ওয়াগনার গ্রুপের প্রকাশ্য বিদ্রোহ কিভাবে দমন করবে মস্কো?

ওয়াগনার গ্রুপের প্রকাশ্য বিদ্রোহ কিভাবে দমন করবে মস্কো?

ওয়াগনার গ্রুপের প্রকাশ্য বিদ্রোহ কিভাবে দমন করবে মস্কো?

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই যে বেসরকারি ভাড়াটে সেনাদলের তৎপরতা নিয়মিত বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনামে হয়েছে সেই ওয়াগনার গ্রুপ ছিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য এক বড় ভরসার জায়গা।

রাশিয়ার নিয়মিত সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি ওয়াগনার গ্রুপের সৈন্যরা তীব্র লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গনে।কিন্তু প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র, ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন এখন নিজেই বিদ্রোহ করেছেন মস্কোর সামরিক নেতৃত্বে বিরুদ্ধে, তার বাহিনী এখন এই সামরিক নেতৃত্বকে উৎখাতের জন্য মস্কো পর্যন্ত যাবে বলে হুমকি দিয়েছেন।

রাশিয়ায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাহিনী এবং মি. প্রিগোশিনের অধীন ভাড়াটে ওয়াগনার বাহিনী এখন কার্যত মুখোমুখি। উভয়পক্ষই বিরোধী শিবিরের সৈন্যদের প্রতি পক্ষত্যাগের আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু কাদের পাল্লা ভারী তা এখনো বোঝা মুশকিল।রাশিয়া এক গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে বলে আশংকা বাড়ছে।

কিন্তু মি. প্রিগোশিনের বাহিনীর কি আসলেই মস্কো পর্যন্ত যাওয়ার সেই সক্ষমতা আছে? নাকি তিনি ক্রেমলিনকে ব্ল্যাক-মেইল করতে চাইছেন?মি. প্রিগোশিন দাবি করে থাকেন তার বাহিনীতে ২৫ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা আছে। এদের অনেকেই বহু মাস ধরে পূর্ব ইউক্রেনে তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল।

সাম্প্রতিক দিনগুলিতে ওয়াগনার গ্রুপ তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে রুশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো সরিয়ে নিচ্ছিল, বিশেষ করে রোস্তভ এবং বেলগোরডে।কিন্তু ওয়াগনার গ্রুপের বেশিরভাগ সৈন্য মস্কো থেকে বহু দূরে।মস্কো পর্যন্ত যেতে হলে মি. প্রিগোশিনের বাহিনীকে শত শত মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে।

রোস্তভের পরিস্থিতি

ওয়াগনার গ্রুপ দাবি করছে, এরই মধ্যে তারা ইউক্রেন সীমান্তবর্তী শহর রোস্তভ দখল করে নিয়েছে। ইউক্রেন সীমান্ত থেকে মাত্র একশো কিলোমিটার দূরের এই শহরে আছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ডের মূল কেন্দ্র। রুশ বাহিনীকে সামরিক রসদ সরবরাহের ক্ষেত্রেও এই শহরটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।বিভিন্ন সূত্রের খবরে দাবি করা হচ্ছে, এটি এখন ওয়াগনার গ্রুপের দখলে।রোস্তভ শহরের একজন বাসিন্দা বিবিসিকে জানিয়েছেন, পুরো শহরের কেন্দ্রস্থল ঘিরে অবরোধ স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে অনেক সৈন্য অবস্থান নিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই বাসিন্দা জানান, “যখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় তারা কারা, সৈন্যরা জবাব দিয়েছে ‘আমরা ভালো লোক।’“শহরের পরিস্থিতি শান্ত, এখানে কোন আতংক নেই। সবকিছু অন্য যে কোন দিনের মতোই স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে”, বলছেন তিনি।এদিকে রোস্তভ অঞ্চলের গভর্নর ভাসিলি গুলুবেভ সেখানকার জনগণের প্রতি প্রেসিডেন্ট পুতিনের পক্ষে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি টেলিগ্রাম চ্যানেলে এক বার্তায় বলেন, “রাশিয়ার ইতিহাসে এমন অনেক সময় এসেছে যখন আমাদের জনগণকে বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে, গৃহযুদ্ধের উস্কানি দেয়ার চেষ্টা হয়েছে- এর ফলে বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু এটি ঘটতে দেয়া যাবে না। রোস্তভ অঞ্চল প্রেসিডেন্ট পুতিনের পক্ষে আছে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।”ইন্সটিটিউট ফর দ্যা স্টাডি অব ওয়ার নামে একটি গবেষণা সংস্থার মতে, রোস্তভে রুশ বাহিনীর অবস্থানের জন্য কোন হুমকি তৈরি হলে তার একটি বিরাট প্রভাব পড়তে পারে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার লড়াইয়ের ওপর।

