূল্য ওঠানামা করে সেদিকে লক্ষ্য রাখা বলে মন্তব্য করেছেন মি. হোসেন।“নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের কথা ভেবে যারা বিপুল পরিমাণ জ্বালানি মূল্য দেবার মতো পরিস্থিতিতে নেই তাদের জন্য এটা দরকার হবে” বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি