নির্বাচন কমিশন থেকে এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্রে গেলে কী পরিবর্তন আসবে?

নির্বাচন কমিশন থেকে এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্রে গেলে কী পরিবর্তন আসবে?

নির্বাচন কমিশন থেকে এনআইডি সেবা স্বরাষ্ট্রে গেলে কী পরিবর্তন আসবে?

বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্ম থেকেই একটি ইউনিক নাম্বার দেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয় পত্র বা এনআইডির দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেয়ার পর এই কার্যক্রম শুরু করা হবে।সোমবার জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন-২০২৩ নামের একটি নতুন আইনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা।

এতদিন ধরে জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকলেও এখন থেকে সেটি থাকবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের নিয়ন্ত্রণে। এজন্য একটি নিবন্ধনের কার্যালয়ও স্থাপন করা হবে।খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ায় এখন সেটি সংসদে পাঠানো হবে। সেখানে যাচাই বাছাইয়ের পর অনুমোদন দেয়া হলে আইনে পরিণত হবে।

এই স্থানান্তরের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে আপত্তি জানালেও সরকার অবশেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।এ নিয়ে কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান মন্তব্য করেছিলেন, তার মন্ত্রণালয়ের অধীনে এলে সেবা নিয়ে কোন জটিলতা বা নির্বাচন কমিশনের সাথে কোন সমন্বয়হীনতার আশংকা থাকবে না।

"সঙ্গত কারণেই এটা সরকার যথাস্থানে আনার নির্দেশনা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কাজ সাধারণত ভোটার তালিকা তৈরি করা। সেটা তৈরির যত ধরণের সহযোগিতা এখান থেকে পাওয়ার - সেটা তারা পাবেন। কাজেই এ নিয়ে সমন্বয়হীনতার প্রশ্নও আসে না"।কিন্তু এর ফলে জাতীয় পরিচয় পত্রের সেবায় কি পরিবর্তন হবে?

সব সেবায় এক নাম্বার

আইনে বলা হয়েছে, জন্ম নেয়ার পর থেকেই সবার জন্য একটি ইউনিক নাম্বার দেয়া হবে।মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন বলেন, যেকোনো নাগরিকের জন্মের পরপরই নাগরিক সনদ বা একটি নম্বর পাবেন। এই আইডি হবে ব্যক্তির পরিচিত নম্বর। এই নম্বরটি সারাজীবন তার সাথে থাকবে, এটা আর কখনো পরিবর্তন করা যাবে না।

বর্তমানে প্রতিটি ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ইত্যাদি আলাদা আলাদা নম্বর রয়েছে। কিন্তু নতুন আইনের ফলে তাকে আর এতগুলো নাম্বার ব্যবহার করতে হবে না। তার এই একটি ইউনিক নাম্বার দিয়েই সকল তথ্য পাওয়া যাবে।পাসপোর্ট, ব্যাংক বা ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে এই নম্বরটি দেয়া থাকবে। ফলে এটি ব্যবহার করে একজন ব্যক্তির সম্পর্কে সকল তথ্যও জানা যাবে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন বলেছেন, “আমাদের মূল উদ্দেশ্য… সব নাগরিকের একটি ইউনিক নম্বর থাকা দরকার। এতদিন হয়ত বিভিন্ন ধাপে নম্বরগুলো দিয়েছি। যেটা নিয়ে এখন অনেক সময় কনফিউশন তৈরি করছে। এখন প্রত্যেক নাগরিকের একটি নম্বর থাকবে, যেটি তার আইডেন্টিটি হবে। সেটার ভিত্তিতে তার সমগ্র জীবনে, আমাদের যেমন সিআরভিএস তথ্য আছে, সেগুলো আপডেট করবে। এটা আস্তে আস্তে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করব।”

বাড়তি কী সুবিধা পাওয়া যাবে?

জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''অনেক দেশে নাগরিকদের এরকম নম্বর থাকে। সেটা দিয়ে তার সকল তথ্য জানা যায়। তিনিও একটি নম্বর ব্যবহার করে সব সেবা পেতে পারেন।''

"কিন্তু আমাদের দেশে স্কুল কলেজে ব্যবহার করা জন্ম নিবন্ধনে একটি নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্রে আরেকটি, পাসপোর্টে আরেকটি নাম্বার ব্যবহার হয়। ফলে একজন ব্যক্তিকে অনেকগুলো নাম্বার ব্যবহার করতে হচ্ছে। এই ইউনিক নাম্বার হলে এইটি নাম্বার দিয়েই তিনি সব সেবা নিতে পারবেন।''

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে জন্মনিবন্ধন নাম্বার ব্যবহার করে স্কুল কলেজে ভর্তি বা পড়াশোনা করতে হয়। এরপর তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রে পেলেও আগের নম্বরের সঙ্গে ধারাবাহিকতা থাকে না। কিন্তু নতুন ব্যবস্থার ফলে একজন ব্যক্তি একটি সেবা নাম্বার দিয়েই সব সুবিধা পাবেন। আবার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও একটি নাম্বার ব্যবহার করে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে সব তথ্য পাবেন।

কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে, এখন একজন নাগরিককে জন্ম নিবন্ধন নাম্বার, জাতীয় পরিচয় পত্র নাম্বার, ভোটার নাম্বার, আয়কর টিন নাম্বার, ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নাম্বার, পাসপোর্ট নাম্বার-এধরনের অনেক নাম্বার ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু ইউনিক আইডি নাম্বার দেয়া হলে সব ক্ষেত্রে এই একটি নাম্বার ব্যবহার করে সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।

এর আগে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন, একজন নাগরিক জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটি নাম্বার ব্যবহার করবেন এবং মৃত্যুর পরও সেই নাগরিক সম্পত্তি বন্টন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে ঐ নাম্বার বাধ্যতামূলক করা হবে।

কবে থেকে এই ব্যবস্থা চালু হবে?

মন্ত্রিপরিষদে খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এরপর এই খসড়া জাতীয় সংসদে যাবে। সেখানে পাস হলেই আইনে পরিণত হবে।

তবে আইনে পাস হলেই এটি কার্যকর হবে না। কারণ এখানে একটা বিধান রাখা হয়েছে যে, সরকারের নির্ধারিত তারিখ থেকে সেটি কার্যকর হবে।

অর্থাৎ সরকার যেদিন থেকে এই আইন কার্যকরের ঘোষণা দেবে, সেদিন থেকে তা কার্যকর বলে গণ্য করা হবে।আইন কার্যকর করার আগে বিধিমালা তৈরি, নিবন্ধকের অফিস স্থাপনে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিতে হলে তাদের কার্যালয়, যন্ত্রপাতি প্রয়োজন রয়েছে।নির্বাচনের আগে আইনটি পাস হবে কিনা, তা নিয়ে পরিষ্কার কোন তথ্য জানাতে পারেননি কর্মকর্তারা।

এনআইডি সংক্রান্ত সেবা কে দেবে?

বাংলাদেশের সরকার জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন-২০২৩ যতদিন পর্যন্ত কার্যকর বলে ঘোষণা না দেবে, ততদিন এনআইডি সংক্রান্ত সেবা এখনকার মতো নির্বাচন কমিশন দিয়ে যাবে।ফলে ওই ঘোষণা না আসা পর্যন্ত, পরিবর্তন, পুনর্মুদ্রণ বা যেকোনো সেবার জন্য এখনকার মতো নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচন কর্মকর্তার দপ্তরে যোগাযোগ করতে হবে।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, যতদিন পর্যন্ত নিবন্ধকের অফিস এবং জনবল প্রস্তুত না হবে,ততোদিন এই সেবা এখনকার মতো নির্বাচন কমিশনের কাছেই থাকবে।

যাদের বর্তমানে যে এনআইডি রয়েছে, তাদের কী হবে?