ভরোনেজে লড়াই এবং আগুনের কুণ্ডলী

কিন্তু ওয়াগনার গ্রুপ রোস্তভে বসে নেই, তাদের বাহিনী এখন সত্যি সত্যি মস্কোর দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে।বিবিসি নিউজ রাশিয়াকে কিছু সূত্র জানিয়েছে, ওয়াগনার গ্রুপ এখন ভরোনেজ শহরের সামরিক স্থাপনাগুলোও দখল করে নিয়েছে। এই ভরোনেজ শহরের অবস্থান রোস্তভ এবং মস্কোর ঠিক মাঝামাঝি।ভরোনেজ অঞ্চলের সরকার গুরুত্বপূর্ণ একটি মহাসড়ক এম-৪ ব্যবহার না করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরগুলো এই মহাসড়কের মাধ্যমেই মস্কোর সঙ্গে যুক্ত।একটি রুশ সামরিক কনভয় এই মহাসড়কে অবস্থান নিয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

রয়টার্স বার্তা সংস্থা জানাচ্ছে, এই ভরোনেজ শহরের কাছে এম-৪ মহাসড়কে ওয়াগনার গ্রুপের একটি কনভয়ের উপর রুশ সামরিক হেলিকপ্টার গুলি চালিয়েছে।তবে ভরোনেজ অঞ্চলের গভর্নর আলেকসান্দর গুসেভ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন একটি সাঁজোয়া বহর ঐ অঞ্চলে চলাচল করছে বলে অনেক গুজব ছড়ানো হচ্ছে।

তিনি বলেছেন, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী সেখানে পূর্বঘোষিত ‘সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযানের’ অংশ হিসেবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।এদিকে ভরোনেজ অঞ্চলের একটি তেলের ডিপোতে বিরাট আগুন জ্বলছে। আঞ্চলিক গভর্নর আলেকসান্দর গুসেভ জানিয়েছেন, একশো দমকল কর্মী সেখানে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে।সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা ভিডিওতে দেখা যায়, তেলের ডিপোর এই আগুন থেকে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে আকাশে।

সংঘাত না আপসরফা

এই সংকটের সমাধান শেষ পর্যন্ত কিভাবে হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।প্রেসিডেন্ট পুতিনের একজন সাবেক উপদেষ্টা সের্গেই মারকভ বিবিসিকে বলেন, সামরিক দিক থেকে বিবেচনা করলে পরিস্থিতি খুবই বিপদজনক।তিনি বলেন, ওয়াগনার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আছে দশ হতে বিশ হাজার সৈন্য। এদের বেশিরভাগই এখন রোস্তভ শহরে। রোস্তভ শহর বেশ বড় শহর। দশ লাখের বেশি মানুষ আছে এই শহরে।“শহর এলাকার লড়াইয়ে ওয়াগনার গ্রুপ বেশ দক্ষ। বাখমুটের লড়াই থেকে আমরা এর প্রমাণ পাই। কাজেই এই সামরিক পথে এই সমস্যার সমাধান বেশ কঠিন হবে,” বলছেন তিনি।

সের্গেই মারকভের মতে ওয়াগনার গ্রুপের প্রায় বিশ হাজার মোটামুটি পেশাদার সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর অন্তত ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে আসতে হবে ইউক্রেনের রণক্ষেত্র হতে। সাথে সাথেই এটা কিন্তু ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য বড় সুযোগ তৈরি করবে। কাজেই এটা কোন সমাধান নয়।তার মতে, ক্রেমলিন তাই অন্যভাবে সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে।“প্রেসিডেন্ট পুতিন ওয়াগনার গ্রুপের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তোমরা রাশিয়ার জন্য, তোমরা প্রিগোশিনের জন্য নও, যদিও তিনি আসলে ভাষণে প্রিগোশিনের নাম করেননি, কিন্তু তার ভাষণের মর্মার্থ অনেকটা এরকমই।”

সূত্র : বিবিসি