ষড়যন্ত্র নয়, হাতিয়ার হোক রাজনীতি
ফাইল ছবি।
গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুরকে আমি বেশ পছন্দ করি। প্রথম কথা হলো, যে কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে নুরুল হক নুরের উত্থান, আমি নৈতিকভাবে সে আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলাম, এখনও আছি। সেই আন্দোলনের মতো এখনও নুরের অনেক অবস্থানের সাথে আমার সুস্পষ্ট দ্বিমত আছে। তারপরও নুরকে আমি বেশ পছন্দ করি। পছন্দ করি তার সাহসের জন্য, লেগে থাকার ধৈর্যের জন্য।
প্রথমে বলে নেই, কোটা সংস্কার আন্দোলনের কথা। আমি এখনও মনে করি, একটি সভ্য সমাজে সুযোগের ন্যায্য বণ্টনের জন্য কোটা থাকাটা জরুরি। স্রেফ মেধার জোরে সব বিবেচনা করলে দুর্বল, প্রান্তিক, গরিব মানুষেরা বারবার বঞ্চিত হবে। সমান অধিকার নয়, রাষ্ট্রের দায়িত্ব সব অধিকার ন্যায্যতার সাথে বণ্টন করা। দুর্বলের পাশে থাকা। কিন্তু কোটা নয়, মেধার ভিত্তিতেই চাকরির দাবিতে মাঠে নামা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন খুব সহজেই মানুষের বিপুল সমর্থন পায়। এক পর্যায়ে সরকার সে দাবি মেনেও নেয়।
দাবি ন্যায্য-অন্যায্য যাই হোক, বিপুল জনসমর্থনের কাছে হার মানতে হয়েছে সরকারকে। আন্দোলনের দাবির সাথে দ্বিমত থাকলেও কোটা সংস্কার আন্দোলন করার অধিকারের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ বা ছাত্রলীগের হামলার তীব্র নিন্দা করেছি। অনেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমার অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্ত ছিলেন। তারা বলতেন, আপনি কোটা আন্দোলনের কট্টর বিরোধী, আবার তাদের ওপর হামলা হলেও প্রতিবাদ করছেন; কেন?
এই বিভ্রান্ত মানুষদের আমি বলেছি, এটাই গণতন্ত্র। আমি গণতন্ত্রের পক্ষে। আপনার সাথে আমার মতে নাও মিলতে পারে, কিন্তু আপনার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবো। তাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে নৈতিকভাবে দ্বিমত থাকলেও তাদের আন্দোলন করার অধিকারের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। ন্যায্যতা একটা আপেক্ষিক বিষয়। কোটা আন্দোলন আমার কাছে ন্যায্য মনে না হলেও দেশের সিংহভাগ মানুষের কাছে সেটা ন্যায্য মনে হয়েছে।
জনগণের আবেগের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকারও সে দাবি মেনে নিয়েছিল। অনেকদিন পর ছাত্র অধিকার পরিষদের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন করে নুরুল হক নুর প্রমাণ করেছেন, জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করলে তাতে সফল হওয়া যায়।
আরেকটা বিষয়ও নুরুল হক নুর প্রমাণ করেছেন, সরকার যতই দমন-পীড়ন চালাক, সফল হতে হলে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। বাংলাদেশে আসলে অনেকদিন পর নুরুল হক নুরের মতো দাবির প্রশ্নে অবিচল, নির্যাতনের সামনে অটল একজন নেতা পেয়েছিল। তবে আমি মনে করি কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল টার্গেট ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরসূরিদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নুরুল হক নুর বুঝে হোক, না বুঝে হোক; আন্দোলনের নামে সবচেয়ে বড় আঘাতটা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়।
তবে নুরুল হক নুর কৌশলে কোটা আন্দোলনের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ডাকসুর ভিপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। নুরের ডাকসুর ভিপি হওয়াটা বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতি বিবেচনায় একটু বিস্ময়করই বটে। তার ভিপি নির্বাচিত হওয়াটা একই সঙ্গে দুই দলের জন্যই জবাব। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ ছাড়া আর কারও কোনো অস্তিত্ব নেই, এই মিথ ভেঙে দিয়েছিলেন নুর। ছাত্রলীগকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, জোর করে হল দখল করে, মিছিলে নিলেই সংগঠন শক্তিশালী হয় না। শিক্ষার্থীদের হৃদয় জয় করতে হলে, তাদের ভালোবাসতে হয়, তাদের আসল সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হয়।
নুরের উত্থান বিরোধী দলের জন্যও বড় শিক্ষা। নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বারবার দাবি করে, ছাত্রলীগের ভয়ে তারা কোনো ক্যাম্পাসে যেতে পারেন না। নুরুল হক নুর তাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভয় পেলে চলবে না। নির্যাতনের মুখে সাহসের সাথে রুখে দাঁড়াতে হবে। আর সাহস নিয়ে রুখে দাঁড়াতে পারলে সব মিথ ভেঙে দিয়ে ডাকসুর ভিপি হওয়াও অসম্ভব নয়।
নুরুল হক নুরকে ভালো লাগার আরেকটা কারণ হলো, তার মাটিলগ্নতা। নুরকে আমার অন্যদের মতো চতুর মনে হয়নি। লোক দেখানো স্মার্টনেস তার মধ্যে নেই। কথা বলেন, মাটির ভাষায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও তিনি উঠে এসেছেন তৃণমূল থেকে। সেই মাটির গন্ধটা তিনি গা থেকে ঝেড়ে ফেলেননি। শহুরে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টাও করেননি। ক্যাম্পাসের সেই অদম্য সাহস, হার না মানা মনোবল আর জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করেই জাতীয় রাজনীতিতে পা রাখেন নুরুল হক নুর। গড়ে তোলেন গণ অধিকার পরিষদ। আহ্বায়ক হিসেবে বেছে নেন ক্লিন ইমেজের ড. রেজা কিবরিয়াকে।
সব মিলিয়ে আমার মতো বিপুল সংখ্যক মানুষ নুরুল হক নুরের মধ্যে বিশাল সম্ভাবনা দেখতে পান। সাহস করে প্রতিবাদ করা যায়, নুর বারবার এটা আমাদের মতো ভীরুদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন।
সরকারের বিরুদ্ধে তার সাহসী বক্তব্য আরও অনেককেই অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু নুরুল হক নুর আমাদের হতাশ করতে খুব বেশি সময় নেননি। গণ অধিকার পরিষদের এখনও দুই বছর পূর্ণ হয়নি; এরই মধ্যে নুর আমাদের হতাশ করেছেন। নিজেকে আরও একজন ধান্ধাবাজ, চান্ধাবাজ রাজনীতিবিদ হিসেবেই তুলে এনেছেন। যে সারল্য দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম, তা আসলে একধরনের মুখোশ; আসলে নুরুল হক নুর বাংলাদেশের ‘ভিলেজ পলিটিক্স’র একজন প্রতিভূ।
গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছেন বটে, কিন্তু তার সংগঠনে গণতন্ত্রের লেশমাত্রও নেই। নিজে সদস্য সচিব হলেও গণ অধিকার পরিষদ মানেই নুরুল হক নুর। তিনি ইচ্ছামতো আহ্বায়ক পছন্দ করেন, আবার পছন্দ না হলে বিদায় করে দেন। এসবকেও আমি বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতির ধারা হিসেবেই গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি আমাকে হতাশ করেছে বারবার। নুর বা তার সঙ্গীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করলেও তারা কেউ সরকারি চাকরির চেষ্টাই করেননি।
৫ বছর ধরে ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে গণ অধিকার পরিষদ করেই কাটছে নুর এবং তার সঙ্গীদের সময়। এই ৫ বছরে তাদের দৃশ্যমান কোনো পেশা নেই, কিন্তু ঠাটবাট আছে। বাংলাদেশের আরও অনেক সংগঠনের মতো নুরদের সংগঠনও যে জনগণের চাঁদায় চলে, তা এখন ওপেন সিক্রেট। টাকার হিসাব চাইতে গিয়েই চাকরি হারিয়েছেন রেজা কিবরিয়া।
গণতন্ত্রহীনতা, চাঁদাবাজিকে আমি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রচলিত ধারা হিসেবে অনিচ্ছায় হলেও মেনে নিতাম হয়তো। কিন্তু গত বছর দুয়েক সময়ে নুরুল হক নুর নিজেকে যতটা না রাজনীতিবিদ, তারচেয়ে বেশি ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যে জনগণের সম্পৃক্ততার পথ ধরে তার উত্থান, তার সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। প্রেস ক্লাবে গরম গরম বক্তৃতা দেয়া আর বিভিন্ন দূতাবাসে ঘোরাফেরায়ই কাটে তার সময়। তবে বিভিন্ন দূতাবাসে কূটনীতিকদের সাথেই বৈঠক হলেও অতটা আপত্তির হতো না বিষয়টা। কিন্তু কূটনীতিকদের চেয়ে গোয়েন্দারা তার বেশি পছন্দ।
বাংলাদেশের সাথে ইসরায়েলের কোনো কূটনৈতিক কোনো সম্পর্ক নেই। তাই সব দলের রাজনীতিবিদরাই ইসরায়েলকে এড়িয়ে চলেন। কিন্তু সেদিনের রাজনীতিবিদ নুরুল হক নুর দুবাইয়ের ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এক এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সাথে বৈঠক করেছেন। সে বৈঠকের ছবি ছাপা হয়েছে গণমাধ্যমে। নুর বারবার সে বৈঠকের খবর অস্বীকার করলেও তার দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া নিজে এ অভিযোগ এনেছেন। যারা নুরকে গাড়ি চালিয়ে সে বৈঠকে নিয়ে গিয়েছিল, তাতের রেফারেন্স দিয়েছেন।
বৈঠক থেকে ফেরার সময় নুর একটি কালো ব্যাগ নিয়ে এসেছেন, রেজা কিবরিয়া এমন অভিযোগও করেছেন। এখন বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত অভিযোগ করেছেন, মোসাদের এজেন্টের সাথে নুরের বৈঠক একবার নয়, তিনবার হয়েছে। যে দেশের সাথে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই, সে দেশের গোয়েন্দার সাথে নুরুল হক নুরের এত কীসের বৈঠক?
শুধু ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা নয়, পার্শ্ববর্তী দেশের গোয়েন্দাদের সাথে নুরের বৈঠকের অভিযোগ ভেসে বেড়ায় বাতাসে। কখনো ঢাকা, কখনো দিল্লী, নেপাল, দুবাই, কাতার- নুরুল হক নুর যেন এক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী।
তৃণমূল থেকে উঠে আসা সারল্যে ঢাকা একজন জনপ্রিয় ছাত্রনেতাকে এভাবে চতুর, ধান্ধাবাজ, চান্ধাবাজ, ষড়যন্ত্রকারী রাজনীতিবিদে বদলে যাওয়া দেখতে কষ্ট হয়। এভাবেই আশার জায়গাগুলো হতাশায় বদলে যায়। রাজনীতি হতে হবে জনগণের জন্য, জনগণকে নিয়ে; কোনো ষড়যন্ত্র দিয়ে রাজনীতিতে জেতা যায় না।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।