"বিশ্ব শিক্ষক দিবস" ও একটু আক্ষেপ

"বিশ্ব শিক্ষক দিবস" ও একটু আক্ষেপ

মোঃ শামসুল আলম প্রভাষক, আরবি ও ইসলাম শিক্ষা লোহাগড়া সরকারি আদর্শ কলেজ, নড়াইল।

"Valuing teacher voices: Towards a new social contract for education." এই মুল প্রতিপাদ্য নিয়ে এবছরে বিশ্ব শিক্ষক দিবস ঘোষণা করেছে ঈলো ( ১৯৯৪ সালে)  যা বাংলাদেশ সহ ILO সদস্যভুক্ত দেশ একযোগে উদযাপন করবে। UNESCO ১৯৯৬ সালে এই দিবসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এইবার এই প্রতিপাদ্যের দিকে আলোকপাত করে,  শিক্ষকদের কন্ঠঃস্বরকে যদি সত্যিকারার্থে আমরা সমাজের মানুষের কাছে পৌছে দিতে চাই, তাহলে তাদেরকে ক্ষমতাবান কোন বদ্ধ পরিবেশ থেকে মুক্ত করে জনগনের পরিবেশে স্বাধীনভাবে ক্ষমতায়ণ করে পাঠাতে হবে। সত্যিকারের শিক্ষক এই প্রতিপাদ্য ও এর সারবস্তুতে কি ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন কিভাবে সেখান থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজে লাগাবেন। সেই বিষয়টুকু ও নিশ্চিত করার অধিকার তাঁদেরকে স্বাধীনভাবে নিতে দিতে হবে। অন্তত এই দিবসে শিক্ষকরা তাদের অধিকার, কর্তব্য, কর্মস্থলের প্রতিবন্ধকতা, আক্ষেপ ও শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলুক আপনারা শ্রোতা হয়ে যান।  শিক্ষক সমাজের একজন  প্রতিনিধি হিসেবে আমার উপলব্ধি হল আয়োজনের ব্যানারে এইসব প্রতিপাদ্য সন্নিবেশ হলেও রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মহলে শিক্ষকদের কন্ঠঃস্বর শোনার মানসিকতা এখনও তৈরি হয়নি। নাম সর্বঃস্ব এই সকল কর্মসূচি পালিত হলেও আদৌতে কোন উপকার শিক্ষক সমাজের জন্য বয়ে আনেনা। এই দিবসে আসলে ইতিবাচক কি পেলাম? কি পেলাম না  এগুলো মূল্যায়ন করে ভবিষ্যৎ রুপরেখা তৈরি করা উচিত।

২০২২ সালে প্রথমবারের মতো এই দিবসকে শিক্ষকদের নেতৃত্বে উদযাপন করতে দেখেছি। কি জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান!।  উপজেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দের মিলনমেলা, র‍্যালী শেষে উন্মুক্ত পরিবেশে আলোচনা সভা। রিজার্ভ চেয়ারের কোন ব্যবস্থা নেই,  প্রাইমারির সহকারী শিক্ষক থেকে কলেজের প্রফেসর, যে যার মতো মনের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন, কোথাও কোন বাঁধা নাই, সর্ট লিস্টেড বক্তা নাই। এই দিবসে এটাই তো হওয়া উচিত? নাকি বদ্ধ, অশিক্ষক প্রতিকূল  পরিবেশে কাঁপা গলায় মনের আকাঙ্খার বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষেত্র তৈরি  করা উচিত। আমি মনে করি অন্ততঃ এইদিন ইচ্ছার বিরুদ্ধে মনের অনুভূতি ব্যক্ত করা উচিত নয়।এবং সেই ক্ষেত্র ও যেন আমরা তৈরি না করি।

 

আবার জাতিসংঘ, ইউনেস্কোর সাথে স্বাক্ষরিত অঙ্গিকার বাস্তবায়নের জন্য বা  দাতা সংস্থার প্রেসারে  কোনো কর্মসূচি পালনের তাগিদ থেকে এই অনুষ্ঠান পালন করবেন, শিক্ষকদের সম্মান জানানোর অনুষ্ঠানের নামে অশিক্ষক ক্ষমতাবানগণ শিক্ষকদের দিয়ে মিলনায়তন পূর্ণ করবেন , শোভাযাত্রা করবেন এবং তাদেরকে যথেষ্ঠ সম্মান করেছেন বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করবেন- এটা কোনো ভাল কথা নয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ও শিক্ষক দিবস পালিত হয়। সেখানে এই দিবসে  ছাত্র-ছাত্রীরা  তাদের শিক্ষকদের নানাভাবে সম্মানিত করেন। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থাকে। তবে সেই অনুষ্ঠানে শিক্ষকগণই মুখ্য ভুমিকা পালন করেন । অন্যরা নত হয়ে তাঁদেরকে সম্মান জানান। আমাদের এখানে এখনো সেই দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি। দিবস উদযাপন প্রক্রিয়াতেই ত্রুটি থাকায়  একটি সুন্দর উদ্যোগ বিকৃতিতে পর্যবসিত হচ্ছে। সুতরাং বৈষম্য মুক্ত সুন্দর আগামী বাংলাদেশ গঠন করতে চাইলে এই দিবসটি অন্তত শিক্ষকদের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।

