আরাফাতের ময়দানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও করণীয়

আরাফাতের ময়দানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও করণীয়

ফাইল ছবি

নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল হাজ্জু আরাফাহ বা আরাফাই হজ। ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে ৯ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করাই হলো হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত না হওয়ার কোনো কাজা ও কাফফারা নেই। পরবর্তী বছর আবারও আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হওয়ার মাধ্যমে হজ সম্পাদন করতে হয়। অন্যথায় হজ আদায় হবে না।

আরাফার দিন। ৯ জিলহজ মিনা থেকে ফজর নামাজ আদায় করে সম্ভব হলে গোসল করে অথবা ওজু করে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরস্থিরভাবে লাব্বাইক ধ্বনির সঙ্গে আরাফার দিকে রওয়ানা হতে হবে এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত এখানে অবস্থান করতে হবে। তাই জাবালে রহমত থেকে শুরু করে মসজিদে নামিরাসহ আরাফার ময়দানের চিহ্নিত সীমানার মধ্যে যে কোনো সুবিধামত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করা।

ওকুফে আরাফা বা আরাফার ময়দানে অবস্থানের প্রধান কারণ হলো, বান্দাকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, সৃষ্টির সূচনায় এই উপত্যকায় প্রথম ‘আহদে আলাস্তু’র শপথ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কী সেই শপথ?

সেদিন আল্লাহ তাআলা আদমের পিঠ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আগত সব বনি আদমকে পিপীলিকার অবয়বে সৃষ্টি করে তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন- ‘আলাসতু বিরাব্বিকুম অর্থাৎ আমি কি তোমাদের প্রভু নই? উত্তরে সেদিন সব বনি আদমই (পিপীলিকার অবয়বে সব সৃষ্ট) বলেছিল, ‘হ্যাঁ’।’ (মুসনাদে আহমদ, মিশকাত)

কোরআনে পাকে আল্লাহ তাআলা এ কথা সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন-

সুরা আরাফের ১৭২ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে- ‘স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তান-সন্তুতি বাহির করেন এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন এবং বলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’ তারা বলে, ‘নিশ্চয়ই; আমরা স্বাক্ষী রইলাম। (এ স্বীকৃতি গ্রহণ) এ জন্য যে, তোমরা যেন কেয়ামতের দিন না বল, আমরা তো এ বিষয়ে জানতাম না।’

সুরা আরাফের ১৭৩ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে- কিংবা তোমরা যেন না বল, ‘আমাদের পূর্বপুরুষগণই তো আমাদের পূর্বে অংশী স্থাপন করেছে। আর আমরা তো তাদের পরবর্তী বংশধর। তবে কি মিথ্যাবাদীদের কৃতকর্মের জন্য তুমি তাদেরকে ধ্বংস করবে?’

একই সুরার ১৭৪ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে- আর এভাবে আমি নিদর্শনসমূহ বিবৃত করে রাখি, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।

সে দিনের সেই তাওহিদের স্বীকৃতি ও বিশ্ব মানব সম্মেলনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই আরাফাতের ময়দানের মুসলিম উম্মাহর মহাসম্মিলনকে হজের প্রধান অনুষ্ঠান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

যেখানে মুসলিম উম্মাহর মহাসম্মিলনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত মুমিন-মুসলমান একত্রিত হয় এবং আল্লাহর ইবাদতে, তাওবা-ইসতেগফারে, তাসবিহ-তাহলিল ও তাকবিরে নিয়োজিত হয়।

তাইতো মুসলিম উম্মাহ আরাফাতের ময়দানে সুবিধা মতো স্থানে জোহর থেকে মাগরিব পর্যন্ত অবস্থান করবেন। আরাফাতের ময়দানে পৌঁছে সূর্য ঢলার পরে ইমামের দেয়া হজের খুতবা গুরুত্বসহকারে শুনবেন। এরপর জোহর ও আসর নামাজ এক আজান ও আলাদা আলাদা ইকামতে মূল জামাতের সঙ্গে কসর আদায় করবেন। সম্ভব না হলে নিজ নিজ জায়গায় নিজ জামাতের সঙ্গে তা আদায় করে নেবেন।

আরাফাতের ময়দানে পৌঁছে হৃদয় দিয়ে সে ইতিহাস স্মরণ করা বা স্মৃতিচারণ করা জরুরি যে, ‘এ ময়দানেই একদিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের থেকে তাকে প্রভু হিসেবে মেনে নেয়ার স্বীকৃতি গ্রহণ করেছিলেন। আর আমরা তাকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করেছিলাম।

সুতরাং আজকের এ দিনে আমরা প্রভুর গোলাম হতে চাই। শয়তানের দাসত্ব থেকে বেরিয়ে এসে জীবনের সার্বিক দায়িত্ব-কর্তব্য সব কিছুই প্রভুর কাছে ন্যস্ত করতে চাই।

এ দৃঢ় সংকল্প নিয়ে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান কালে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সঙ্গে তার তাসবিহ-তাহলিল, তাকবির ও দোয়া-দরূদের মাধ্যমে নিয়োজিত থাকা।

কেবলামুখী হয়ে আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে কায়মনোচিত্তে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আল্লাহ তাআলা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। জাহান্নাম থেকে মুক্ত করেন।

কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আরাফার দিন আল্লাহ তাআলা সর্বাধিক সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করে থাকেন এবং তার নিকটবর্তী হন ও ফেরেশতাদের কাছে গৌর্ব করে বলেন, দেখ ওরা কি চায়? (মুসলিম)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘তিনি নিম্ন আকাশে নেমে আসেন ও ফেরেশতাদের বলেন, তোমরা সাক্ষী থাক আমি ওদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম।’ মুসনাদে বাযযার, তাবারানি, তারগিব)

তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘শ্রেষ্ঠ দোয়া হলো আরাফার দোয়া। তাই আল্লাহ তাআলার সেই ঐতিহাসিক স্বীকৃতির কথা স্মরণ করে তার কাছে দোয়া-দরূদ ও ইসতেগফারে নিয়োজিত থাকা জরুরি।

আরাফাতের ময়দানে করণীয়

সারাবিশ্ব থেকে আগত আল্লাহর মেহমানরা আরাফাতের ময়দানের বিশ্ব মুসলিম সম্মিলনে একত্রিত হয়। এ দিনে আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে বেশি মানুষের গুনাহ ক্ষমা করে নিষ্পাপ করে দেন। এ দিন ও হজ সম্পর্কে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আলহাজ্জু আরাফাহ’ অর্থাৎ আরাফাই হজ। ৯ জিলহজ হজযাত্রীদের জন্য রয়েছে কিছু করণীয়। তাহলো-

এ দিন ফজরের নামাজের পর যে যেখানে থাকবে সেখানে থাকা অবস্থায়ই তাকবিরে তাশরিক পড়বেন। তাকবিরে তাশরিক ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত পড়া ওয়াজিব।

তাকবিরে তাশরিক হলো- আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, ওয়ালিল্লাহিল হামদ্।

অর্থ : ‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ মহান, আল্লাহ ব্যতিত কোনো উপাস্য নেই; সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আল্লাহ মহান।’

তাকবিরে তাশরিক পড়ার পর তালবিয়া পড়া। পুরো তালবিয়াকে ৪ ভাগে (নিঃশ্বাসে) ৩ বার পাঠ করা-

তালবিয়া হলো- লাব্বাইকা আল্লা-হুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্‌নিমাতা লাকা ওয়ালমুল্‌ক, লা শারিকা লাক।

অর্থ: আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত! আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোনো অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সব প্রশংসা ও সম্পদরাজি তথা নেয়ামত আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্যও আপনার। আপনার কোনো অংশীদার নেই

জিলহজের ৯ তারিখ সূর্য ওঠার পর তাকবিরে তাশরিক, তালবিয়া, দোয়া এবং তাসবিহ-তাকবির পড়তে পড়তে আরাফাতের ময়দানের দিকে রওয়ানা হওয়া।

অবশ্যই জোহরের আগে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হওয়া।

আরাফাতের ময়দানে জাবালে রহমতের কাছাকাছি অবস্থান করা উত্তম।

জোহর ও আসরের নামাজ আরাফাতের ময়দান সংলগ্ন মসজিদে নামিরায় এক সঙ্গে জামাতে নিদিষ্ট শর্তানুসারে আদায় করা উত্তম।

মসজিদে নামিরায় অনুষ্ঠিত জামাতে শরিক হতে না পারলে নিজ নিজ তাবুতে যথাসময়ে জোহর ও আসর নামাজ পড়ে নেওয়া।

মসজিদে নামিরার দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ‘বতনে উরানায়’ অবস্থান করা যাবে না।

আরাফাতের ময়দানে অবস্থানকালীন সময়ে তাওবা-ইসতেগফার, তাসবিহ-তাহলিল-তাকবির ও দোয়ার মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করা। কেননা আরাফাতের ময়দানের দোয়াই আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে বেশি কবুল করেন।

দুপুরের আগেই সম্ভব হলে আরাফাতের ময়দানে গোসল করে নেওয়া। অন্যথায় ওজু করে নেওয়া।

হজের খুতবা মনোযোগ সহকারে শোনা।

সূর্য ডোবা পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। তবে কেউ যদি সূর্য ডোবার আগে আরাফাতের ময়দান থেকে বের হয়ে যায়, তবে তার কর্তব্য হলো তিনি পুনরায় আরাফাতের ময়দানে ফিরে আসবেন এবং সূর্য ডোবার পর আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করবেন। ফিরে না আসলে ওই ব্যক্তি জন্য দম বা কোরবানি আবশ্যক হয়ে যাবে।

আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময়ে বেশি বেশি তাওবা-ইসতেগফার ও দোয়া করা।

সূর্য ডোবার পরপরই মাগরিব না পরেই মুজদালিফার উদ্দেশ্যে তালবিয়া পড়তে পড়তে আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করা।

আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করার সময় মুজদালিফায় না পৌছে রাস্তায় মাগরিবের নামাজ পড়া যাবে না। মুজদালিফায় পৌঁছে এক আজান ও আলাদা আলাদা ইক্বামতে মাগরিব ও ইশার নামাজ আদায় করা।

যদি কেউ আরাফাতের ময়দান কিংবা পথে মাগরিবের নামাজ আদায় করে তবে ওই ব্যক্তির জন্য মুজদালিফায় গিয়ে পুনরায় মাগরিবের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন-সুন্নায় ঘোষিত নির্দেশনা মোতাবেক আরাফার দিনে দোয়া-দরূদ ও তাওবা-ইসতেগফার করার তাওফিক দান করুন। হজে মাবরুর দান করুন। আমিন।