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন বলেন, যাদের বর্তমানে এনআইডি নম্বর রয়েছে, সেগুলো চালু থাকবে। এটি বর্তমানে তার ইউনিক নাম্বার হিসাবে ব্যবহার করা হবে।তাদের জন্য নতুন কোন নাম্বার দেয়ার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

তবে ভবিষ্যতে শিশু জন্মের সাথে সাথে তাকে ইউনিক আইডি নম্বর দিয়ে দেয়া হবে। তখন আর আলাদা করে জন্ম নিবন্ধন নম্বর রাখতে হবে না। জন্মের পর ৪৫ দিনের মধ্যে ১০ ডিজিটের ইউনিক নাম্বার নিতে হবে। মৃত্যু পর্যন্ত এই নাম্বার দিয়েই একজন নাগরিককে চিহ্নিত করা হবে।যাদের এখনো জন্মনিবন্ধন হয়নি বা এনআইডি হয়নি, তারা এখন থেকে নতুন নম্বরটি ব্যবহার করবেন।

মি. হোসেন বলেন, তারা এখন থেকে নতুন নম্বর নেবে। এখন থেকে সব জায়গায় এ নম্বরটি ব্যবহার হবে। যখন সে এই নম্বরটি পেয়ে যাবে, তখন আর কোনও নম্বর লাগবে না।কর্তৃপক্ষ বলেছে, স্কুল কলেজে ভর্তি এবং হাসপাতালে চিকিৎসা সেবাসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা পেতে এই নাম্বার বাধ্যতামূলক করা হবে।

ভোটার তালিকার কী হবে?

বর্তমানে ভোটার তালিকার কাজ করে থাকে নির্বাচন কমিশন। এই কারণে জাতীয় পরিচয় পত্রের সার্ভারও কমিশনের অধীনে রয়েছে। তবে আইনটি পাস হলে এই সার্ভার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে যাবে।

দু'হাজার সাত সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরির অংশ হিসাবে প্রথমে ভোটার পরিচয়পত্র তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল।সেই প্রক্রিয়াতেই ভোটার পরিচয়পত্রের বদলে জাতীয় পরিচয়পত্র করা হয়।

তখন সেনাবাহিনীর সহায়তায় নির্বাচন কমিশন ডোটাবেজ তৈরি করে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েছিল।এরপর থেকে সেসব তথ্যের ব্যবস্থাপনা এবং সেবা দেয়ার দায়িত্ব পালন করছে নির্বাচন কমিশন।নতুন একটি নিবন্ধন দপ্তর এই সেবা দেয়ার কাজ করবে।

কিন্তু ভোটার তালিকার কী হবে?

কর্মকর্তারা বলেছেন, নির্বাচন কমিশন যেহেতু ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের নিয়ে ভোটার তালিকা করে। ফলে এখানে যেসব নম্বর থাকে, তাদের মধ্যে ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের নম্বর নিয়ে ভোটার তালিকা তৈরি করবে নির্বাচন কমিশন।

মাহবুব হোসেন বলেছেন, নির্বাচন কমিশন ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে। এখানে যে এনআইডি থাকবে বা এনআইডিপ্রাপ্ত যে জনসংখ্যা থাকবে তাদের মধ্য থেকে এই নাম্বার ব্যবহার করে তারা সেটি করতে পারবে।”তবে এনআইডির যে তথ্যভাণ্ডার রয়েছে, সেটি নির্বাচন কমিশনের দপ্তর থকে নিবন্ধকের দপ্তরে নিয়ে আসা হবে।

এনআইডির ভুল সংশোধন কীভাবে হবে?

কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ব্যবস্থায় আলাদা করে একটি নিবন্ধকের কার্যালয় স্থাপন করা হবে। ওই দপ্তরের জন্য বিধিমালাও তৈরি করা হবে। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী তিনি জেলা বা উপজেলায় কার্যালয় স্থাপন করবেন। এই অফিস থেকে এনআইডি সংক্রান্ত সকল সেবা দেয়া হবে।

এর ফলে এনআইডি নিয়ে মানুষের ভোগান্তি দূর হবে বলে কর্মকর্তারা বলছেন।মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন বলেছেন, "এনআইডির ভুল থাকলে সেগুলো কীভাবে সংশোধন করার ব্যবস্থা সহজ করার সব ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনীয় যে জনবল লাগবে, তা তারা নেবেন, সেভাবেই অর্গানোগ্রাম তৈরি করবেন।"

সূত্র : বিবিসি