আমাদের রাষ্ট্রকে আগে ঠিক করতে হবে আমরা এই দিবসে  আসলে কী চাই। "শিক্ষক দিবস" একটি অত্যন্ত সুন্দর ধারণা। শিক্ষকগণ সম্মানিত হলে জাতি ও রাষ্ট্র সত্যিকারভাবে এগিয়ে যাবে এটা রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন, এইজন্য ফ্যাসিবাদী শক্তি সব সময় তাদের ক্ষমতা ও আধিপত্যকে ধরে রাখতে এটাকে সবসময় পিছনে রাখে ও কম গুরুত্ব দেয় । এটাই তাদের একমাত্র শক্তি। শিক্ষা সেক্টরকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে চায় যে, " যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে,তত কম মানে"

এখন সংস্কারের সময় যার যার নায্য পাওনা তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সংস্কারের অংশ হিসেবে ৫ ধরনের সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়নি। যা সত্যি উদ্বেগজনক। দ্রুত শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের জন্য রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাই।

 পাশাপাশি  শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দিবস উদযাপন করার নেতৃত্ব শিক্ষকদের হাতে দেওয়ার অনুরোধ করি।

আর এ ক্ষেত্রে  সায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিসিএস সাধারণ ক্যাডারের হাতে নেতৃত্ব দেওয়া যথাপোযুক্ত বলে আমি বিশ্বাস করি।

কারন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রশাসনিক নেতৃত্বের ধারণাটি  এসেছে তার সৃষ্টি থেকে। ব্রিটিশ বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিস থেকে ইস্ট পাকিস্তান  এডুকেশন সার্ভিস পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের  উদ্ভব ঘটে। আর এটা গঠন করার কতগুলো উদ্দেশ্যে ছিল যার মধ্যে  মুল উদ্দেশ্য ছিল দুইটি।  একটি হলো ক্লাসে পাঠদান করা । দ্বিতীয়টি হলো  শিক্ষায় প্রশাসনটাকেও দেখাশোনা করবে, শিক্ষার সামগ্রিক মান কীভাবে আরো অগ্রসর করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করবে। কিন্তু কালের বিবর্তনে এই ক্যাডারটা এখন শুধু শ্রেণিকক্ষে আবদ্ধ করার চেষ্টা করার পায়তারা চলছে। এমনকি বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, যা আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সেক্টরে যেমন: প্রাইমারি শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এই ক্যাডারের পদ বিলুপ্ত করার মাধ্যমে। আর এভাবেই এই ক্যাডারকে প্রশাসনিক নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করে শ্রেণি কক্ষে পাটদানের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চাচ্ছে। যা এই ক্যাডার সৃষ্টির স্ব-বিরোধী পদক্ষেপ। অথচ এই সকল জায়গায় যদি শিক্ষা ক্যাডারের অবস্থান থাকতো তাদের নেতৃত্ব এর পাশাপাশি উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে ও যদি বড় কলেজগুলোর নেতৃত্বে এই দিবস উদযাপন করা হতো তাহলে একদিকে শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টির প্রশাসনিক দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো অন্যদিকে সারা দেশে  সকল শিক্ষক ই স্বাধীন উন্মুক্তভাবে এই দিবস উদযাপন করতে পারতো। এমনকি  স্ব-স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উন্মুক্তভাবে ও উদযাপন করার ক্ষমতা দিলে আরো সুন্দর ভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে এই " শিক্ষক দিবস" সুন্দরভাবে উদযাপন করা যেত এবং এই দিবস এর মাহাত্ম্য  বহুগুন বৃদ্ধি পেত।

সুতরাং আগামী বছর রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা থাকবে যেন এই শিক্ষক দিবসটি উদযাপনের দায়িত্ব শিক্ষকদের হাতেই দেওয়া হয়।

মোঃ শামসুল আলম

প্রভাষক, আরবি ও ইসলাম শিক্ষা

লোহাগড়া সরকারি আদর্শ কলেজ, নড়াইল

shamsul.sdu@gmail.com