এরদোয়ানের নতুন সরকার, তুরস্ক-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং সম্ভাবনা

এরদোয়ানের নতুন সরকার, তুরস্ক-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং সম্ভাবনা

ফাইল ছবি।

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এবারের নির্বাচনে জিতেছেন এরদোয়ান, আর এই নিয়ে হলেন তুরস্কের সবচেয়ে বেশিবার নির্বাচিত এবং ১৩তম প্রেসিডেন্ট। নির্বাচন-পরবর্তী এরদোয়ান সরকারের সবকিছু ছাড়িয়ে তাঁর মন্ত্রিসভাই ছিল সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। তুরস্কের ইতিহাসের সবচেয়ে অভিজ্ঞ আর এলিট মন্ত্রীদের নিয়ে সভা গঠিত হয়েছে বলেই হয়তোবা এমন মন্তব্য সমীচীন।

এইবারের মন্ত্রিসভায় সবচেয়ে নজরকাড়া একজন ছিলেন তুরস্কের সাবেক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান আর বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান। তুরস্কের বর্তমান শক্তিশালী অবস্থানের পেছনে এরদোয়ানের পর হাকান ফিদানই সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা রেখেছেন বললে একদমই বাড়িয়ে বলা হবে না।

এই মুহূর্তে আমাদের জন্য যে বিষয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদানের সময় তুরস্ক-বাংলাদেশ সম্পর্কটা ঠিক কেমন হওয়া উচিত, তা বোঝা আর বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের তার আলোকে উপযুক্ত নীতিনির্ধারণ করা।

২০২০ সালে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় বাংলাদেশের একটি নতুন দূতাবাস কমপ্লেক্সের উদ্বোধনকালে তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তা ১৩০০ শতাব্দীর বলে বক্তৃতায় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তুরস্ক-বাংলাদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ১৯৭৪ সালে স্থাপিত হয়ে থাকলেও, মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত তুরস্ক এবং বাংলার জনগণের মধ্যে যে বিস্তৃত সম্পর্ক লক্ষ করা যায়, তা সম্ভব হয়েছে কেবল পরবর্তী সালতানাত, মোগল ও ব্রিটিশ আমলের মারফতেই।

মোগল-উসমানীয়দের মধ্যে এই বিস্তৃত সম্পর্ককে দূরে রেখে আমরা যদি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তাকাই, তাহলেও দেখতে পাই যে তুরস্কের স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালি মুসলমানেরা তুরস্ককেই সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিল। ইতিহাসজুড়ে এসব মিথস্ক্রিয়া ও সাংস্কৃতিক উপাদানের আদান-প্রদান ও ভাব বিনিময়ই এক দেশের প্রতি অন্য দেশের সাহায্য-সহযোগিতার যেসব সম্ভাবনা তার দরজা খুলে দিতে প্রভাব ফেলেছে।

ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) অধীনে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিগুলো, বিশেষ করে তাদের ‘বহুমাত্রিক বৈদেশিক নীতি’ বলা যায় বিশ্বের নানা অঞ্চলে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তখন থেকেই দেশটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পেরেছে, যা তাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা ও মানবিক সহায়তা প্রদান ছাড়াও পুরোনো মিত্রদের সঙ্গে ঐতিহাসিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখাতে বিপুল সক্ষমতা এনে দিয়েছে।

দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রসমূহ

২০১৯ সালে, আঙ্কারা তার ‘এশিয়া অ্যানিউ (নতুন করে এশিয়া)’ উদ্যোগের পরিচিতি ঘটায়, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশটির সঙ্গে এশিয়ার দেশগুলোর সৌহার্দ্য-সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক ত্বরান্বিত করা। এই উদ্যোগ বাণিজ্য, সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষা, বিনিয়োগসহ আরও বিভিন্ন রকমের খাতে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করতে শুরু করে।

এমন একটি উদ্যোগে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও কৌশলগত তাৎপর্যের কথা বিবেচনা করে অন্যতম একটি ফোকাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, তুরস্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোলু উল্লেখ করেছেন, প্রাণবন্ত অর্থনীতি এবং তরুণ জনসংখ্যাপূর্ণ একটি দেশ হওয়ায় তুরস্কের এশিয়া অ্যানিউ উদ্যোগে বাংলাদেশ অন্যতম একটি অংশীদার।

২০১০ সালে তুরস্কের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ঢাকা সফরে আসার পর এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে তুরস্ক সফর করার পর গত দশকটিতে তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের এক নতুন মাত্রার উন্মোচন হয়। পরপর ঘটে যাওয়া এই সফরগুলো ‘তুরস্ক-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল’ গঠনসহ দুই দেশের মধ্যে বৈচিত্র্যপূর্ণ সহযোগিতার পথ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল, যা উন্নয়নের এক বিস্তীর্ণ কর্মসূচির লক্ষ্য পূরণেও সহায়তা করেছে।

কয়েক বছরের রাজনৈতিক সংকট ও ভুল-বোঝাবুঝির পর ২০১৭ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিন আলী ইলদিরিম ও বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পারস্পরিক সফরের মাধ্যমে দেশ দুটি পুনরায় তাদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি দেখতে শুরু করে। তখন থেকেই বলা যায়, এই দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের মধ্যকার সম্পর্ক সর্বকালের সেরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হিসেবে টিকে রয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তুরস্কের জন্য বাংলাদেশ হতে পারে এক চমৎকার অর্থনৈতিক বাজার। কেননা, বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যা এবং দেশটি উদীয়মান দুই এশিয়ান শক্তি—চীন ও ভারতের মাঝামাঝিতে কৌশলগতভাবে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। এগুলো ছাড়াও এক শান্তিপূর্ণ বিশ্বগঠনের সর্বজনীন উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে মুসলিম উম্মাহর দৃষ্টিভঙ্গি তো রয়েছেই।

নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তুরস্ক থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগে আকৃষ্ট করাই হবে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার। ২০১৮ সালে তৈরি পোশাকশিল্প খাতের উল্লেখযোগ্য অবদানের ফলে বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফলে ভারতের পর দক্ষিণ এশিয়ায় তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। বছরের শুরুতে ধীরগতির পর ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৫ শতাংশ বেড়েছে।

২০১০ সাল থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে থাকলেও তুরস্ক এই সংখ্যাকে ২ থেকে ৩ বিলিয়নে নিয়ে যেতে আগ্রহী। ২০১২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তুরস্ক-বাংলাদেশের মধ্যে চলমান ‘ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ)’ চুক্তিতে ভেটো প্রদান করলে সেই চুক্তি বাস্তবায়ন ব্যর্থ হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তুরস্কের কাছে ‘প্রোফিশিয়েন্ট ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ)’ নামে আরেকটি চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে।