ভুল চিকিৎসার নবজাতক হারালেন এক মা

ভুল চিকিৎসার নবজাতক হারালেন এক মা

সংগৃহিত ছবি।

রাজধানীর গ্রিন রোডে অবস্থিত সেন্ট্রাল হসপিটালে ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় মাহবুবা রহমান আঁখি নামে এক প্রসূতি মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন তার স্বামী। হাপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় মারা গেছে তাদের নবজাতক সন্তানও। স্ত্রীকে জীবিত ফিরে পেতে এখন আর্তনাদ করছেন স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন।

বুধবার (১৪ জুন) ঢাকা  প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে এসব অভিযোগ করেন ইয়াকুব আলী।

জানা গেছে, গত তিন মাস ধরে সেন্ট্রাল হসপিটালের গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন মাহবুবা রহমান আঁখি। এমনকি তার শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক ছিল বলেও চিকিৎসক জানিয়েছিলেন। নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমেই সন্তান প্রসব সম্ভব বলে আশ্বস্ত করেছিলেন ডা. সংযুক্তা সাহা।

কী হয়েছিল আঁখির চিকিৎসা নিয়ে?

প্রসব ব্যথা ওঠায় গত শুক্রবার (৯ জুন) রাত ১২টা ৫০ মিনিটে সেন্ট্রাল হসপিটালে ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে ভর্তি করা হয় মাহবুবা রহমান আঁখিকে। তখন ডা. সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন না, তারপরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি আছেন এবং ওটিতে (অপারেশন থিয়েটার) কাজ করছেন।

এ বিষয়ে আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্ত্রীকে যখন ওটিতে ঢুকানো হয় এবং নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা শুরু করা হয়, তখনও আমি সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে আছেন কি না জানতে চাই। কর্তৃপক্ষ জানায়, তিনি আছেন এবং তিনি তার চেষ্টা চালাচ্ছেন। পরে জানতে পেরেছি ডা. সংযুক্তা সাহা ছিলেন না এবং তারা রোগীর কোনোরকম চেক-আপ ছাড়াই ডেলিভারির কাজ শুরু করে দেন।

ইয়াকুব আলী বলেন, গত শুক্রবার রাতে আঁখি সেন্সলেস হয়েছে, এখন পর্যন্ত (বুধবার) তার জ্ঞান ফেরেনি। আজ পর্যন্ত কোনো ইমপ্রুভমেন্ট নেই, ডাক্তার বলেছেন তার ইমপ্রুভমেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাও কম। বর্তমানে তার কিডনি, লিভার, হার্ট এবং অন্য কোনো অংশ কাজ করছে না। এর মধ্যে সে ব্রেইন স্ট্রোকও করেছে, তার সঙ্গে রক্তক্ষরণও বন্ধ হচ্ছে না। রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ার কারণে শরীরের অন্য অংশগুলো কাজ করতে পারছে না। গত চার দিন ধরে প্রচুর পরিমাণে রক্ত দিতে হচ্ছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তার নিঃশ্বাস চলবে ততক্ষণ পর্যন্ত রক্ত দিতে হবে।

তিনি বলেন, রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার কোনো উপায় নেই, তাই ডাক্তার বলেছেন এভাবে কতক্ষণ তাকে তারা বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। গতকাল এবং আজকেও ল্যাব-এইডের ডাক্তাররা মেডিকেল টিম বসিয়েছেন তাকে কোনো ভাবে বাঁচানো যায় কি না, কিন্তু তারা ব্যর্থ, কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না।

আঁখির স্বামী আরও বলেন, আমি আমার সন্তানকে এরই মধ্যে হারিয়েছি। স্ত্রীর অবস্থা নাজুক। আঁখির যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমি বাড়িতে কী নিয়ে ফিরব? সন্তান হারিয়েছি আফসোস নেই, কিন্তু যে কোনো মূল্যে আমি আমার স্ত্রীকে ফেরত চাই।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভুল চিকিৎসার বলি আঁখির নবজাতক

আঁখির সহপাঠী উম্মে মায়া বৃষ্টি বলেন, আঁখি যথেষ্ট পরিমাণ স্ট্রং একটা মেয়ে এবং সে নিজেও নরমাল ডেলিভারির জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু যে চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করে আমার বান্ধবী সেন্ট্রাল হসপিটালে গিয়েছিল, সেই চিকিৎসক সেদিন হাসপাতালেই ছিলেন না। এরপরও কর্তৃপক্ষ তার পরিবারকে মিথ্যা বলেছে, যে তিনি আছেন এবং তিনি তার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এটা তো বড় ধরনের প্রতারণা। এমনকি সেদিন ডা. সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে উপস্থিত না থাকলেও অন্য একজন গাইনি অভিজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে তারা পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করতে পারত। কিন্তু সেটি না করে ডেলিভারি করানো হয় সংযুক্তা সাহার সহকারী আরেক অনভিজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে।

তিনি বলেন, ডেলিভারির সময় রাতে উপস্থিত চিকিৎসক আমার বান্ধবীকে প্রেসার দিতে বলেন। এক পর্যায় অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর তারা সাইড কেটে দেন। কিন্তু সাইড কাটতে গিয়ে তারা মূত্রনালি ও মলদ্বার কেটে ফেলেন, যার ফলে সাথে সাথেই প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ শুরু হতে থাকে এবং আমার বান্ধবী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সেন্সলেস অবস্থায় তারা আমার বান্ধবীকে আবার সিজার করে বেবি বের করে এবং কাটা জায়গা সেলাই করে দেয়।

 

এদিকে আমার বান্ধবীর শরীর যখন অনেক বেশি খারাপ হতে থাকে, তখন তারা হসপিটালে উপস্থিত আঁখির স্বামীকে জানায়, আপনার বাচ্চার অবস্থা খুবই খারাপ, আমরা আপনার বাচ্চাকে আইসিইউতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। তখন সে বারবার জানতে চায় ডাক্তার কোথায়? তখন তারা জানায়, ডাক্তার দেশের বাইরে আছেন। পরে দ্রুত রোগীকে ল্যাব-এইডে শিফট করানোর পর সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বেবিটি মারা গেছে।

সহপাঠী বৃষ্টি আরও বলেন, গত শনিবার থেকে এখন পর্যন্ত আমার বান্ধবী ল্যাব-এইডের সিসিইউতে লাইফ সাপোর্টে আছে এবং ডাক্তার বলেছেন তার বাঁচার সম্ভাবনা নেই। কী বলব, বলার কোনো ভাষা নেই। সুস্থ একটা মানুষ হেঁটে সেন্ট্রাল হসপিটালে পছন্দের ডাক্তারের আন্ডারে ডেলিভারি করানোর জন্য এসেছিল। আর এখন তার পুরো শরীর মৃত, ব্রেনের ব্লাড সার্কুলেশনও চলছে না। একটা ভুল চিকিৎসার জন্য দুইটা লাশ পড়ে আছে। আর কতক্ষণ এভাবে তাকে হসপিটালে থাকতে হবে সেটার কোনো ঠিক নেই।

সেন্ট্রাল হসপিটালে এমন ঘটনা অহরহ ঘটে, দাবি ভুক্তভোগীদের

মাহবুবা রহমান আঁখির মর্মান্তিক এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। সেন্ট্রাল হসপিটালের নানা অনিয়মের বিষয়ে মুখ খুলছেন অনেকেই।

একটি পোস্টের কমেন্টে স্নিগ্ধা সোহরাব নামে একজন লিখেছেন, ডা. সংযুক্তা খুবই খারাপ। আন্দাজে আমার ভাইয়ের বউকে প্রায় ১ বছরেরও বেশি সময় ভুল চিকিৎসা দিয়ে বলেছেন, অপারেশন না করলে কখনো বেবি হবে না। তখন আমি বললাম যে, অপারেশন না করে লাস্ট অন্য একজন ডাক্তার দেখাতে। পরবর্তীতে আমার ভাইয়ের বউ কোনো অপারেশন ছাড়াই ২ মাসেই বেবি কনসিভ করে।

ফারজানা নামে আরেকজন লিখেছেন, আমার প্রথম বেবির বেলায় ডা. সংযুক্তা সাহার কাছে নরমাল ডেলিভারির আশায় গিয়েছিলাম এবং তার অধীনেই ছিলাম প্রেগনেন্সিতে। তারপর সিজারে আমার পুরো পেট কেটে ফেলে।

তানিয়া সুলতানা নামে আরেক নারী লেখেন, এ রকম ঘটনা আমাদের সাথেও হয়েছে। সিজারের পর আমার ভাগ্নি মারা গেছে বাচ্চার বয়স এখন ১০ মাস। খুব নির্মম ঘটনাগুলো ইদানীং অনেক হচ্ছে।

আঁখির শারীরিক অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল : ল্যাবএইড

মাহবুবা রহমান আঁখিকে মুমূর্ষু অবস্থায় বর্তমানে ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়েছে। আঁখির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে ধানমন্ডি ল্যাবএইড হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আরিফ রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকা পোস্ট।

তিনি বলেন, সর্বশেষ চিকিৎসকরা আমাদের জানিয়েছেন, রোগীর অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। আমাদের হাসপাতালে ঠিক যেরকম আনা হয়েছিল, এখনও সে রকমই আছে। শারীরিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

তিনি বলেন, শনিবার থেকে রোগী সেন্সল্যাস অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে আছেন। তিনি অধ্যাপক ডা. সোহরাবুজ্জামানের অধীনে চিকিৎসাধীন। আজ মেডিকেল বোর্ডের মিটিং শেষে তার সার্বিক অবস্থা আরও বিস্তারিত জানা যাবে।

চিকিৎসক নার্সসহ ১১ জন বরখাস্ত, তদন্ত কমিটি গঠন

এদিকে ডেলিভারি পরবর্তী সময়ে মাহবুবা রহমান আঁখির শারীরিক অবস্থার অবনতি এবং গাইনি বিভাগ থেকে ডেলিভারি চলাকালীন সময়ে ডা. সংযুক্তা সাহা উপস্থিত আছেন এমন মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ডেলিভারিতে অংশ নেওয়া ডা. শাহজাদী, চিকিৎসক-নার্স এবং আয়াসহ ১১ জনকে তাৎক্ষণিক সাসপেন্ড করা হয়েছে বলে ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন সেন্ট্রাল হসপিটালের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ডা. আফসানা বিনতে গাউস।

তিনি বলেন, আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি, সেই সঙ্গে সেদিন ওটিতে যেসব চিকিৎসক-নার্স উপস্থিত ছিলেন, এমন ১১ জনের সবাইকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আজ থেকেই তদন্ত কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে ওই দিন আসলে কী ঘটনা ঘটেছিল সেটা আমরা জানতে পারব।

তিনি বলেন, রোগীর স্বজনের অভিযোগ হলো, গাইনি বিভাগ থেকে নাকি তাদের জানানো হয়নি যে ডা. সংযুক্তা সাহা ছিলেন না। এমনটি যদি হয়ে থাকে, তাহলে তারা অবশ্যই অন্যায় করেছে।

ডা. আফসানা বলেন, আমাদের হসপিটালে অন্য ধরনের সব রোগী ভর্তি হয় সরাসরি ইমার্জেন্সি বিভাগ হয়ে। তখন রিসিপশন বা ইমার্জেন্সি থেকে আমরা যারা ডিউটিতে থাকি, আমাদের অবহিত করা হয়। কিন্তু গাইনি ডিপার্টমেন্টের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। ওই বিভাগের সব রোগী সরাসরি চলে যান ৫ তলার গাইনি বিভাগে, কারণ সেখানে রোগীকে কিছু প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের খুব বেশি কিছু জানার সুযোগ থাকে না।

তিনি আরও বলেন, সেদিন ডা. সংযুক্তা সাহা দুবাই গিয়েছিলেন, কিন্তু হসপিটাল ম্যানেজমেন্টকে তিনি কিছুই জানিয়ে যাননি। সেদিন রাত দেড়টায় তার ফ্লাইট ছিল, তাই রাত সাড়ে ১২টায় তিনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান। তিনি চলে গেলেও সেদিন সংযুক্তা সাহার সাথে যে টিম কাজ করে, তারা ছিলেন।

নরমাল ডেলিভারি করতে গিয়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে

একজন সুস্থ রোগী সংকটাপন্ন কীভাবে হলো জানতে চাইলে সেন্ট্রাল হসপিটালের এ কর্মকর্তা বলেন, রোগী নিজ ইচ্ছাতেই সেদিন নরমাল ডেলিভারি করতে চেয়েছিলেন। আর সেই চেষ্টা করতে গিয়েই আস্তে আস্তে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের দিকে চলে যায়।

তিনি আরও বলেন, যতটুকু জানতে পেরেছি রোগীর সারাদিন লেবার পেইন ছিল, যাকে আমরা বলি ‘প্রলং লেবার’ বা বিলম্বিত প্রসব। এ রকম প্রলং লেবার থাকলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। যখন তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে, তখন ডা. শাহজাদী ও তার টিম দ্রুত পেশেন্টকে অটিতে নামান এবং বাচ্চাটিকে বের করা হয়। পরে পেশেন্টকে আইসিইউতে এবং বাচ্চাটিকে এনআইসিইউতে শিফট করা হয়।

ভুল চিকিৎসার অভিযোগ প্রসঙ্গে ডা. আফসানা আরও বলেন, এখানে আসলে কোনো ভুল চিকিৎসা হয়নি। এক্ষেত্রে ভুল হতে পারে যদি সংযুক্তা সাহা যে ছিলেন না, সেটি যদি না জানিয়ে থাকে। এছাড়া চিকিৎসাজনিত কোনো বিষয়ে আমাদের ভুল হয়নি।